একজন খুনি, বারো জন বিচারক! বাংলা নাট‍কের দর্শককে ভাবাবে 'এক থেকে বারো'

Bengali Theatre: একটি খুন ও খুনিকে কেন্দ্র করে বারো জন জুরির বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে এই নাটক আবারও বাংলা নাট্যমঞ্চ মাতাতে প্রস্তুত।

'নান্দীকার' তথা বাংলা থিয়েটারে একটা দীর্ঘ সময় অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। কেবল অভিনয় নয়, নির্দেশনা, নাট্য-সংগীত এবং নাট্যরচনায় অবাধ বিচরণের সাক্ষী আপামর নাট্যপ্রেমী বাঙালি তথা নাট্যপ্রেমী ভারতীয়। ২০২১ সালে স্বাতীলেখার প্রয়াণের পর নান্দীকার-এর যাত্রাপথ ছিল কিছুটা বিক্ষিপ্ত। নান্দীকার তাদের পুরনো প্রোডাকশন, যেমন ‘মানুষ’ বা ‘মাধবী' (স্বাতীলেখা নির্দেশিত) অভিনয় করেছে কিছুবার, তবে নান্দীকার এই সময়কালে কোনও নতুন প্রযোজনা নিয়ে মানুষের কাছে আসেনি। এবার যখন তারা নতুন অভিনয় নিয়ে মঞ্চে ফিরলেন, সেই নতুন প্রোডাকশনটিও হলো সম্পূর্ণ 'Out of the box'.

গত শতকের নয়ের দশকে একটা সময় স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত শারীরিক কারণে থিয়েটার থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই সময়কালে তিনি রেজিনাল্ড রোজ রচিত বিখ্যাত আমেরিকান টিভি নাটক ‘12 Angry Men’ বাংলায় অনুবাদ করেন। তৎকালীন নান্দীকারের তরুণরা সেটি অভিনয়ও করে।স্বাতীলেখার প্রয়াণের পর ওঁর জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সপ্তর্ষি মৌলিক এই নাটকটির স্ক্রিপ্ট নতুন করে খুঁজে পান এবং তার থেকেই গড়ে ওঠে নান্দীকারের নবতম প্রযোজনা ‘এক থেকে বারো’।

মূল আমেরিকান নাটক ও তার বহু অনুবাদেই পাওয়া যায়, নাটকটির মূল চরিত্রসংখ্যা ১২ এবং ১২ জনই পুরুষ। কিন্তু নান্দীকারের নাটকে সেই সংখ্য ৯ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী। একে বাস্তবের মাটিতে কর্মক্ষেত্রে পুরুষ-মহিলা অনুপাত ৯:৩-এর প্রতিরূপ হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন: হিংসাই শেষ কথা নয়! স্বাধীনতার ইতিহাসকে অন্য চোখে দেখাবে ‘দিল্লি চলো'

‘এক থেকে বারো’ দিয়ে নান্দীকারে তথা বাংলা থিয়েটার জগতে এক নতুন পরিচালকের পদার্পণ ঘটল। তিনি সপ্তর্ষি। সপ্তর্ষি একাধারে সুদক্ষ অভিনেতা তো বটেই, তার সঙ্গে নাটককারও বটে। এবং এই নতুন (নির্দেশকের) ভূমিকায় তিনি যে সমানভাবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তা যাঁরা নাটকটি দেখেছেন, তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করবেন।

একটা কথা এখানে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই, এই নাটককে নাট‍্য হতে অনেকটা সাহায্য করেছে স্বাতীলেখা অনূদিত টেক্সটটি। নাটকটিকে text হিসেবে দেখলে কখনওই মনে হয় না এটি একটি বিদেশি নাটকের অনুবাদ, বরং অনেকাংশে মনে হয় নাটকটি আবার পুনর্গঠন করেছেন স্বাতীলেখা তাঁর ভারতীয় মনন দিয়ে। এখানে নাটকের আখ্যান নিয়ে বেশি কথা বলব না, যদিও যাঁরা মূল টিভি নাটকটি দেখেছেন, তাঁরা গল্পটির চলনের সঙ্গে পরিচিত।

