কবিতা ও তার মাকড়সা: অলোকপর্ণা
Bengali Short Story: অন্ধকারে মাকড়সা কবি তাঁর জালে আটকা পড়া কবিতার দিকে জুলজুল করে চেয়ে থাকেন, শব্দগুলো মাথার ভিতর ফাটে, যেভাবে ঠোঁট বা বোমা।
কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। অশরীরী পাঠক বাদে কবিতাটির কোনও কুলে আর কেউ নেই। কবি এমন নন যে জনে জনে ডেকে ডেকে “আজ রঞ্জন আসবে”-র মতো সোচ্চারে পাড়াপড়শিকে জানাবেন যে কবিতাটি প্রকাশিত হল, পূজাবার্ষিকীতে। ঘরকুনো কবির সদ্যোজাত কবিতাটি তার ভবিতব্যের দিকে এগিয়ে চলে, যেখানে শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকারের শিকারি মাকড়সা তার জাল ফেলে বসে থাকে।
তবু ফুল ফোটে, ডিম ফোটে, আলো ফোটে, দুধ ফোটে, আগুন, বারুদও। কবির কবিতাটি একদিন সাতসকালে ফুটে ওঠে জনৈক পাঠকের মাথায়। পাঠক কবিকে শুধায়, “এ কবিতার অর্থ কী?”
অন্ধকারের শিকারি মাকড়সা কবি পিটপিট করে তার পাঠককে দেখেন, বিশ্বাস করতে সময় নেন, তারপর বলেন, “এ কবিতার অর্থ আধেক ঘুম, এক ছটাক অপমান আর পথ হারা অশ্বের দল।”
পাঠক অবাক থেকে হতবাক হয়, পড়ায় গাফিলতি রয়ে গেছে ভেবে সে ফিরে যায় কবিতার কাছে।
কবি নিঝুম তালে পথ চলতে থাকেন। একরত্তি পাঠক নিয়ে উল্লসিত হবেন, না বিমর্ষ, বুঝে উঠতে পারেন না। মোড়ের মাথায় তার দেখা হয় দোকানদার রাণার সঙ্গে। কবি আবিষ্কার করেন কবিতাটি সেও পড়েছে যখন সে কবির কাছে তার অর্থ জানতে চায়। এক কেজি পেঁয়াজ, এক লিটার তেল ব্যাগে ভরতে ভরতে কবি বলেন, “এ কবিতার অর্থ ওজন, হিসেব, দেনাপাওনার ক্ষয়, দিনগত ক্লেদ, ক্লান্তি আর দাঁড়িপাল্লা।”
রাণা খুচরো ফেরত দিতে ভুলে যায়। কবি ভুলে যান চাল কিনতে। দুলকিচালে পথ চলতে চলতে তিনি ঘরে ফেরেন। দেখেন তাঁর দাদার শ্বশুরের ভাইয়ের মেয়ের ছেলের শ্যালকের স্ত্রীর মাসতুতো বোনের পিসতুতো ভাইয়ের ভায়রাভাই তার অপেক্ষায় বসে আছেন। দাদার শ্বশুরের ভাইয়ের মেয়ের ছেলের শ্যালকের স্ত্রীর মাসতুতো বোনের পিসতুতো ভাইয়ের ভায়রাভাই তাঁকে বিস্মিত করে একথা সেকথার পর জিজ্ঞেস করেন, “ভাই কবিতাটার মানে কী?”
কবি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, “এই কবিতাটি ছুটির আবেদনপত্র, অথবা সাজা মকুবের, অথবা প্রেমের আর্জি, অথবা স্যুইসাইড নোট।”
দাদার শ্বশুরের ভাইয়ের মেয়ের ছেলের শ্যালকের স্ত্রীর মাসতুতো বোনের পিসতুতো ভাইয়ের ভায়রাভাই যেন সমস্তটাই ধরতে পেরেছেন এমনভাবে মাথা নাড়তে থাকেন, নাড়তেই থাকেন। সম্ভবত তিনি এখনও মাথা নেড়েই চলেছেন।
কবিতাটি পোড় খায় এরপর কিছুদিন। কবি ছুটি কাটিয়ে চাকরিতে ফেরেন। দুপুরে খাওয়ার সময় সহকর্মীরা কুশল জানতে চান, একথা সেকথার পর মোক্ষম প্রশ্নটি করেই ফেলেন একজন- “কবিতাটির অর্থ কী?”
অনাথ, তৃষিত কবিতাটি হেঁটে হেঁটে এতদূর এসেছে দেখে কবি অভিভূত হন। ভাবেন, আসল অর্থটি সবাইকে জানিয়েই ফেলবেন, কিন্তু মুখের সারি, তাদের নির্বাক চোখ, নিরেট কপাল, সূচালো নাক তাকে অন্তরে অন্তরে নিষেধ করে। কবি মুখ ফুটে বলেন, “এর অর্থ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, শাসকের দুর্নীতি, বিপ্লবের প্রস্তুতি, আমাদের শরীরের গ্যাদগ্যাদে রক্ত, ধকধকে মাংস, কচকচে মজ্জা আর হলুদ হলুদ ঘিলু বিশেষ।”
টেবিলে জড়ো সকলের খাবারের রুচি উধাও হয় কবির কথা শুনে। এমনকী তারা রাতেও কিছু মুখে ঠেকাতে পারে না। তাদের কচকচে মজ্জা আর হলুদ হলুদ ঘিলুতে ঘাঁই মারে কবিতাটি।
অনন্ত পাঠকের আশাতীত প্রশ্নে কাহিল কবি মাঝরাতে তাঁর নিজস্ব শব্দজগতে প্রবেশ করেন চোরের মতো। সদ্যোজাত কবিতাটির কাছে গিয়ে বসেন, মনে ভয় নিয়ে, যদি তাঁর মনেও কবিতাটির অস্তিত্ব, অর্থ, মরম, দরদ, জড়তা, বিহ্বলতা, কৈবল্য নিয়ে প্রশ্ন জাগে!
অন্ধকারে মাকড়সা কবি তাঁর জালে আটকা পড়া কবিতার দিকে জুলজুল করে চেয়ে থাকেন, শব্দগুলো মাথার ভিতর ফাটে, যেভাবে ঠোঁট বা বোমা। যেভাবে গাড়ির টায়ার বা পায়ের গোড়ালি। সবরকম বিস্ফোরণ শেষ হলে কবির সংশয় দূর হয়। কবি ডায়েরিতে লেখেন,
যেদিন পৃথিবীর সব রঙ শোনা যাবে, সব শব্দ দেখে ফেলবে সকলে, সব গন্ধ চেটে দেখবে সবার জিভ, সব স্পর্শ বলে ফেলবে সব্বাই, সব স্বাদ ছুঁয়ে ফেলবে সবার আঙুল, সেদিন পাড়ার মোড়ের মাথায়, একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে, হাতে চোঙা নিয়ে, মাথায় রাংতার টুপি পরে, গায়ে জাদুকরের জোব্বা চাপিয়ে, সকল কবিতার সকল অর্থ সোচ্চারে প্রকাশ করা হবে।