তিরচিহ্ন: যশোধরা রায়চৌধুরী

Bengali Short Story: এক বছর আয়না দেখার সাহস পায়নি রুমা। ব্যান্ডেজের তলায় ঢাকা মুখটাকে অন্যের মুখ মনে হতো।

প্রচারগাড়ির কাছাকাছি আসুন, সব জিনিস পঁচিশ টাকা, পঁচিশ টাকা, পঁচিশ টাকা।

দরজা ঠেলে বাইরে আসতেই রুমা দেখল রোদ্দুর হিলিবিলি করছে, গাছের পাতা থেকে চুঁইয়ে মাটিতে নামছে, প্রচারগাড়ির লাল, বেগুনি, সবুজের ওপর ঝিলিক মারছে। মনটা এক মুহূর্তে নতুন কিছুর আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

চৌকাঠে একটা পা রাখল রুমা, আর, তারপরেই রাস্তায়। চৌকাঠের ওপর নাকি দাঁড়াতে নেই। দাঁড়ায় খালি পেত্নিরা আর অলক্ষ্মীরা। দাঁড়ায় হুরি আর পরিরা। দাঁড়ালে অমঙ্গল। দাঁড়ালে অপশগুন।

আরও পড়ুন: চন্দ্রবিন্দু ডট কম: অমৃতা ভট্টাচার্য 

হাতল ধরে পরখ করছিল প্লাস্টিকের ছুরিটা, রুমা। ধার কেমন হবে জানা নেই, স্টিলের পাতলা পাতটা আলোয় চকচকায়। কিন্তু গোলাপি বাঁটটাই ওকে খুব টানছিল। কিন্তু জালের ঝুড়িটাও ভারি দরকারি। অথবা ওই নীল চকরা বকরা কাজ করা পাপোশখানা। ওটাই নিলে হতো। একটাই পাকানো সরু পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে এতগুলো স্বপ্নকে কীভাবে কেনা সম্ভব, সেইটাই ও বুঝে উঠতে পারছিল না।

কাল টিউশনবাড়ি থেকে দেওয়া টাকাক'টার মধ্যে সবকটায় মায়ের আঁচলে বাঁধা হয়ে গেছে। শুধু এই একটা নোট কীভাবে যেন রয়ে গেছে রুমার চুন্নির গিঁটে।

কে এই রুমা? কেন সে এসেছে আমাদের গল্পে? কেন তার মা আছে ঘরের ভেতরে? রুমা কেন বেরিয়েছে দরজার কাছে, দরজার বাইরে? অবিবাহিতা বলে? না কি পা বেড়েছে বলে? বিয়ে না হওয়া রুমার বয়স কত? কেন সে ছুরি কিনবে? সবজি ছুলতে, সবজি কাটতে? না কি জিরি জিরি করে পেঁয়াজ কাটবে অথবা অসুস্থ বাবার জন্য ফল কাটবে, না কি অন্য কোনও দরকার তার ছুরির?

কিছু জানা নেই, তবু গল্পটা শুরু হয়ে গেল একটা দরজার সামনেই।

রেকর্ড করা আওয়াজটা একটা মেয়েছেলের গলার। সব প্রচারগাড়িতেই একই আওয়াজ। কোনও কোনও গাড়িতে কালো বক্স-ব্যাটারির সঙ্গে লাগানো চোঙা থেকে ঘষা ঘষা ভাঙা আওয়াজ বের হয়। যেন ভেতরে ব্যাং ডাকছে। ব্যাটারি কমে গেলে এসব হয়। গোঙাতে গোঙাতে অস্পষ্ট গলায় কে যেন বলে, যা নেবেন পঁচি-ই-ই-শ টাকা, যা নেবেন পঁচিই-ই-ইশ টাকা...

দূর দূর তক ছড়িয়ে পড়া আওয়াজে পিলপিল করে ছুটে আসবে বউ মেয়ে শিশু। কিশোরী। কাঁখে-কোলে সন্তানকে বা ভাইবোন নিয়ে। আওয়াজটা যেন এমন কথাই বলে।

আজকাল আসে না অবশ্য কেউ আওয়াজের মান ভাঙাতে। খুব কেউ আগ্রহ পায় না এসব জিনিসে, খুব দরকার ছাড়া। কত মজা আছে, তামাশা আছে অন্যত্র। খেলা আছে ফোনে ফোনে। সিনেমা-সিরিয়াল আছে। নতুন জিনিস তো আসে না প্রচার গাড়িতে। সেইসব ধামাকুলো পাপোশ, বালিশ, বালতি গামলা, ছুরি-কাঁচি।

রুমা বেরিয়েছিল বটে,  প্রচারগাড়ির কাছে এসে জিনিস নেড়েচেড়ে দেখছিল ও। হঠাৎই যেন ছ্যাঁকা খেল। জ্যান্ত বিজলির তার গায়ে লাগলে যেমনটা হয়।

ওধারে, রাস্তার ওপারে, একটা হেলে পড়া দোকানঘরের তেরপলের ছাউনির আলো আঁধারির ভেতর থেকে  কুতকুতে আর হিলহিলে চোখ রুমাকে বিঁধছিল। কালচে ঘেমো কপালে একটা রঙিন রুমালের ফেট্টি। চোখের খানিক নিচে, মোটা ফুলকো নাকের তলা থেকে বেরিয়ে, কতগুলি ছিরকুটে দাঁত। তরুণ মোহান্ত তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।

আর সেই দৃষ্টিটা যেন সারা গায়ে বিষপিঁপড়ে ছেড়ে দিয়েছে রুমার। ক্লাস টেন পাস রুমা, বাড়িতে দুটো ছোট ছোট বাচ্চাকে আর বোনকে ইংরেজি আর অঙ্ক কষানো রুমা। অতিরিক্ত সেলফি-আসক্তির জন্য যে রুমার ইলেভেনে ভর্তি হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বাবা।

