ভাষার মারপ্যাঁচে গলদঘর্ম বাঙালির! জানেন কি চেয়ার-টেবিলের বাংলা প্রতিশব্দ?
Bengali Language : ইংরেজির দাপটে হারাচ্ছে প্রকৃত বাংলা শব্দ
ধরা যাক আপনাকে কেউ বলল, মেজ থেকে অমুক বইটা এনে দিতে, তবে হয়তো আপনার অবস্থা হবে খানিক অপ্রস্তুত। খানিক অন্ধের মতো হাতড়ে মরা ছাড়া উপায় তো নেই! এবার ধরুন কেউ বললো, কুর্সিতে গিয়ে বসতে। ব্যাস আবারও পড়লেন মহা বিপদে। সারা বাড়িতে একটা কুর্সি কোথায় মিলবে তা খুঁজতে গিয়ে অনেকখানি ঘাম ঝরিয়ে ফেললেও কুর্সির তো দেখা নেই। অথচ প্রশ্নকর্তা বারবার বলছেন সামনেই আছে! হ্যাঁ ঠিকই বলছেন প্রশ্ন কর্তা। আমার আপনার বাড়িতে একেবারে চোখের সামনেই রয়েছে মেজ আর কুর্সি। কেবল আজকের বাঙালিদের কাছে সেসব অধরা। অথচ ইংরেজি প্রতিশব্দ বললেই কপাল চাপড়ে বলবেন হয়তো, ‘ইস!’
কী খুব জানতে ইচ্ছে করছে তো নামগুলো? ধাঁধার উত্তর খুবই সহজ। যে বইটা আপনাকে আনতে বলা হয়েছিল সেটি রয়েছে ঘরের টেবিলে আর আপনাকে বসতে বলা হয়েছিল চেয়ারে। শুধু একটু বাংলায় বলা হয়েছিল এই যা! তাতেই গলদঘর্ম অবস্থা। চেয়ার আর টেবিল শব্দ দুটি ইংরেজি হলেও এমনভাবেই বাংলা অভ্যাসে জাঁকিয়ে বসেছে যে তার দাপটে মুখ লুকিয়েছে খোদ বাংলা অভিধান। চেয়ারের ওপর একটি বাংলা প্রতিশব্দ হল কেদারা, যদিও সেটি কালেভদ্রে ব্যবহার করেন কেউ কেউ তবে কুর্সি আর মেজ শব্দদুটো একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে চিরাচরিত অভ্যাস থেকে।
বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে বাংলার নম্বরটা কম দেখে ছাত্রের মা হঠাৎ এক গুরুতর প্রশ্ন করে বসলেন, “স্কুলে কেন বেঙ্গলিটা পড়ায় না ইংলিশে?” - কবি অপূর্ব দত্তের ‘বাংলা টাংলা’ কবিতার এই শেষ পংক্তিটি যেন আজকের সময়ের এক জীবন্ত দলিল। সময়ের স্রোতে ধাক্কা খেতে খেতে আমরা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যে সময়ে এ প্রশ্ন মোটেই আর অবাক করায় না আমাদের! পথে-ঘাটে এখন ইংরেজি বলাই দস্তুর। ‘ইংরেজি সুইট, সাইন্টিফিক’, একথা মনে করেন অভিভাবকরাও। সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করাতে না পারলে জীবন তো বৃথা! তাই ছোট থেকে ইংরেজি গেঁথে দেওয়া হচ্ছে মর্মে মর্মে। কিন্তু এসবের মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছে অনেকে। অনেক অনেক বাংলা শব্দরা আজ অস্তাচলে। দুম করে যদি সেই বাংলা শব্দগুলো বলে বসেন কেউ, তবে রীতিমত চোখ কপালে উঠবে বাঙালিরই।
আরও পড়ুন - বাংলা ভাষা একটি চব্বিশ ঘণ্টার বিনোদন প্যাকেজ
ভাষা হল বহমান স্রোতের মতো। জীবনের নিয়ত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষাও বদলে বদলে যায়। বদলে যায় ভাষা ব্যবহারের অভ্যাসও। পরিবেশ পরিস্থিতির দায়ও এক্ষেত্রে অনেকখানি। তবে যে কোনও ভাষাতেই অন্য ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এমন অনেক শব্দই অভিধানে যোগ হয় যা একেবারেই ভিন্ন ভাষার। বাংলাও ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন সময়ে যেসব দেশ এখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছেন তাদের বেশি কিছু শব্দও রেখে গিয়েছেন এখানে। ফরাসি, পর্তুগিজ, চিনা শব্দেরা প্রায়শই তাই ঘোরাফেরা করে আমাদের চোখের সামনে। কিন্তু ইংরেজির দাপট একেবারেই আলাদা। আধুনিক হতে গিয়ে ভাষার ওপর যে হতে প্রভাব পড়ছে তাতে বাংলাভাষার চোখে জল আসে স্বাভাবিক।
তবে চেয়ার এবং টেবিল এই শব্দদুটোর ব্যবহার বাংলায় অনেক আগে থেকেই। মেজ-কেদারা ছেড়ে অনেকদিন হল বাঙালিরা চেয়ার টেবিল বসছে। ইউরোপীয় ভাষার শব্দভাণ্ডার থেকে প্রবেশ করার পর আমাদের কথ্য ও লিখিত ব্যবহারে এই দু’টি শব্দ বাংলাই যেন হয়ে গিয়েছে এখন। শুধু তাই নয় সাহিত্যের ভাষাতেও লেখক ভুলেও ব্যবহার করেন না মেজ-কেদারা-কুর্সির মতো শব্দগুলি। পুরনো কিছু পুঁথি ঘেটে হয়তো খুঁজে পেতে পারেন তবে আজকের বাংলা সাহিত্যে? নৈব নৈব চ!
কালের স্রোতে বিলীয়মান কুর্সি, কেদারা, মেজ-এর মতো শব্দগুলি। পরিবর্তে চেয়ার, টেবিল বলতেই আমরা স্বচ্ছন্দ। এখানেই ভাষার বহমানতা। তবে বাংলা ভাষার চোখের জল মোছানোর দায় কি নেই কারোর? এ যুগের বিদ্যাসাগর হওয়ার দায় নেবে কে! তাই ইউনেস্কোর তরফে ২০১০ সালে বাংলা ‘পৃথিবীর সব চেয়ে মিষ্টি ভাষা’-র স্বীকৃতি পেলেও তার ব্যবহারে বাঙালিরই এত অনীহা দেখে আশঙ্কাই হয়, এই বুঝি বাংলা ভাষাকে তারা পুরোপুরি কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিল।