কার্টুন: সাদিক হোসেন

Bengali Short Story: আসলে আমার কাছে শহর ব্যাপারটা স্মৃতি নয়। শহর মানে কতোগুলো বেনিয়ম করতে পারার স্বাধীনতা। আমি যদি কখনো সেই বেনিয়মগুলো, বদমাইশিগুলো আর প্রাকটিস করতে না পারি, তখন মনে হয়, এই শহরটা আর আমার রইল না।

আমাদের দেশ যত হিন্দুত্ববাদের দিকে হাঁটছিল, সাদিক ততই বন্ধুমহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। ছিপছিপে রোগা, সামনের দুটো দাঁত খরগোসের মতো উঁচু, ইংরাজি উচ্চারণ শুনলে মনে হবে এই দেশ কখনও ব্রিটিশরা শাসন করেনি- এরা সাধারণত কোথাওই পাত্তা পায় না- কিন্তু সাদিক, যেহেতু সে সাদিক, প্রতিদিন আমাদের আড্ডার বিষয়কে পাল্টে দিচ্ছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম সেই নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের। অথচ আমাদের তেমন কিছুই করার ছিল না। তার উদ্ভট যুক্তি, তর্ক আর তত্ত্বের প্রতি আমাদের যথেষ্ট অনীহা থাকলেও, কোনও এক জাদুবলে, আমরা সেসব তৎক্ষণাৎ খারিজ করতাম না। তাকে যথেষ্ট বলবার সুযোগ দেওয়া হত। আর সে পাকা খেলোয়াড়ের মতো সবকটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করত।

অর্ণব বেনারস থেকে ঘুরে এসে মুখ চুন করে বলল, শালারা সব ঐতিহাসিক ইমারতগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে। দুনিয়ার ওল্ডেস্ট লিভিং সিটি। আর ওরা এটাকে স্মার্ট সিটি বানাচ্ছে। ইতিহাস বলে আমাদের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

রাউলসে বসেছিলাম আমরা। প্রথম রাউন্ড বিয়ার চলছে। সঙ্গে ড্রাই চিলিচিকেন। তখনও সাদিক আসেনি। নিজের জনপ্রিয়তা অটুট রাখতে সে আজকাল একটু দেরিতেই আসে। সৌম্য বলল, সারা পৃথিবীতে ফ্যাসিস্টরা এটাই করেছে। ওরা ইতিহাসকে ধ্বংস করে। বই পোড়ায়। বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির কথা মনে নেই?

ওকে সমর্থন জানিয়ে আমরা বলছি, ঠিক, ঠিক... আর তখনই সাদিকের আবির্ভাব। এসেই বলল, আসলে ইতিহাস-টিতিহাস না। ওসব বাড়তি বোঝা।

আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, মানে!

ওয়েটারকে ইশারা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। সাদিকের জন্য বোতল এসেছে। সে চুমুক দিয়ে বলল, মানে খুব সোজা।

সেটাই তো জানতে চাইছি। কী?

একটুকরো চিকেন গালে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, একটা শহরকে কখন নিজের শহর মনে হয় জানিস?

সাদিক কোনদিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে আমরা বুঝতে পারছিলাম না। আমরা নিজেরাও ঘুঁটি সাজাচ্ছিলাম। অর্ণব বলল, যখন সেই শহরটার সঙ্গে একটা যৌথস্মৃতি গড়ে ওঠে।

এলা এতক্ষণ চুপ করেছিল। সে বলল, একদমই ঠিক। শহর মানে তো শুধু লোকজন না। শহর মানে সেই শহরের চিহ্নগুলোও। এই আজকে যদি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালটা ভেঙে ফেলা হয়। যে কারণ দেখিয়েই ভেঙে ফেলা হোক– ওটা আমাদের দু'শো বছরের দাসত্বের প্রতীক– নিশ্চয়ই তাই, সেটা নিয়ে তো কোনও দ্বিমত নেই– কিন্তু, ধরা যাক, কেউ যদি সেই কারণটা দেখিয়েই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভেঙে ফেলে- এই যে, রোজ বাসের জানলা থেকে দেখি সেখানে কত লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে, প্রেম করছে- এইগুলো তো আমাদের যৌথস্মৃতি... এই যৌথস্মৃতি ধ্বংস করে দিলে এই শহরটা কি আগের মতোই আমার শহর হিসেবে থাকবে?