পাতলা ছেঁড়া গেঞ্জি ফেরিওয়ালার সামনেই ছুরির বাঁট পরখ করছিল যে রুমা, জিনিসটা পত্রপাঠ রেখে দিয়ে ঘরে ফিরে এল সে। সশব্দে, তড়িঘড়ি ফিরেই প্রথমে একটানে পর্দাটা দিল। তারপর কয়েক সার ইটের ওপর পুরনো একটা দরজার কাঠের তক্তা ফেলে উঁচু করে করা চৌকিটার ওপরে চোখ হাতে চাপা দিয়ে বসে পড়ল।

কয়েক মুহূর্ত সমস্ত রক্ত মুখে এসে গেছে। তারপর মাথার ব্রহ্মরন্ধ্রে চড়ে গেছে। মাথায় গনগন করছে রাগ। ঘেন্না। এবার সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার দরজায় গেল রুমা। পর্দা সামান্য ফাঁক করে তাকাল বাইরের দিকে।ওই সাপের মতো চোখদুটো আর দেখতে পেল না। এবার খটাস করে বন্ধ হলো ঘাড় নামিয়ে ঢুকতে পারা সবুজ রং করা কাঠের দরজা। ছিটকিনি পড়ল সশব্দে। রংচটা শাড়িকাটা পর্দা দরজার খাঁজে আটকে রইল, যেভাবে দাঁতের মধ্যে আটকে যায় পালংশাকের ছিবড়ে।


বাবা বলেছে ইলেভেনে আর দূরের ইশকুলে যাবে না রুমা। মা লড়েছিল, বৃথাই। হায়ার সেকেন্ডারি ইশকুল সত্যিই অনেকটা দূর।

রুমা পড়বে না, ক্যান?

মেয়েটার পাখা গজাচ্ছে! দেখেও দেখো না? কী কর সারাদিন বাড়িতে বসে বসে? খাও আর পুষ্ট হও?

এক গরাস ভাত খাইলেই আমার অম্বল। জান না? তোমার রোজগারের ভাত আমি কতই খাই!

মা সরু, ভিতু আর নিচু গলায় কথাটা বলে, গলার ভেতরে ঘড়ঘড় করে কান্না। তারপর মা যোগ করে, ও ত পড়তে চায়। নিজের পড়া ঠিক করবে বল্যা টিউশন দেয়। টিউশনের টাকা ত এই সংসারেই ঢালে।

বারণ কর, ওই মেয়ের টাকা আমি ছুঁই না।

তোমার ত রিটায়ার হবার সময় আইব। দুই-দুইটা মেয়ে ঘাড়ে আছে। ল্যাখাপড়া না করাইলে চলব?

তাইলে মেয়েগুলানকে সামলাও না, চরিত্রটা মাজাঘষা কর আগে। ঘরেই ত থাকো, সামলাইতে পার না বইসা? মেয়েটার নামে নিন্দায় কান পাতা যায় না পাড়ায়। এত বাজে ছবি দিয়েছে কোথায় নাকি! কীসব বলে লোকে!

ছবি? কী ছবি? কাগজে ছাপিয়েছে?

আরে ধুর। কাগজে না। ফোনে। ফ্যাসবুক না কী বলে। দুইখান ভাত দাও, আর তরকারি দ্যাও আরেট্টু।

মা ঝুঁকে, পেটের ব্যথা চেপে বাবাকে বেড়ে দিল।

সে তো সবাইই করে। সব ঘরেই এখন ওই ফোন। তোমার সংসারে ত রুমার হাতে ওই ফোন দিবার মত টাকাও নাই।

খবরদার য্যান না দেখি, রুমা নিজের টিউশনের টাকা দিয়া স্মার্টফোন নিছে।

নিবে না। তোমার কথা মানে।

হু! কত মানে! আমার ফোন চুরি কইর‍্যা এইসব করে। তুমি আর লাই দিয়ো না তো মাইয়ারে। আমাদের মুখ পোড়াবে একদিন ওই মেয়ে। মানে মানে বিদায় করার লাগে।

বিদায় কর না। পাত্র ত দেখছিলে। বিয়া দিবা বললা তো।

ওই পাত্র কি মুখ দেইখ্যা বউ নিবে? টাকা দিতে হইবে। টাকা কি মাটির তলায় আলাদিনের সম্পদ কইর‍্যা পুঁইত্যা রাখছি? যে বিয়া দিম?

রুমার মা ঘরে থাকা, আষ্টেপৃষ্ঠে কাপড় দিয়ে মোড়া এক মহিলা। উদয়াস্ত কাজ করে করে, আর অবেলা করে  অসময়ে খেয়ে খেয়ে, থলথলে শরীর, অম্বলের আড্ডাখানা মায়ের পেটটা। বিপুল পেটের সঙ্গে মানানসই পা, হাতদু'টি ময়দামাখার মতো নরম বলে রুমা খুব ঘাঁটত।

এই সমস্ত মিলিয়ে মা আসলে আদর আর যত্নের পুঁটলি। পুঁটলিটা সারাদিন রাঁধে, আর ভাবে, জীবনে শান্তি পূজায় আর শীতে শান্তি মুজায়... এগিয়ে দেয় বরকে  গলার মাফলার আর চানের গামছা। দুই মেয়েকে ফিতে, কাঁটা, ক্লিপ এগিয়ে দেয়, আর তেল দিয়ে চুল বেঁধে দেয় রোজ সন্ধেতে... সেই মা, মা-ই তবু লড়তে পারত একমাত্র বাবার সঙ্গে। নিজের পড়ালিখা হয়নি বলেই পারত।

টাকা একটা বাঁচাইতে পার না, কী সংসার চালাও তুমি?  রুমার মা? এদ্দিন? মাছের টক দ্যাও দেখি।

