অভিনয় দেখে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন বিদ্যাসাগর, বাংলা থিয়েটারের ধ্রুবতারা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি
Ardhendu Sekhar Mustafi: বিদ্যাসাগর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। পা থেকে জুতো খুলে ছুঁড়ে মারলেন মঞ্চে উপস্থিত উড সাহেবকে। কিন্তু সাহেব কোথায়? আসলে একজন বাঙালি!
৭ ডিসেম্বর, ১৮৭২ সাল। উত্তর কলকাতার ঘড়িয়ালা বাড়িতে দীনবন্ধু মিত্র রচিত নীলদর্পণ নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে। দর্শকাসনে সেই সময়ের বাংলার অন্যতম খ্যাতনামা ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উপস্থিত রয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সবাই মনোযোগ দিয়ে নীল চাষিদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রচিত নাটক এবং সেই নাটকের বিভিন্ন চরিত্রদের দেখছেন। নাটকটি হয়তো শুধু তার প্রেক্ষাপটের জন্যই জনপ্রিয় হতো কিন্তু আরও একটি ঘটনা অনিচ্ছাকৃতভাবে এই নাটকের সঙ্গে জুড়ে গেল। নাটকের মঞ্চে তখন উপস্থিত হয়েছে অত্যাচারী প্রধান নীলকর সাহেব উডের চরিত্রটি। তার অত্যাচারের বিবরণ দেখে বিদ্যাসাগর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। পা থেকে জুতো খুলে ছুঁড়ে মারলেন মঞ্চে উপস্থিত উড সাহেবকে। কিন্তু সাহেব কোথায়? আসলে একজন বাঙালি তো সাহেবের চরিত্রে অভিনয় করছেন। অভিনেতা অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য অভিনয় বন্ধ করে দিলেন! তারপর বিদ্যাসাগরের জুতো তুলে মাথায় রাখলেন। একজন অভিনেতার কাছে অভিনয়ের জন্য এর থেকে বড়ো পুরস্কার হতে পারে না। এই অভিনেতা সেইদিন নীলদর্পণ নাটকে উড সাহেব ছাড়া আরও তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেই চরিত্রগুলো হলো গোলকবাবু, তার স্ত্রী সাবিত্রী এবং নীল চাষি। নীলদর্পণ নাটকে চারটি চরিত্রে অভিনয় করা এই অভিনেতা-নাট্যকারের নাম ছিল অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি।
বাংলার নাট্য জগতের কথা উঠলে গিরিশ চন্দ্র ঘোষের নামই বহু বাঙালির মনে প্রথমে মনে পড়ে। সেটাই যদিও স্বাভাবিক। নাট্যজগতে তাঁর কাজ এক নতুন ঘরানার জন্ম দিয়েছে। তিলোত্তমার বাস রাস্তা আজও তাঁর বাড়ির কাছে এসে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। অর্ধেন্দুশেখরও কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষের সমসাময়িক এক বিখ্যাত নাট্যকার ছিলেন।
আরও পড়ুন- বিদ্যাসাগরের দয়া, করুণার মধ্যেই কি লুকিয়ে ছিল প্রেমের ভাষা?