এলা তার বক্তব্যটা শেষ করে আমাদের দিকে তাকাল। তার যুক্তিতে আমরা বেশ খুশি। চেক-মেট না করতে পারলেও সাদিকের ঘোড়াটা যে খাওয়া গেছে প্রথম চালেই– তাই বা কম কীসে!

সাদিক এলার দিকে তাকিয়ে হাসল। বোঝা যাচ্ছে, সে নিজেকে গুছিয়ে নেবার সুযোগ খুঁজছে। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বিয়ারে আয়েস করে চুমুক দিয়ে বলল, কলকাতাকে দেখলে তোদের মনে হয় না এটা কোনও পুরনো শহর না, একটা নির্মীয়মান শহর। চারদিকে কুৎসিত দেখতে সব বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে, ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে, যেন এই শহরটা আগে ছিলই না- সবে তৈরি হচ্ছে।

অর্ণব পাত্তা না দিয়ে বলল, সে তো বটেই। লুম্পেনদের হাতে ক্ষমতা থাকলে এই হয়।

সাদিক লুফে নিল কথাটা, মানে যে শহরটা এখনও তৈরি হতে পারেনি... এখনও একটা প্রসেসের মধ্যে রয়েছে... তারও কি যৌথস্মৃতি থাকতে পারে?

অর্ণব চুপ।

সৌম্য ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে ছয় মারল, ভাই কোনও শহরই ফিনিশড প্রোডাক্ট না। সব শহরই সবসময় তৈরি হতে থাকে। কিন্তু এই তৈরি হওয়ার প্রসেসটা যদি সেই শহরের ইতিহাসকে ধ্বংস করে হয়– তবে সমস্যাটা সেখানেই।

এবার কি সাদিকের মন্ত্রীকে গিলে নিলাম আমরা?

এলা চোখের ইশারা করল সৌম্যকে। অর্ণব এক চুমুকে গেলাসটা খালি করে ঠকাস করে রাখল টেবিলে।

সাদিক বলল, তোদের সঙ্গে আমার কোনও ফাইট নেই। কিন্তু...

এইভাবে বাক্য শুরু করা মানে সাদিক তার ছুপানো অস্ত্রটা বার করবে এবার। সে শুরু করল, আসলে আমার কাছে শহর ব্যাপারটা স্মৃতি নয়। শহর মানে কতগুলো বেনিয়ম করতে পারার স্বাধীনতা। আমি যদি কখনও সেই বেনিয়মগুলো, বদমাইশিগুলো আর প্রাকটিস করতে না পারি, তখন মনে হয়, এই শহরটা আর আমার রইল না।

অর্ণব আর সৌম্য সিগারেট খেতে বাইরে বেরিয়েছে। আমার পাশে এলা। এলার উল্টোদিকে সাদিক।

যেন আমি নেই, এইভাবে সে এলার দিকে তাকাল, সেদিন জিকোর বাড়ি থেকে ফেরার সময় কী হল জানিস? তোরা তো মৌলালির মোড়ে আমাকে নামিয়ে দিলি। লাস্ট ট্রেনের তখনও মিনিট ৪৫ বাকি। ঠিক করলাম হেঁটেই শিয়ালদা যাব। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। অত রাতে রাস্তাঘাটে তেমন লোকজন নেই। এদিকে পেটভর্তি মদ, পেচ্ছাপ পেয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে একটা বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সবে শুরু করেছি, যেন দেখতে পেলাম, গাছটার গুড়িতে সিঁদুর মাখানো, ডালে ডালে সুতো বাঁধা। বিশ্বাস করবি না, ভয়ের চোটে আমার নেশা কেটে গেছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, শালা কেউ দেখে ফেলেনি তো! দেখে ফেললে আমার অবস্থাও কি আখলাখের মতো হবে? তখনি বুঝলাম এই শহরটা আর আমার না। এইখানে তো কোনও ইমারত ভাঙা হয়নি সেইভাবে, কোনও বড়ো দাঙ্গাও বাধেনি ইদানিংকালে কিন্তু এই শহরটায় আমি বিদেশিদের মতো হয়ে গিয়েছি। আর কোনও বদমাইশি করতে পারব না। আর কোনও বেনিয়ম করতে পারব না। এত সচেতনভাবে কেউ নিজের শহরে থাকে নাকি!