বিয়া যদি না হয়, পড়াও না ক্যান? চাকরি করবে ।

থামো তুমি। মেয়েমানসের বুদ্ধি। চাকরি অতই সোজা। গাছের ফল! ঝাড়া দিলেই পড়বে।

বাবা জানত নিজে গোবরগণেশ বলে কোত্থাও উন্নতি হয়নি, মুখ ফুটে চায়নি বলে, অ্যাসোসিয়েশন করতে পারেনি বলে, দাবি জানাতে পারেনি বলে আজীবন দোকানের কেরানি হয়ে রয়ে গেছে। কোনওদিন যথোপযুক্ত সম্মান পায়নি। সেভাবে মাইনেও বাড়েনি।

অথচ বাড়িতে কত রাগ, চোপা করত। কেবল মাকে দুষত।

মা ছোটবেলা থেকে রুমার ভুরু এঁকেছে কাজললতা দিয়ে, আর নাকের দু'পাশে আঙুল ছুঁইয়ে, তেলমালিশ করে করে টিকালো করেছে শুধু। রূপটান দিয়ে দিয়ে মেয়েকে রূপসী করবে। রুমা রূপসী হয়ে উঠছিল সামান্য তেলে-জলেই। তার কোনও অন্য উপকরণ লাগছিল না। বয়সের গুণে আর বাতাসের দোষে মেয়েটা ফনফন করে সুন্দর হচ্ছিল।

মেয়েটা এও বুঝছিল, তার আরও কিছু চাই। শুধু রূপ আর দুটো আস্ত জামা, একটা চুন্নি, একটা ব্রেসিয়ারের বাইরে মেয়েটার চাহিদা বাড়ছিল। তার ইচ্ছে হচ্ছিল, সূর্যটার পাওয়ার কমিয়ে হাতে নিতে। ইচ্ছে হচ্ছিল পাশের মহল্লার কলেজে যাওয়া মেয়ের মতো গোলাপি স্কুটি চালিয়ে বাইরে যেতে। নিদেন কন্যাশ্রীর সাইকেল চালিয়ে ইশকুল যেতে।

বোন আর সে, রুমা আর সীমা দুই বোন দুটো সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, স্বপ্নে সে দেখতে পায়। সাদাতে সবুজ পাড় ক্লাস ইলেভেনের  শাড়ি আর চুলে সবুজ ফিতের কলাবিনুনি।

কিন্তু টেন পাশ করতেই বাবা তার পড়া বন্ধ করল। রেজাল্ট পাতে দেবার মতো হলো না। তলার দিকের সেকেন্ড ডিভিশন। তা তো হবেই। সবাই , যারা ভাল পাশ করে, তারা টিউশন পড়ে। সে কিছুই পায়নি।

কী জানি কী চাইত রুমা, কিন্তু তার বাইরে যেতে ইচ্ছে হতো খুব, ইচ্ছে হতো পাড়ার আর আর দু'-চারটে মেয়ের মতো কলেজ অবধি পড়ে, তারপর চাকরি করে। ইশকুলের দিদিমণির চাকরি করে। অথবা ছোট একটা আপিসের টাইপিস্ট। শহরে সেবার দেখেছিল যে রকম।

রুমা ভাবত, কিন্তু তার শরীর, বসন্তের হাওয়া পাওয়া তার ষোলো বছরের মন, তাকে ভুল দিকে পাঠাল।   বোধহয় বাবা তাকে আর পড়াতে সাহস পেল না পড়ায় ভালো ছিল না বলেই শুধু না। তার স্বভাবটা তাকে দিয়ে ভুল কাজ করিয়ে নিতে লাগল বলেই।

নিজের সাজ থামাতে পারেনি রুমা। সামান্য জিনিসে সেজে ফেলে। আর, নিজের নজরের আতর ঢেলে ঢেলে দু'পাশের মানুষকে রীতিমত নাস্তানাবুদ করে রাস্তা হাঁটে। বাজারে যায় মন্থর গতিতে। নিজের মাথার চারপাশে যেন একটা বলয় আলোর, অদৃশ্য সেই আলো। রুমা জানে। আর জানে, রুমার কী পরিমাণে অনুসরণকারী আর নিন্দুক দুই-ই জুটেছে।

তার চলার পথে রুমালে মুড়ে গোলাপ-পাপড়ি এসেছে, ইট-আধলায় সুতো জড়িয়ে চিঠি এসেছে ভুল বানানে। রুমার হাতের কাছে একটা ফোন এলেই তাতে রুমা নিজের গোলাপ-ঠোঁটের ছবি তুলে ফেলছে। সেসব কোথায় কোথায় দিতে হয় তাও সে জানে। একটাই ফোন আছে বাড়িতে ভদ্রসভ্য, সেইটে দিয়ে সব দিয়ে দেওয়া যায়।

পাড়ার বাচ্চা ছেলেগুলোকে সে লাট্টুর মতো ঘোরাতে পারত। চুলের ঢল নামিয়ে দিলে ভেবলে গিয়ে সবকটা উল্টে পড়ত, জানত সে। ভয়ের কিছু ছিল না। ভয় এল অন্য দিক থেকে।

তরুণ মোহান্ত। পাড়ায় ছোটখাট একটা মস্তান সে।

লোকটা কোনও কাজেই টিকতে পারে না। একেকদিন একেক রকমের ঘাটে ভেড়ে। যেখানেই যায়, তার মাতব্বরি বুদ্ধি, তার হাঁকাড় আর কুতকুতে চোখের চতুরতা নিয়ে সে হাসিল করে ছাড়ে কাজটা। এভাবেই ক্রমশ লোকের ভয়ভীতি পায়, মান্যগণ্য হয়ে দাঁড়ায়। লোকটা মোটাসোটা, গোলগাল, বয়স রুমার দ্বিগুণ।

