মনপেলিয়া: উজান চট্টোপাধ্যায়
Bengali Short Story: রাত আটটার ট্রেনটা যখন একদল ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’ নিয়ে স্টেশনে থামে, তখন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়।
মনপেলিয়ার জঙ্গলের পাশে যে ছোট্ট স্টেশনটা, লোকজন সেটারও নাম দিয়েছে ‘মনপেলিয়া’।
এমনিতেই এই রাজ্যের একেবারে পশ্চিম সীমান্তের শেষ স্টেশন, দু'পাশে অনুচ্চ মালভূমি-রুক্ষ, মধ্যিখানে এই ছোট্ট স্টেশন মনপেলিয়া। স্টেশনটা বেশ নিচু, ট্রেন এলে ট্রেনের দরজা থেকে লাফিয়ে নামতে হয়।
স্টেশনটা ছোট হলেও খুব সুন্দর করে সাজানো। মাঝে মাঝে গোলাপি-লাল কাগজফুলের গাছ, সেই গাছের নীচে ছোট করে নাম লেখা ‘মনপেলিয়া’।
আরও পড়ুন: জিহাদের বিষয়-আশয়: অভিষেক ঝা
সকালে এই স্টেশন থেকে একটা ট্রেন ছাড়ে, আর রাত্তিরবেলা, আটটা নাগাদ ওই ট্রেনটাই ফিরে আসে। এই রাজ্যের পশ্চিমের রেল স্টেশনগুলোতে রোজ যাদের ‘সন্ধান চাই’-এর পোস্টার পড়ে, তারা ওই রাত আটটার ছোট ট্রেনে করে এই মনপেলিয়ায় আসে। এই স্টেশনটা কেউ চেনেও না, দুম করে চলে আসাও যায় না, কিন্তু আসা অসম্ভব নয়। যেহেতু যে কেউ চাইলেই হারিয়ে যেতে পারে, তাই তারা আসতে পারে। কিন্তু ‘সন্ধান চাই’-এর পোস্টার পড়ে যাদের, তারাই একমাত্র এখানে আসার সুযোগ পায়।
রাত আটটার ট্রেনটা যখন একদল ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’ নিয়ে স্টেশনে থামে, তখন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়। আগে যারা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, তারা ট্রেনের প্রতিটা কামরার সামনে জড়ো হয়। ট্রেন থেকে অনেকে নামতেই চায় না, ট্রেনের ভেতর বসে কাঁদতে থাকে, বাড়ির কথা মনে পড়ে বোধহয়। এইসব কান্নাকাটি সামাল দিতেই ওই আগে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া লোকগুলো প্রতিটা কামরার সামনে আসে। মনপেলিয়ায় একবার এলে আর বুঝি ফিরে যাওয়া যায় না ভেবে এই যে এত লোক কাঁদে, এদের দেখে কান্না থামাতে আসা নিরুদ্দেশ লোকগুলো মনে মনে হাসে। প্রথম দিন তারাও কেঁদেছিল, কিছুতেই নামতে চাইছিল না, ট্রেনের ভেতর বসে বসে চিৎকার করে কাঁদছিল আর লাথি মারছিল নীল রঙের বার্থগুলোকে...।
আজকে ওরাই নতুনদের নিতে এসেছে। নতুনরা কাঁদছে হিসেবমতো। পুরনো ‘নিরুদ্দেশ’-রা ধরে ধরে নতুন হারিয়ে যাওয়াদের ট্রেন থেকে নামায়। তারপর ট্রেনটা কারশেডে চলে যায়। রাতের মনপেলিয়ায় তখন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সবাই স্টেশনজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। যারা যারা কাঁদছিল, তাদের চোখ লাল হয়ে ফুলে গেছে, চোখের জলও গেছে শুকিয়ে।
আরও পড়ুন: চিনুয়া দাসের জন্মান্তর: প্রবুদ্ধ মিত্র
একটু পর চা আসে। বছর তেইশের এক প্রতিবন্ধী এসে চা দিয়ে যায় সকলকে। সকলেই চা নেয়। চুপ করে বসে চা খায় আর চুপ করে থাকে।
রাত বাড়ে। পুরনো ‘নিরুদ্দেশ’-রা গরম গরম খিচুড়ি নিয়ে আসে। অদ্ভুতভাবে, স্টেশনটা পাল্টে যেতে থাকে! সবার আস্তে আস্তে হাসি ফোটে, যেন উৎসব শুরু হয় মনপেলিয়ায়। হুড়োহুড়ি, খাওয়ার তোড়জোড়, হাসিঠাট্টা, সব মিলিয়ে কাগজফুলগুলোর মতোই রঙিন হয়ে ওঠে সবকিছু। খেতে বসে যে বৃদ্ধা পাশে বসে থাকা এক বুড়োকে ধাক্কা মেরে হেসে ওঠে, তাদের দেখে বোঝা অসম্ভব যে, একটু আগে তারা হারিয়ে গেছে।
খাওয়ার পর একজন ‘পুরনো নিরুদ্দেশ’ এসে সকলের হাতে কমলা রঙের ছোট একটা টর্চ ধরিয়ে দেয়। কারণ সবাই এবার স্টেশন ছেড়ে মনপেলিয়ার জঙ্গলের ভেতর যাবে, সেখানেই সবার শোওয়ার ব্যবস্থা।
পরদিন ভোর হয়। সবাই যেন বেড়াতে এসেছে দল বেঁধে। কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এদের ‘সন্ধান চাই’।
সকালবেলা সবাই উঠে নানারকম কাজে লেগে পড়ে। মনপেলিয়ার শালবনের ভেতর এটা একটা আস্ত গ্রামের মতো। নানারকম কাজ সেখানে। সকাল দশটায় একজন লোক খাতা, পেন, কাগজপত্র নিয়ে সেখানে আসে। সবাই আস্তে আস্তে জানতে পারে এই লোকটার নাম নেই, লোকে মাস্টার বলে ডাকে। সে এসে পড়লেই সবার কাজ বন্ধ। একটা শালগাছের নিচে একটা পাথরের বেদি আছে, সেখানে সেই মাস্টার এসে বসলেই সকলে কাজ থামিয়ে ওই বেদির সামনে এসে বসে পড়ে। সবাই ফিসফিস করে কথা বলে। নতুন ‘সন্ধান চাই’-দের কেউ কেউ ভাবে মাস্টার বুঝি খুব রাগী!