অর্ণব আর সৌম্য যখন ফিরল, এলার চোখ ছলছল করছে, এলার হাত সাদিকের হাতের ভিতর। ওরা ইশারা করল, কী হয়েছে?

আমি পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা নীচু করে নিলাম।

সেদিন আর আড্ডা জমল না। সাদিককে টলিগঞ্জ প‍র্যন্ত ছেড়ে দিয়ে এলাম আমরা।

সাদিক হিন্দুত্ববাদীদের ভয় পায়। ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সে সারাক্ষণ রাগ দেখায় হিন্দুত্ববাদ বিরোধী লিবারালদের প্রতি। বিশেষত বামপন্থীরা তার চোখের বিষ। এদিকে তাকে কোনওভাবেই ইসলামিস্ট বলা যায় না। তবে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান কোনদিকে? আমাদের ধন্দ সে দিনে দিনে বাড়িয়েই তোলে। মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে সে কোনওদিকেই নয়। সে একজন স্ক্রাউন্ড্রেল!

১১ ডিসেম্বর সাদিকের জন্মদিন। সেই দিনটাতেই সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (২০১৯) পাশ হয়ে গেল পার্লামেন্টে। ভারতীয় মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার এটাই ছিল প্রথম আইনি পদক্ষেপ। যদিও সামাজিক ভাবে হয়ত প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই।

আমাদের মন খারাপ। সৌম্য আমার বাড়িতে এসেছে। বলল, ঋত্বিকের কোনও সিনেমা চালা।

এইসময় কী সিনেমা দেখা যায়? ভাবতে ভাবতে সে বলল, 'সুবর্ণরেখা'?

শেষে ঠিক হলো, 'কোমলগান্ধার' দেখব।

ওইপারেই আমার দেশের বাড়ি। ওই যে ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে, এত কাছে, অথচ কোনওদিন আমি ওখানে পৌঁছতে পারব না। ওটা বিদেশ। যখন তুমি বললে ওপারে কোথাও তোমার দেশের বাড়ি, তখন আমি কি করছিলাম জানো- নিজের বাড়িটা খুঁজে বার করবার চেষ্টা করছিলাম। কারণ কোথাও না ওই বাড়ি ঠিক আমার দেশের বাড়ি। যে রেললাইনটার উপরে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, কলকাতা থেকে ফেরার সময় ঠিক ওইখানেই ট্রেন থেকে নাবতাম। স্টিমারটায় দাঁড়িয়ে ওইপারে পৌঁছতাম। মা অপক্ষা করে থাকতেন। ওখানে দাঁড়িয়ে একটা মজার কথা মনে এলো, মনে হল, ওই রেললাইনটা তখন ছিল একটা যোগচিহ্ন। আর এখন কেমন যেন বিয়োগচিহ্ন হয়ে গেছে...

এরপর আর সহ্য করা যায় না। সৌম্য বলল, ফোন কর।

সাদিককে ফোন করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালাম। সৌম্য আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকল, শালা, মনে হচ্ছে বোম মেরে সবকিছু উড়িয়ে দিই। শালা এই দেশটা একটা শুয়োরের বাচ্চাদের দেশ হয়ে গেল।

সাদিক ঠান্ডা গলায় বলল, তাহলে তাই কর।

বোম মারার কথা বলছিস?

ধুর। সে সজোরে হেসে উঠল, শালা বোম মারবি কাকে? ভালো করে মাল খেয়ে গান-ফান গা। অর্ণব রয়েছে ওখানে?

নারে, ও আসেনি।

ওহ। তাহলে তো গিটার বাজানোর লোক নেই।

সরি রে...

সৌম্য ফোনটা কেটে সোফায় বসল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস?

কী?