তরুণ একবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল রুমাকে। ভেলপুরি আর ম্যাঙ্গো গোলা খাইয়েছিল, জোর করে তারপর ঘোড়ার গাড়ি চাপিয়েছিল। রাত অনেক হয়েছিল। তবে সেবার সঙ্গে অন্য লোক ছিল। তরুণের আরেক বন্ধু, সে রুমার পাড়ার আরেক মেয়েকে পটিয়েছিল, কলকাতায় ওদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও ওদের দু'জনেরই।

লতা সেই অশোকের কাঁধে ঢলে ঢলে পড়েছিল। রুমা তরুণের দিকে প্রচুর দম্ভ আর মেজাজ দেখিয়েছিল। নিজের দর রাখবে বলে, একবারের জন্যও তরুণকে নিজের কাঁধে বা পিঠে হাত রাখতে দেয়নি।

তরুণ চটেছিল। রূপ আছে মেনে নিল সে। কিন্তু এত গুমর রূপের? রুমা এটা ভালো করল না। ভেলপুরির পাতা চাটতে চাটতে তরুণ রুমার টাইট কামিজের দিকে তিরছা করে তাকিয়ে থাকল। রুমা উপেক্ষা করল। ভাল করে চুন্নি টেনে নিল। ফেরার পথে ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়ল লতা। রুমা ঘুমাল না। কিছু অচেনা লোকের চটচটে চোখের ভিড়ের ভেতর দিয়ে গিয়ে দরজার কাছে হ্যান্ডেল ধরে একলা হাওয়া খেতে লাগল। তরুণ আর অশোক বিরক্ত মুখ করে, ধমক দিয়ে,  রুমাকে ভেতরে গিয়ে চুপচাপ বসতে বলছিল। মেয়েরা যদি মেয়ের মতো শান্তশিষ্ট হয়ে না থাকে, লজ্জা-ভয় শরীরে কম থাকে, মেয়ে-মেয়ে লাগে না।

তোমার খুব গরম, না? মাথায় কি পোরা আছে? গোবর? ওই লোকগুলো সব বদবখাটে... যদি গায়ে হাত দিয়ে দিত?

রুমা ফট করে বলে দিল, তোমার চেয়ে বদ-বখাটে তো ওরা না!


তরুণ মোহান্ত এরপর থেকে রুমাকে নানাভাবে উত্যক্ত করতে লাগল। উড়ো চিঠি, ফোন... বারবার। যতবার রুমা 'না' বলল ততবার , তার চেয়েও বেশিবার। পাড়ায় রটিয়ে দিল তরুণ, কলকাতায় গিয়ে নাকি আসলে  রুমা তাকে আশিক বলে মেনেছে। এখন রংরেলিয়াঁ করছে।

তরুণের ছোঁয়া লেগেছে , সেই ভয়ে পাড়ায় অন্য ছেলেরা সুড়সুড় করে কেটে পড়ল। রুমার চারদিক ফাঁকা হয়ে গেল। এগারো-বারো ক্লাসে আর ইশকুল যেত না রুমা, কিন্তু বাড়িতে পড়তে চেয়েছিল, বাবা না করেনি। একটা মেয়ে টিউটর দিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞান খুব কঠিন লাগত। ইতিহাস-ভূগোল তবু বই মুখস্থ করে রুমা হয়তো পড়ে নিত। মন উড়ু উড়ু করলে নিজেকে নিজে স্কেল দিয়ে মারত। নিজেই নিজের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল ঘুরিয়ে ব্যথা দিত। নিজেকে শাস্তি দিতে শুরু করেছিল রুমা।

কেন ভাল করে পড়িনি। কেন ছেলেদের নাচিয়েছিলাম। কেন সাজতাম। কেন স্মার্ট হতে মন হয়েছিল । এই তরুণটা ঘাড়ে এসে চাপল।

প্রচারগাড়ির কাছ থেকে সরে এসে রুমা আজও এইসবই ভাবল। আবার উল্টোদিকের চায়ের দোকানে ঠেক গেড়েছে তরুণ। পরপর কয়েকদিন হলো। গা শিরশির করে। ভাল না লাগার এই অনুভূতি যে কোনও মেয়ে জানে। রুমা গল্পে, উপন্যাসে, সিনেমায় দেখেছিল, ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে ছেড়ছাড় করে। মেয়েরা প্রথমে 'না না' বলে। তারপর ছেলেটার একটানা লেগে থাকার জোরে, একনিষ্ঠ প্রেমের তোড়ে, মেয়েটা ছেলেটার প্রেমেও পড়ে। মেয়েটার লাল লাল গাল, কালো কালো আঁখে- এইসবের স্তুতি করে ছেলেটা। আর বলে, তুই আমাকে ভালো না বেসে যাবি কোথায়।

তখন মেয়েদের মনের মধ্যে লাড্ডু ফোটে। প্রেমের লাড্ডু। তাদের গা শিরশির, গা ভারি। চোখের পাতা বুজে আসা আবেশ। কত না আবেগ।

রুমা নিজের চৌকির ওপর বসে দু'হাতে পায়ে বেড় দেয়, ক্রমশ গুটিয়ে আসে নিজের ভেতরে। তার শরীর খারাপ লাগছে। তার এই গা-ঘিনঘিন ওইসব মধুর আবেশের থেকে  কত কত কত মাইল দূর। ওইসব নায়িকাদের চেয়ে কত বেশি দূর। প্রেমের উল্টোদিকে, আছে ঘৃণা। সে তরুণের ওই লোভী হাতদুটো দুমড়ে সরিয়ে দিতে চায়। নিজের কল্পনায়।