মাস্টার এক এক করে সকলের নাম খাতায় লেখে। তারপর কে কেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, তার কারণ জানতে চায়। কেউ বলে, কেউ বলে না, কেউ কেঁদে ফেলে। মাস্টার জোর করে না। বরং মনপেলিয়ার নিয়ম শোনাতে থাকে। এখানে এসে কেউ ফিরে যেতে চাইলে তাকে হয় পরের দিনই ফিরে যেতে হবে, নয়তো তেরো দিন পরে ফিরে যেতে হবে। তেরো দিন পেরিয়ে এখানে থাকলে সে সারাজীবনের বসবাস।
নিয়ম-কানুন শোনার পর কেউ কিছু বলে না, তবে সকলের মুখ দেখে বোঝা যায়, তারা পরের দিন ফিরবে না। মাস্টার কিছু বলে না। সকলকে একখানা সাদা কাগজ আর পেন দেয়। কিছু প্রশ্ন লেখা আছে, ‘সন্ধান চাই’-রা উত্তর লিখে মাস্টারকে জমা দেবে। যে লিখতে পারে না, তার কাছে পৌঁছে যায় একজন স্বাক্ষর ‘পুরনো নিরুদ্দেশ’। প্রশ্নের মধ্যে থাকে প্রিয় খাবার, প্রিয় গন্ধ, প্রিয় মানুষ, প্রিয় রং ইত্যাদি। সবাই উত্তর লিখে জমা দেয়। তারপর ‘পুরনো নিরুদ্দেশ’-রা সবাইকে নিয়ে ঝরনা দেখতে যায় আর মাস্টার বসে বসে কাগজগুলো পড়তে থাকে। এবারও হিসেবমতো সব ঠিকই আছে উত্তরে। কেউই সোজাভাবে উত্তর লেখেনি, অর্থাৎ কেউ লিখেছে- ‘আলুপোস্তর গন্ধ নাকে এলে বমি করতে ইচ্ছা করে আমার।' মাস্টার এর থেকে বুঝে নেয়, আলুপোস্তই ওর প্রিয় খাবার। যখন কারও প্রিয় খাবারে বমি আসে, প্রিয় গন্ধ দমবন্ধ করে, প্রিয় মানুষকে দেখতে সাধ হয় না আর প্রিয় রঙটা ধূসর হয়ে যায়, তখনই তো মনপেলিয়ায় আসতে হয়, তখনই তো হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে, তখনই তো নিরুদ্দেশ আর তখনই তো সন্ধান চাই-এর পোস্টার।
রাত নামে জঙ্গলে। সকালের জায়গাটিতেই সবাই মিলে বসে। বেশ কিছুজন কাল ভোরেই ফিরে যাবে, নিজের বাড়ি। তারা আজ সারাদিন ধরে মাস্টারের সঙ্গে অনেক কথা বলেছে। মাস্টার তাদের বোঝাতে পেরেছে, বাড়ি কত ভাল, কত আপন।
যারা কাল ফিরবে না, তাদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে, তেরো দিনের আগে তারা ফিরতে পারবে না। যারা রয়ে যাবে, তাদের নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ বোধহয় বেশ গুরুতর।
পরদিন সকাল আটটা। অনেকেই ফিরে গেছে। মনপেলিয়া খানিক ফাঁকা ফাঁকা। যাবার সময় বেশ ক’জন তো মাস্টারের পায়ে পড়ে কেঁদে উঠেছিল আর বলেছিল...।
সেই দিন যায়। তারপর বেশ কিছুদিন কাটে। যারা এখনও ফিরে যায়নি তাদের অন্যরকম একটা জায়গায় এখন সারাদিন রাখা হয়। সেখানে, যারা যারা শুধু জেদ করে বাড়ি যেতে চায় না, তাদের বেশ শাস্তি দেওয়া হয়। যেমন সারাজীবনের জন্য আলুপোস্ত থেকে মুখ ফিরিয়েছে বলে জেদ করে যে, সে বমি করলেও জোর করে নাকে-মুখে আলুপোস্ত গুঁজে দেওয়া হয়। এরকম নানাবিধ অত্যাচারের পর তারা যখন বেশ ক্লান্ত, শরীর চলে না, তখন তাদের বাড়ির কথা বলে মাস্টার। শুকিয়ে যাওয়া আলুপোস্তগুলো মুখ থেকে পরিস্কার করে ক্লান্ত মুখগুলোয় হাত বোলাতে বোলাতে মাস্টার বোঝায়, ফালতু জেদ ভাল নয়... আয় ঘুম যায় ঘুম...। ঘুমিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশ জেদিরা।