১৮৫০ সালে উত্তর কলকাতার বাগবাজারে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির জন্ম। অল্প বয়সেই নাটকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং অভিনয়ে হাতেখড়িও হয়েছিল। মাত্র সতেরো বছর বয়সে পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়িতে কিছু নাটকে তিনি অভিনয় করেন। কথিত আছে, ছাত্র থাকাকালীন এই নাটকে অভিনয় করার পরে তিনি বেশ কিছু মানুষের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তাঁর নিজের পরিবারও তাঁকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। সেই সময় হোক অথবা বর্তমান সময়, যদি কোনও সতেরো বছরের ছেলে নাটকে অভিনয় করার ফলে পরিবারের থেকে এমন প্রত্যাখ্যান পায়, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাটকের প্রতি নিজের অনুরাগকে ছুঁড়ে ফেলে পরিবারের নিরাপত্তার কাছেই ফিরে আসে তাঁরা। অর্ধেন্দুশেখর সেটা করেননি, বলা ভালো করতে পারেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, নিজের আবেগকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি কোনও অসৎ পথ অবলম্বন করেননি। বাড়িতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সেই প্রথম নাটকের পর যদি অভিনয় করা তিনি বন্ধ করে দিতেন তাহলে হয়তো বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ছোঁড়া জুতো তাঁর কপালে জুটতো না।
অর্ধেন্দুশেখর প্রথমে বাগবাজার থিয়েটারে যোগদান করলেও পরবর্তীকালে গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে মিলিতভাবে ন্যাশনাল থিয়েটারের স্থাপনা করেন। কথিত আছে, ন্যাশনাল থিয়েটারের নাম নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ার কারণে গিরিশচন্দ্র ঘোষ সেই দল ত্যাগ করেছিলেন। যদিও ন্যাশনাল থিয়েটার নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেই নীলদর্পণের প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। নীলদর্পণ প্রথমবার মঞ্চস্থ হওয়ার পরে এক ইংরেজি দৈনিকের হাতে নাটকের তীব্র সমালোচনা করে দুটো বেনামী চিঠি এসে পৌঁছেছিল। অনেকেই সন্দেহ করেন, চিঠি দুটো আসলে গিরিশচন্দ্র ঘোষ লিখেছিলেন, যদিও তার সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।
আরও পড়ুন- দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তা! হরিশ মুখার্জি রোডের নেপথ্যের মানুষকে চিনলই না বাঙালি
নীলদর্পণের নাম শুনলেই দীনবন্ধু মিত্রের নাম মনে পড়ে। যদিও দীনবন্ধু মিত্র শুধু নীলদর্পণ রচনা করেই ক্ষান্ত হননি। একইভাবে নীলদর্পণ নাটকের অভিনয় এবং বিদ্যাসাগরের জুতো ছোঁড়ার ঘটনা শুধু অর্ধেন্দুশেখরের অভিনয়ের মাত্রা বর্ণনা করার একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। দীনবন্ধু মিত্র রচিত নবীন তপস্বীনিতে জলধর, দীনবন্ধু মিত্র রচিত সধবার একাদশীতে নিমচাঁদ, নবীন সেন রচিত পলাশির যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ-তে ভক্তপ্রসাদ, মেঘনাদবধে রাবণের মতো চরিত্রগুলো অর্ধেন্দুশেখরের অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। বাংলার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে ইংরেজি বলতে পারার কারণে কোনও চরিত্রের সংলাপ তাঁর মুখে বেমানান লাগত না। থিয়েটারে অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশিই তিনি বেশ কিছু মূক নাটক সৃষ্টি করেছিলেন। তাদের মধ্যে মুস্তাফি সাহেব কা পাক্কা তামাশা, শারদীয়ার পঞ্চরঙ্গ, ভগবান ভূত যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল।
বাঙালির ইতিহাস খুঁজতে গেলেই বোঝা যায়, ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় এবং চরিত্র বহু ক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নাটকের জগতও সেই মিশ্রণ থেকে মুক্ত নয়। এই জগতে কোথাও যেন দীনবন্ধু মিত্র থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ থেকে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি এমনকী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও যেন এক অধ্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন। নাট্যকার ছাড়াও অভিনয় শেখানোর ক্ষেত্রেও অর্ধেন্দুশেখর সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার কাছেই পরবর্তী সময়ের বহু বিশিষ্ট নাট্যকার অভিনয় শিক্ষা লাভ করেছিলেন।
১৯০৯ সালে নাট্যজগতে মুস্তাফি সাহেব নামে পরিচিত এই বিখ্যাত নাট্যকার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, বাংলা নাটকের একটা যুগের অবসান ঘটে। তাঁর নাট্যজীবনে অভিনয় করা অসংখ্য বিখ্যাত চরিত্রের আড়াল থেকে আজও ইতিহাসের পাতা সরিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি।
তথ্য ঋণ : আনন্দবাজার পত্রিকা, ওয়ার্ডপ্রেস, গেট বেঙ্গল।