বেরত না যদিও রুমা। বেশি বেরত না। তবু ত যেত। টিউশনির দিদি সীমাদি ডাকল। আয়। বেশ ক'টা  পুরনো মানেবই পেয়েছি। পলিটিক‍্যাল সায়েন্স। কোশ্চেন ব্যাঙ্ক। পড়তে তো হবে পরীক্ষা প্রাইভেটে দিলেও। আজ শরীর ঢিশঢিশ করছে রে। বেরতে পারছি না।

পুরনো বাতিল যন্ত্রপাতি-ভরা খালি কারখানার পাশ দিয়ে, চওড়া করে গাঁথা দেওয়ালের গা দিয়ে। সরু গলি। পেচ্ছাপের গন্ধ। আধা-আঁধারি। শুনশান পথ। পিছন থেকে এসেছিল হাতটা। তার পিঠে একটা গরম কিছু এসে ঠেকল। এক মুহূর্তে যেন পিঠটা দাউ দাউ  জ্বলছিল। চমকে পিছু ফিরে তাকিয়েছে যেই রুমা, এক ঝলক আগুন এসে মুখের ওপর পড়ল।

গায়ে-মুখে ভুশো রঙ, চাদরমুড়ি দেওয়া লোকটা কে ছিল, ভাবার মওকা পায়নি রুমা। যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে সে লুটিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। নাক-মুখ বেয়ে যন্ত্রণার স্রোত। আগুনের লকলকানি। গলিয়ে দিতে লাগল, ফটাফট ফাটিয়ে দিতে লাগল রুমার নাক, একটা চোখ।

খুঁজতে বেরিয়েছিল রুমার বাবা রুমার বোনকে নিয়ে। সীমার বাড়ি যাওয়ার কথা মা জানত... শর্টকাট কারখানার পাশের রাস্তায়, তাও জানত বোন। বাবা খুঁজে পেয়ে রুমাকে কোলপাঁজা করে তুলে টোটো ডেকে হেলথ সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে সাইকেল-ভ্যানে কলার পাতায় শুইয়ে সদরের হাসপাতালে। পিঠে গলগল করছে মাংস। সালফিউরিক অ্যাসিডের ঢালাইয়ের রাস্তা জুড়ে মুখের ক্ষতবিক্ষত চামড়ার উপরিতলে একটা গলিত, লাল মাংসের থকথকে অংশের তলায় হাড় দেখা যাচ্ছিল।

তিন দিন পরে সমস্ত রক্তস্রোতে ওষুধের কলরোল বইছিল রুমার। ঠান্ডা, মৃত, অবশ একটা দিন। চেতনায় এসে সে তাকাল। একটা চোখ দিয়ে। হাত-নাক-গলায় নল লাগানো রুমার একটা চোখে যেটুকু দৃষ্টি, ও দেখতে পাচ্ছিল মায়ের মুখ। বোনের মুখ। ব্যান্ডেজ বদলাতে আসা সন্ত্রস্ত, ভীত হাউজস্টাফের মুখ। তুবড়ে বেঁকে যাচ্ছে মুখগুলো। ওর ব্যান্ডেজ বদলাতে এসে ভেঙে ভেঙে পড়ছে সেইসব মুখ। ঠোঁট-দাঁত দিয়ে কামড়ে , কোনওমতে উদ্গত বমি, গলা দিয়ে উঠে আসা কান্না আর টক জল সামলাচ্ছে ওরা।

নার্স আসত না ওর কাছে। ঘেন্নায়, ভয়ে। মুখপুড়ি মেয়েটার কথা পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। কী ঘেন্না, কী লজ্জা, মুখ শুধু নিজে পোড়াল না রুমা, সমাজে ওদের বাসই প্রায় উঠিয়ে দিল যেন। বাবা মাথা ঠুকেছিল ঘরের দেওয়ালে। খাটের ছত্রীতে। বোন নীল হয়ে গিয়েছিল কাঁদতে কাঁদতে।

দিদি যে বড্ড সেলফি তুলতে ভালবাসে গোও। দিদি বাবার ফোনখানা টেনে টেনে কেবল মুখ টিপে হেসে হেসে সেলফি তুলেছে গত কয়েকবছর। দিদি যে বড্ড সুন্দর গো।

মা শুধু কাঁদল না। চিরদিনের নরমসরম, গোবরের তালের মতো মা। নিচু আর ভিতু ভিতু গলায় বাবার সঙ্গে কথা বলা মা। মা শুধু চুপ থাকল। আর মেয়ের পাশে বসে রইল ঠায়।

ছোট্ট রুমাকে ভুরু এঁকে দিত কাজললতা দিয়ে মা। তেলহাত করে নাক টেনে টেনে তুলত। মালিশ করে রূপটান দিয়ে দিয়ে মেয়ের নাক-মুখ সব পুতুলের মতো, রাজকন্যার মতো, পটের বিবির মতো করতে চাইত। সেই মা, নার্সের থেকে গজ, তুলো, ওষুধের পোঁটলা নিয়ে নিল টেনে।

আমি করুম মাইয়াটার ড্র্যাসিং। দ্যান দেখি।

ডাক্তার হাড় বেরিয়ে আসা মুখে তিনটে সার্জারি করেছিল। সার্জারিতে গিয়ে ওটি-তে থাকতে পারেনি। গা-বমি লেগেছে, বেরিয়ে এসেছে দুটো হাউজস্টাফ। অজ্ঞানমতো হয়ে গেছে নার্ভ ফেল করে। সাতদিনে তিনটে প্লাস্টিক সার্জারির পর, একটা চামড়ার পর্দা দিয়ে গোলাপি হয়ে গলে যাওয়া মাংস ঢেকে দেওয়ার পরও সেলাই ফেটে গেছে।

আবারও সেলাই দিতে হয়েছে।

তারপর তো ড্রেসিং। মা সেই ড্রেসিং নিজে শিখে নিল। রোজ যেভাবে পুজোর আসনে বসে নিপুণ শান্ত, ধীর হাতে ঠাকুরের জামা বদলে দেয়, শয়ন দেওয়া ঠাকুরকে উঠিয়ে বসায়, পোঁছে আসনের চারপাশ, নিকিয়ে দেয় উঠোন... সেইভাবে ধীর হাতে রুমার মুখের প্রতিটি ঘা মা ওষুধ তুলো দিয়ে দিয়ে বুলিয়ে দিত। রক্ত ফুঁপিয়ে ওঠা প্রতিটি শিরা-উপশিরায় উপশমের হাত রাখত। আঙুল রাখত।

Illustration

গ্রাফিক্স: দীপ হাওলাদার


সীমাদিই কি বলে দিয়েছিল তরুণকে, রুমা যাবে সীমার বাড়ি? কোশ্চেন ব্যাঙ্ক নিতে?