মালটার থেকে কোনও রিঅ্যাকশান পাওয়া গেল না।

কী আর রিঅ্যাকশান দেবে? ব্যাপারটা বিচ্ছিরি হল। এতদিন অব্ধি আমিও ভাবছিলাম যতই বাতেলা ঝাড়ুক, এইরম আইন ওরা পাশ করাতে পারবে না। কিন্তু এখন তো দেখছি দেশটা সত্যিই গাধার গাঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে।

না রে... কী যেন ভেবে সৌম্য ফস করে সিগারেট জ্বালাল, কিন্তু মালটার কোনও রিঅ্যাকশান পেলাম না কেন? রাগ দেখাতে পারত। আমাকে গাল দিতে পারত। উল্টে ইয়ার্কি করতে শুরু করে দিল। শালা যেন সিএএ পাশ হয়ে যাওয়ায় খুশি হয়েছে। ওর যেন-কিছুই-হয়নি টাইপের হাবভাবের মধ্যে একধরনের ভিক্টিম কার্ড প্লে করার ব্যাপার ছিল।

কী বলছিস!

ভুল বললাম কিছু?

আমরা যা আশা করিনি, কলকাতা তাই করে দেখাল। সারা শহর উত্তাল হয়ে উঠল সিএএ প্রশ্নে। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো রাস্তায় নামল। নন্দীগ্রামের পর আবার একটা মহামিছিল দেখল কলকাতা। জায়গায় জায়গায় সমাবেশ, লিফলেট বিলি চলতে থাকল।

কিন্তু এইসবের মধ্যে কোথাও সাদিক নেই।

ইতোমধ্যে পার্ক সার্কাস ময়দানে মুসলিম মহিলারা শাহিনবাগের মতো করে ধরনায় বসেছেন। বোরখা পরা, সাধারণ গৃহবধূরা কোনও আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠছে- এই দৃশ্য আমরা প্রথম দেখলাম। বলা বাহুল্য, আমরা প্রায়দিন সন্ধেবেলা সেখানে হাজির থাকতাম। কলেজ-জীবনের অনেক বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যেত। পৃথিবীটা যেন আমাদের চোখের সামনে পাল্টে যাচ্ছে, আমরা বুঝতে পারছিলাম।

সেদিন কফিহাউস থেকে বেরিয়েছি। অবশ্যই পার্ক সার্কাসে যাব। ধ্যানবিন্দুতে দেখি এলা আর সাদিক দাঁড়িয়ে রয়েছে।

একটু মজা করেই বললাম, কীরে যাবি?

কোথায়?

আমাদের শাহিনবাগে।

সাদিক বিচ্ছিরিরকমভাবে হাসল, তোরা যা। ওখানে আমার গিয়ে কাজ নেই।

কাজ নেই মানে? এটা তো সিভিল সোসাইটির দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তুই কি সিভিল সোসাইটির অংশ নোস? কী মনে করিস তুই নিজেকে।

সাদিক বই বাছাই থামিয়ে আমার দিকে তাকাল, দ্যাখ তোদের সঙ্গে আমার কোনও ফাইট নেই... কিন্তু...

কিন্তু কী?

এইটা একটা বালের সিভিল মুভমেন্ট হচ্ছে।

মানে! আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম।

সাদিক বলল, কতগুলো মুসলিম মহিলা পার্ক সার্কাসের ময়দানে ধর্নায় বসেছে। কোথায় বসেছে? ময়দানে। কেন রাস্তা আটকে বসেনি? কারণ রাস্তা আটকালে তোদের মতো ভদ্দরলোকদের যাতায়াতে অসুবিধা হবে। আর তোরা সেখানে যাচ্ছিস কেন? কারণ এইরকম পোশাকের মহিলাদের তোরা আগে কোনোদিন ধর্না দিতে দেখিসনি। গিয়ে তোরা কী করছিস? বেলা-চাও গাইছিস। এইটা বালের মুভমেন্ট না? এই করে ফ্যাসিস্ট সরকারকে কোনওকিছুতে বাধ্য করা যায়? তোরা নিজেও জানিস এইসবের কোনও আউটকাম নেই। তবু যাচ্ছিস নিজেদের পাপবোধ ঢাকবার জন্য। শালা এর মধ্যে কে আবার ফেসবুকে লিখেছে ধর্নায় বসা মহিলাদের রাজনৈতিক পাঠ দেওয়া হবে। কী সার্কাস মাইরি। রাজনৈতিক পাঠ যদি তোদের থাকত তালে বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ট দল সরকারেই আসত না। একটা সাজেশন দিচ্ছি, পারলে করিস, সন্ধেবেলা ওখানে গিয়ে বেলা-চাও না গেয়ে যারা ধর্নায় বসেছে তাদের বাড়িতে যা, বাড়ির কাজকর্ম করে আয়, রান্না কর... বালের আমার সিভিল মুভমেন্ট!