তেরো নম্বর দিনের সকালখানা অন্যরকম। যারা কোনও দিন বাড়ি ফিরবে না বলেছিল, তারাও বেশ বাড়ির জন্য পাগল হয়ে ওঠে। ট্রেন আসে, কিন্তু তাড়াতাড়ি ওঠে না কেউ। এরা মনপেলিয়ায় একটু বেশিদিন থেকেছে বলেই মাস্টারকে ছেড়ে যেতে চায় না। ট্রেনে না উঠে সবাই মিলে মাস্টারকে চেপে ধরে। এই ফাঁকে মাস্টারেরও চোখ ভিজে ওঠে। এরা আজ ছেড়ে যেতে চাইছে না, কিন্তু এরাই মনপেলিয়ায় নামবে না বলে ট্রেনের মধ্যে কেঁদেছিল। ট্রেন চলে যায়। মাস্টার নিজেকে সামলে নিয়ে শালবনের জঙ্গলে মিলিয়ে যায়।
এবার মনে হয়, প্রায় সবাই বাড়ি ফিরে গেছে- শালগাছের নিচে বসে ভাবতে থাকে মাস্টার। বছর তেইশের প্রতিবন্ধী এসে চা দিয়ে যায়।
একা লাগে মাস্টারের। চোখ বোজে। চোখ খুলে দেখে, সামনে বসে একজন। চুপচাপ। এরও আজ ফিরে যাবার কথা ছিল, কিন্তু ফেরেনি দেখে মাস্টার অবাক হয়, ভাবে হয়তো বোঝানো হয়নি ঠিক। তাই আবার বোঝাতে থাকে। মাস্টারের কথা থামিয়ে দিয়ে ওই লোক বলে ‘জানি আমার বাড়ি খুব ভাল মাস্টার... তবু আমি ফিরব না।’
কথা এগোয়। মাস্টার বোঝে, নতুন মাস্টার হতে চায় ওই ছোকরা।
রাত নেমেছে জঙ্গলে। জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে সব। মাস্টার আজ কতযুগ পর ঝরনার পাশে। গায়ে সেই মলিন সিল্কের সাদা পাঞ্জাবিটা নেই। ওটা নতুন মাস্টার পরেছে এখন। আর এই মাস্টারের আজ কতযুগ পর বেশ হালকা লাগছে। কিছুক্ষণ ঝরনার ধারে বসে থেকে স্নান করতে নামে মাস্টার। পুরনো মাস্টার। কত বছর পর আজ আবার ঝরনার জলে গা ডুবিয়ে মরা সাঁতারের মতো আরাম লাগে। হঠাৎ দেখে, জলের ওপারে বেশ খানিকটা দূরে বসে এক বৃদ্ধা। গায়ের রং কালো, হাসছেন অল্প, মাস্টারের দিকে তাকিয়ে। মাস্টার অস্থির হয়ে ওঠে, চিনতে পারে ওপারের বৃদ্ধাকে। এই এতগুলো বছর ধরে এই বৃদ্ধা বহুবার এসেছে মাস্টারের সামনে, কিন্তু ধরা যায়নি তাকে। মাস্টার আজ ধরতে চায়, ছুঁতে চায় তার হারিয়ে যাওয়া মা-কে। সাঁতার দেয় জোরে। মনে পড়ে না বয়স। সাঁতার বাড়ে। ঝরনার জলটা যেখানে এসে সবথেকে জোরে পড়ছে, ওখানে সবকিছুই ধোঁয়া মনে হয় এই আকাশভাঙা জ্যোৎস্নায়।
মাস্টার, মানে পুরনো মাস্টার যে আর নেই, এ-কথা কেউই বিশ্বাস করতে চাইছিল না। ওকে ঘরে ফেরাবে কে, এসব ভাবতে ভাবতে রাত নামে মনপেলিয়ায়। ট্রেনে করে একদল ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’ আসে। নতুন মাস্টার, মলিন সিল্কের সাদা পাঞ্জাবিটার হাতায় চোখের জল মুছে রান্না চড়ায়। আজ খিচুড়ি নয়। আলুপোস্ত।