রুমার মনটাই এখন একটা কোশ্চেন ব্যাঙ্ক হয়ে গেছে।

এক বছর আয়না দেখার সাহস পায়নি রুমা। ব্যান্ডেজের তলায় ঢাকা মুখটাকে অন্যের মুখ মনে হতো। তার ব্যান্ডেজখোলা মুখ দেখে পতন ও মূর্চ্ছার ঘটনাও কিছু কম তো ছিল না। একবছর পর জোর করে আয়না দেখেছিল, আর বুকের মধ্যেটা বসে গিয়েছিল। নিজের মুখটাকে সবচেয়ে খারাপ, কতটা খারাপ হতে পারে, এইসব যা যা এদ্দিন ধরে কল্পনা করেছিল, তার চেয়েও সেদিন বীভৎস লেগেছিল নিজেকে। আর ফুঁড়ে উঠেছিল একটা রাগ। মাথা ফুঁড়ে, সমস্ত শরীর ফুঁড়ে।

বাবা, তার বাড়িতে চোপা করা, কিন্তু বাইরে মুখ গুঁজড়ে কাজ করে যাওয়া কেরানি বাবা পুলিশে গিয়েছিল পা ঘষে ঘষে। ফিরেও এসেছিল। কতবার যাবে আর আসবে। জুতোর শুকতলা কার অত পুরু। শুধু জুতো কেন। গায়ের চামড়াও পুরু হতে হবে তো। এই এক বছরে তার ফাইল এক ইঞ্চিও এগোয়নি। কিন্তু যেদিন আয়না দেখে নিল রুমা, সেদিন থেকে ও আক্রোশ চেপে রাখেনি। বলেছিল, আমি ওই শয়তানকে জেলে পুরবই বাবা! পুলিশের কাছে আমি নিজেই যাব, যাব না কেন?

ও তো বেপাত্তা হয়ে গেছে রে। ফেরার। আর, তোর বয়ানে ত মুখ দেখেছিস বলে লেখা নাই।

এনজিও ধরো বাবা। কেস লড়ার লোক থাকে, সদরে গেলে পাবে।

দালাল ধরেছি আমি... সেদিন বাবা হার স্বীকার করেছিল ওর কাছে। দালাল বলেছে কমপেনসেশন আছে, পাইয়ে দেবে। ঘরের সব সোনাদানা বাঁধা দিয়ে তোর চিকিচ্ছে করাচ্ছি মা। আর কিছু পারিনি রে... হাউ হাউ করে কেঁদেছিল বাবা শিশুর মতন। যেন বাবার নিজেরই ঘাট হয়ে গেছে মেয়েকে রক্ষা করতে না পেরে। ওই যে দুষেছিল বাবা মেয়ের রূপকে, আঠারো বছরের চঞ্চল মনকে। এ-ডালে ও-ডালে ফুড়ুৎ করে বসা, ওড়াকে। আজ যেন সবটা ঘুরে এসে বাবার ওপর শোধ তুলছিল। ভেঙে গেছিল লোকটা । শিরদাঁড়া দু'-টুকরো । 

একদিন পুলিশের থেকে ফিরে শুধু নিজের স্ত্রীকে বলেছিল, আর কোনও দিন দিব্য ঠাকুরের আশ্রমে যাবা না।

তরুণ মোহান্তকে জেলে পুরতে পারল না রুমা। বেশ ক'টা বছর কেটে গেছিল। কমপেনসেশন পাবি, দালাল ধরা। কাজ হাসিল করে দেবে উজিয়ে এসে পড়া উকিল আত্মীয়। মাতাল বলে কান্তিজেঠুর পরিবারে খ্যাতি ছিল। কমবয়সি বউরা ওই উকিল ভাশুরের কাছে এক গ্লাস জল নিয়ে যেতেও ঠকঠক কাঁপত। সেই শেষে পরিত্রাতা সেজে এল তাদের বাড়িতে। মাকে, বাবাকে বোঝাল। দালাল জুটিয়ে দিল। তিন লাখ টাকা পেতে চার বছর ঘুরল। কিন্তু পেল।

তারপরও, তরুণ মোহান্তকে জেলে পোরা ছাড়া রুমার কোন সাধ-স্বপ্ন আর ছিল না। সে শুধু জানত, পুলিশ প্রমাণ চায়, আর সে প্রমাণ দিতে পারছে না। সে গাধার মতো তরুণের সবকটা প্রেমের এসএমএস মুছে দিয়েছিল। সব ভালবাসার কথা ডিলিট করেছিল। প্রমাণ না রাখার জন্য কেস জমাতে পারেনি রুমা।

এতগুলো বছর ধরে সূর্য উঠছিল, চাঁদ ডুবছিল, ঘণ্টা ধরে ধরে দিন-রাত হচ্ছিল। শীতে চামড়া শুকোচ্ছিল। দুপুরের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসে লুডো খেলতে খেলতে আর হি হি হাসতে হাসতে টান ধরা চামড়ায় বোরোলিন  ক্রিম মাখছিল মেয়েরা। গরমে হুসহাস করে মোড়ের মাথায় ফুচকা খাচ্ছিল।