তা সেই কাজটা তো তুই নিজেই করতে পারিস।

হ্যাঁ পারি। কিন্তু করব না। তোদের যাতে পাপস্খলন হয়– সেই সুযোগটা দিচ্ছি।

আমরা বুঝেছিলাম, ওর সঙ্গে তর্ক করা মানে সময় নষ্ট করা। কিন্তু অবাক হলাম এলাকে দেখে। সে পুরো ঘটনায় চুপ করে থাকল। সাদিকের পক্ষ নিল।

বাসে উঠে সৌম্য বলল, আমি আগেই বলেছিলাম।

এরপর শহর জুড়ে কুয়াশা নামল। লাল আর বেগুনি রং মেখে গাধার দল হাঁটতে শুরু করল ময়দানে। মনুমেন্টে ঝিকিমিকি আলো জ্বলল সন্ধেবেলা। ঘরের টিকটিকি ঢুকে গেল ঘড়ির আড়ালে।

ফেসবুকে আমরা তর্ক করছিলাম চাড্ডিদের সঙ্গে। আমাদের মেসেঞ্জার ভরে যাচ্ছিল গালাগাল আর থ্রেটে। ওদিকে সাদিককে দেখা গেল ডাব হাতে তাজপুরে ঘুরছে। সঙ্গে এলা। তার হাতে বিয়ারের বোতল।

অর্ণব বলল, আমি তো আগেই বলেছিলাম।

কিন্তু আমাদের চোখের সামনে সত্যিই দুনিয়াটা বদলে গেল। করোনা এলো। লকডাউন শুরু হল। মৃত্যুভয় আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। প্রতিবাদীরা নিজেদের চটি রেখে উঠে পড়ল শাহিনবাগ থেকে।

সেদিনের ঝগড়ার পর থেকে সাদিকের সঙ্গে কথা হয়নি। টিভিতে করোনা-জেহাদ প্রচার চলছে। এলাকে ফোন করলাম। এলাও যেতে রাজি। কিন্তু সে সাদিকের বাড়ি আগে কোনওদিন যায়নি। ওর বাড়িটা অর্ণব চেনে। কিন্তু যাব কীভাবে? সৌম্য বলল, আমার বাইক আছে। এলা তো স্কুটি চালায়।

মাঝখানে যদি পুলিশ ধরে?

ওদিকটায় পুলিশ ধরার কোনও চান্স নেই। আমাদের এখান থেকে বেরোনোর সময় কিছু না হলেই হল।

দুপুরের দিকে রওনা দিয়েছিলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা। মিনিট কুড়ির মধ্যে পৌঁছে গেলাম।

সাদিক আমাদের দেখে হেসে উঠল, এবার মুখোশগুলো খোল। আমাদের কারও করোনা হয়নি।

আমরা বসেছিলাম সাদিকের ঘরে। এলা চলে গেছিল ওর মায়ের কাছে, রান্নাঘরে। ফিরে এসে আচমকা সাদিককে থাপ্পড় মারল।

কী হয়েছে বোঝবার আগেই আরেকটা।

সাদিক নিজেই বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। সে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে।

এলা চেঁচিয়ে উঠল, শালা স্ক্রাউন্ড্রেল! এত বড় মিথ্যা বলতে তোর কিছুতে বাধল না?

অর্ণব বলল, হয়েছেটা কী?

ওকেই জিজ্ঞেস কর। এলা থপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।

আমরা সাদিকের দিকে তাকালাম। সাদিক মাথা নীচু করে বসে রয়েছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে এবার সে আসল কারণটা ধরতে পেরেছে।

অর্ণব এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দিয়েছিল এলার দিকে। এলা এক ঢোঁক জল খেয়ে বলল, হারামিটা আমাকে কী ঢপ দিয়েছিল জানিস? ওর বাপ নাকি ৯২-এর দাঙ্গায় মারা গেছে। ডাহা মিথ্যা। ওর বাপের আজকেই মৃত্যুদিন। মাসিমা বলল। হাঁপানির রুগী ছিল।

সাদিক উঠে এসে এলাকে বোঝাতে যাচ্ছিল। এলা আবার চড় কষাল, শালা তুই সারাক্ষণ ভিক্টিম কার্ড খেলে যাস কেন? তোর সমস্যাটা কোথায়? তোকে কোনওদিন আমরা আলাদাভাবে ট্রিট করেছি? তুই যেটা করলি, সেটাতে আসল ভিক্টিমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ছিঃ। আমার শালা নিজের উপরই ঘেন্না হচ্ছে।

মাসিমা চা নিয়ে এসেছে। এলা নিজেকে সামলে নিয়েছিল। মাসিমা চলে যেতে সাদিক বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

এলা চুপ।

সাদিক বলল, হ্যাঁ, ঢপ দিয়েছিলাম। কিন্তু ঢপ না দিলে তুই কি আমার প্রেমে পড়তিস?

মানে? এলা চমকে উঠল।

মানে যতটুকু আমরা সত্যিই ভিক্টিমাইজ হয়েছি, তোরা সেটাকে নর্মালাইজ করে নিয়েছিস। সেইটুকু দেখিয়ে আর তোদের কাছে পাওয়া যায় না। সেইজন্যই বাড়িয়ে বলা। যা হতে পারত কিন্তু হয়নি, সেইটাকেই আমি ব্যবহার করেছি। সত্যিই যদি আমার বাপের মৃত্যু নিয়ে গল্প না বানাতাম, তুই কি এত সহজে আমার প্রেমে পড়তিস? আমাদের প্রেমটা টিকবে না, তা আমি জানি। কিন্তু যেটুকু সময় আমি তোর সঙ্গে কাটাতে পেরেছি, তা তো ওই মিথ্যাটার জন্যই।

রাবিশ! অর্ণব বলল।

যাবার সময় এলা বলে গেল, পাক্কা হারামি।

এরপর সাদিকের সঙ্গে আর আমাদের বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। ফেসবুক মারফৎ জানতে পারলাম, সে বেঙ্গালুরুতে শিফট করেছে। এরপর এলাকে দেখা গেল তাজপুরে। সে ডাব ধরে আছে। সৌম্যর হাতে বিয়ারের বোতল।

সৌম্যকে ফোন করতে সে বলল, আমি তো আগেই বলেছিলাম।

অর্ণব আর এলাকে কনফারেন্সে নিয়েছিলাম। তারাও হেসে উঠল।

এলা আর সৌম্যর প্রেমটা বেশিদিন স্থায়ী হল না। তারা বিয়ে করতে চলেছে। একদিন ঠিক হল এলা আর সৌম্যকে নিয়ে খেতে যাব আমরা। যাকে বলে আইবুড়ো ভাত। ট্রিঙ্কাসের সামনে গিয়ে দেখি সাদিক দাঁত ক্যালাচ্ছে।

কিছু বলবার আগে নিজেই বলল, সাতদিনের জন্য এসেছি। এলা ফোন করে আসতে বলল। মনে হয় হেবি বদলা নেবে। আচ্ছা আমাকে কি খুন করে দিতে পারে?

তা পারে।

ট্রিঙ্কাসে আমরা খাচ্ছিলাম কম, ছড়াচ্ছিলাম বেশি। সাদিক বলল, আমার তরফ থেকে তোদের সবাইকে জ্যাক ড্যানিয়েল।

তিন রাউন্ড-চার রাউন্ডের পর হঠাৎ দেখতে পেলাম সাদিক টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে শিস দিচ্ছে। শিস দিতে দিতে প্যান্টের জিপার খুলছে। তার লিঙ্গ বেরিয়ে আসছে বাইরে। এখুনি খেলা শুরু হবে তাহলে?

আমি ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম।

ওরা চেঁচিয়ে উঠল, কী হয়েছে?

ফিরে দেখি সাদিক আগের মতোই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।

More Articles