রুমা কালো রঙের চুন্নি দিয়ে মুখ-মাথা ঢেকে ঘরে থাকছিল। সে জানে, সে বেরলে , মোড় অবধি মহল্লায় হেঁটে গেলে, রোদে পাতা খাটিয়ায় লাল, নীল, সবুজ লেপ-তোষক আর মেয়েদের মধ্যে গেলে, সমস্ত হাসি-মশকরা মস্ত বড় এক চুপের মধ্যে ঢেকে যাবে। রঙিন বাতাসে কে যেন কালি ঢেলে দেবে। মুখে কাপড়ের খুঁট দিয়ে মেয়েরা মুখ ঘুরিয়ে নেবে, উঠে ঘরে চলে যাবে। চোখগুলো অন্ধকার হয়ে আসবে। তারপর তীক্ষ্ণ হয়ে ঘৃণার রূপ নেবে।

কী বেহায়া মেয়ে গা, মুখ পুড়িয়েও শান্তি নেই। বাইরে এরা বেরোয় কোন সাহসে।

হাসপাতালে গিয়ে মা যখন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত, আর বাবা দু'-তিন দিন অন্তর মায়ের আর রুমার কাপড়চোপড় ডোরাকাটা প্লাস্টিকের সুতোয় বোনা বাজারের ব্যাগে করে দিয়ে আসত, ময়লা জামাকাপড় তুলে আনত... সেই দীর্ঘ একটা সময়েই রুমা জেনে গিয়েছিল, সে যেখানে গিয়ে পড়বে, সেখানেই শীতের হাওয়া বইবে আর সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসবে। রূপকথার গল্পের পেত্নি বা ডাইনি যেমন যেখানে যায়, মানুষ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। একবার খাবার আনতে চলে গিয়েছিল বলে আয়াদিদিরা দূর দূর ছাই ছাই করে ওকে তাড়িয়েছিল। একটা পোয়াতি মা নাকি ওর ব্যান্ডেজবাঁধা মুখ আর হালচষা জমির মতো গলা, পিঠ, ঘাড় দেখে ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। পেটের ছা-টা যায় যায় আর কী।

কোথাও যাবি না তুই, আমার মাথার দিব্যি। মা বলেছিল। আমি খাবার এনে দেব তোকে। মাকে তো  শেষদিকে সংসারের টানে বাড়িও ফিরতে হতো। ক'দিন আর হাসপাতালে পড়ে থাকবে। সকাল-বিকেল শুধু অ্যালুমিনিয়ামের ডিবে করে এনে ভাত-ডাল-তরকারি খাইয়ে যেত মেয়েকে। এত দূর, বাসে করে এতগুলো স্টপ। কিন্তু খাওয়াতে তো হবে। আয়ারা তো ওকে খাবার দিতে আসবে না। ঘেন্নায়।

পাড়াতেও মেয়েরা মুখ ছোটাত, মুখপোড়া মেয়েটা সারা পাড়ার গায়েই কালো ছাপ্পা মেরে দিয়েছে। কুলকলঙ্কিনী।

তাই , বছর গড়াচ্ছিল কিন্তু রুমা বেরল না। কোথাও গেল না। কিন্তু তারপর, চার বছর পর একদিন ও বেরিয়েও পড়েছিল। পাড়া পেরিয়ে রাস্তায়, গলি পেরিয়ে বাসরাস্তায়।

আর সেদিন ও জানতে পেরেছিল, তরুণ মোহান্ত আসলে মস্ত বড় খেলা খেলে নিয়েছে। এরই ভেতরে দিব্য ঠাকুরের আশ্রমে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছে সে।


এ-অঞ্চলে দিব্য ঠাকুরের খুব রমরমা। বছরে তিন-চারটে ভান্ডারা, শীতকালে মস্ত উৎসব সাতদিন ধরে । কীর্তন, নামগান। শীতের রাত্রিতে দূর দূর অবধি ছড়িয়ে পড়ে সারারাত্রিব্যাপী নামসংকীর্তনের ঝমক ঝমক শ্রীখোল আর করতাল-সহ চড়া সুরের গায়কের গলা, দোহারের দোহাই। গানের সুরে ঘুম জড়িয়ে ধরে আরও, কাঁথা গায়ে টেনে নিতে ইচ্ছে করে কুয়াশাভরা রাতে।

সমস্তদিন ভক্তরা আসে দূরান্ত থেকে ট্রেনে, বাসে চেপে। বাংলাজোড়া ভক্তদল। কত টাকা প্রণামী পড়ে, কত হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি ভোগ রাঁধা হয়।

মোহান্ত পরিবারের ছেলে তরুণ। এ-ঘাটে, ও-ঘাটে, এই নেতা, ওই নেতার দোরে চক্কর কাটার পর সে আরেকটু হলেই বিবাগী হয়ে যাচ্ছিল। মধ্যে একটা খুচরো পাপ করে ফেলল, ইন্দ্রিয় বশে রাখতে পারল না। একটু ভুল হয়ে গেল তার। একটা মেয়েকে খুব চেয়ে ফেলল। পাপিষ্ঠাটা তাকে মজিয়েছিল। কথায় বলে, নারী নরকের দ্বার। কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগনীয়। সে কাম ধারণ করতে শেখেনি তাই এক বোতল সালফিউরিক অ্যাসিড নিয়ে অন্ধকার নির্জন পথে মেয়েটাকে ফলো করে নিজের ভেতরের জ্বালা যেন বাইরে উজাড় করে এসেছিল সেদিন। তারপর বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল বছরখানেকের জন্য।

এমনিতেও সাক্ষ্যপ্রমাণটমান নেই কিছু। কেউ কিছু বলতও না। তরুণের দাপট ভালোই ছিল। তবে তরুণ ফিরে এল পরিবারের টানেই, আর ভেতরের গভীর অনুশোচনায়।

আশ্রমে সেবাইতের কাজটা তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। টিকা-ফোঁটা কেটে গেরুয়া পরে নিল তরুণ। লোকে বলল, দেখো কী পরিবর্তন, কত পাপী তাপী এইভাবেই তরে যায়! মনের পরিবর্তনেই তো পাপীর সবচেয়ে বড় ক্ষমা। ঈশ্বর টেনেছেন, তাই তরিয়েছেন।

মন্দিরে আর যেত না শুধু এই পরিবার। বাকিরা যেত। লাইন করে প্রচুর কাজু-কিশমিশ দেওয়া ভোগের পোলাও নিত শালপাতায় করে।

রুমার মা ঠাকুরের আসনেও আর বসত না গলায় ঘোমটা টেনে। কেমন যেন হ্যালহেলে হয়ে গেছিল মা। রুমার মুখটাকে ড্রেসিং করত খালি, পরে স্বপ্ন দেখত আরও টাকা আর আরও অপারেশনে মেয়ে একদম ঠিক হয়ে গেছে।

এনজিও-র দিদিমণি সরকারের একটা স্কিম পাইয়ে দেবে বলেছিল। রুমা হাঁটছিল স্টেশনের দিকে। মুখের ওপর পাতলা চুন্নি ফেলেই হাঁটে। চুল আঁচড়ায়, মন দিয়ে শ্যাম্পু করে। আড়াল করে চুল দিয়েও মুখের অর্ধেক। তারপরও যখন লোকে কুষ্ঠরোগীর মতো তাকে এড়ায়, দূরে সরে বসে ড্যাবড্যাব করে তাকায়, হাসি পায় রুমার। একটা বুকফাটা বিশ্রী হাসি উঠে আসে ওর ভেতর দুমড়ে। ও ট্রেনে লেডিজ কম্পার্টমেন্টে ওঠে, কিন্তু সিটের দিকে আর যায়না, দরজার কাছে হ্যান্ডেল ধরে হাওয়া খায় আর পেয়ারাওয়ালিদের ক্যাঁচাল শোনে।

স্টেশনে পায় রাখতেই সামনে একেবারে মুখোমুখি হয়ে গেল আজ। আর দু'জনেই ক্ষণেকের জন্য স্থির হয়ে গেল। কী করবে না বুঝে কয়েক মুহূর্তের স্তম্ভিত ভাব। পাথর হয়ে গেছে যেন পা-দুটো।

কপালে তিলক কাটা তরুণ মোহান্ত। সারা গা চামড়ার তলার স্নেহপদার্থের সিঞ্চনে চকচকে, তৈলাক্ত, টুশটুশে। হট করে হাঁটতে গিয়ে সামনে পড়ে গিয়ে হকচকাল তরুণই বেশি। আর রুমা?

রুমার মাথায় বাজ পড়ল। তারপর তরুণের করুণ মুখ, আর্দ্র হয়ে ওঠা চোখ, নামিয়ে নেওয়া দ্রুত দৃষ্টি সবটাই ওর মনের মধ্যে আস্তে আস্তে গেল। যেভাবে হাসপাতালে ওষুধ গিয়েছিল। বাজ পড়ার শক ধীরে নেমে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে। বদলে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের একটা ভাব এল। ঠোঁটের কোণে উঠে এল একটা হাসি।

তরুণ তার সামনে থেকে সরে গেল অনেক চেষ্টায় আর কষ্টে, সরি, তোকে অনেকদিন দেখিনি এদিকে... আমি... আমি... খুব কষ্ট পেইছি, জানিস... তুতলিয়ে হড়বড় করে কীসব বলল তরুণ।

তারপর প্রায় চলন্ত ট্রেনে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।

রুমা নিঃশ্বাসের তলায় বলছিল, তোকে আমি জেলে পুরতে পারিনি কিন্তু আমার লড়াই থামছে না রে, কুত্তা।

চারিপাশে লোকের ভিড়, জিলিপির ঠোঙা নিয়ে ছাত্রছাত্রীর হা হা হুল্লোড়। আর মুড়িওয়ালার সঙ্গে তক্কো।

রুমা নিজেকে খুব শান্ত করে আস্তে আস্তে ট্রেনে উঠল।

আবার টিউশন শুরু করেছিল। অল্প কয়েকহাজার টাকা সে জমিয়েছিল এসব করেই। আজ, প্রথম শহরের বড় দোকানে, সে এতটুকু না ঘাবড়ে ঢুকে গেল। স্মার্টফোন কিনল।

একরাশ জমাট অন্ধকার থেকেই আলো বেরিয়ে আসে। এনজিও-র প্রতিমাদি প্রায়ই বলে। মানেটা বোঝেনি এতদিন।

রাতে, গোলাপি সালোয়ার-কামিজ পরে, ক্যামেরা সেলফি মোডে রেখে রুমা ঘুরে ঘুরে নাচল। ছিপছিপে, হিলহিলে গড়নের ওপর পিছলে গেল মাথার ওপরের ডুম থেকে ছড়ানো আলো।

ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করে দিল রুমা। একটা চটুল গানের কলির সঙ্গে মিলিয়ে।

এরপর পাড়ায় যারা গালি দিত, তারা ওকে ভয় পাবে। যারা ওই ভিডিও দেখবে, তারাও ভয় পাবে। ওর সাহস একটা চোখে তিরচিহ্নের মতো ফুটে বেরিয়েছে এই ভিডিওতে, আর সেটাই ঘুরে যায় যেন, তরুণ আর বাকি সবক'টা ভিতুর বাচ্চার দিকে।

More Articles