নাটকটি আজকের সময়ে মঞ্চস্থ হওয়া আলাদা তাৎপর্য যোগ করে। আজ যে সময় ও সমাজব্যবস্থায় বসবাস করছি বা করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা, সেখানে প্রত্যেকে খুব রেগে আছে। সেখানে কিছু জন শিক্ষা ও রুচির অজুহাতে সামাজিকতা ও শালীনতার মুখোশ পরে থাকে আর কিছু জন যেখানে-সেখানে নিজেদের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেগুলো অযৌক্তিকভাবে ভুল জায়গায় হয়)। এই রাগের অনবরত বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখে চলেছি সোশ্যাল মিডিয়া নামক সার্কাসের মঞ্চে। ঠিক একইভাবে এই নাটকের ১২টি চরিত্রই রেগে। বিভিন্ন কারণে রেগে, তাদের রাগের ভঙ্গিও পৃথক, তবে সবাই প্রচণ্ড রেগে। এই কমন রাগটাই আজকের সময়ে নাটকটিকে আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক করে দেয়।

নান্দীকারের এই মুহূর্তে যে তরুণ গ্রুপটি কাজ করছে, আমি এই গ্রুপটিকে (সাধন পাড়ুই-কেও সংযুক্ত করে) একটি স্বয়ংক্রিয় ইউনিট হিসেবে দেখি। সেট (অয়ন), আবহ (সপ্তর্ষি ও অর্ঘ্য), প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণ (অনিন্দিতা), সহ-নির্দেশনা (অর্ঘ্য), আলো (সাধন), নির্দেশনা- পুরো ব্যাপারটাই এই স্বয়ংক্রিয় ইউনিট দ্বারাই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এবং এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই নান্দীকারের অভিনেতা, যাঁরা এই নাটকে অভিনয় করছেন। এর সঙ্গে ‘এক থেকে বারো’-তে এমন অনেকে অভিনয় করেছেন, যাঁরা নান্দীকার থিয়েটার ওয়ার্কশপ থেকে উঠে আসা এবং যাঁরা জীবনে প্রথমবারের জন্য মঞ্চে অভিনয় করছেন। এটিও বাংলা থিয়েটারের একটি বড় পাওয়া।

‘এক থেকে বারো’ নাটকটির এমন একটি দিক আছে, যা একাধারে যেমন সুবিধার দিক, একই সঙ্গে অসুবিধারও। প্রথমে সুবিধার কথাটা বলি, এই নাটকের ঘটনাপ্রবাহ একটিমাত্র রাত্রে একটিইমাত্র ঘরের মধ্যে ঘটে চলে। এই স্থান ও কালের কোনও প্রভেদ না থাকায় নাটকটির থিয়েটার হিসেবে গড়ে ওঠা সহজ হয়। কিন্তু এই ব্যাপারটাই এর অসুবিধার দিকও হয়ে উঠতে পারত। ২০২২-এর দর্শক অনেকটা পরিবর্তিত, প‍্যানডেমিকের পরে তো আরওই, এক্ষেত্রে কোর্টরুম আর ড্রইংরুম ড্রামার মিশেলে এই নাটক দর্শককে কতখানি ধরে রাখতে পারবে- তা নিয়ে একটা সংশয় দেখা দিচ্ছিল মনে। তবে এই কৃতিত্ব নির্দেশক ও প্রত্যেক অভিনেতার যে, তাঁরা দর্শকদের মনের সঙ্গে সুতোটা ঠিকঠাকভাবে গেঁথে রাখতে পেরেছেন। যখন চরিত্ররা মানসিকভাবে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করছে তখন দর্শকদের উচ্ছাস আর প্রতিক্রিয়া দেখেই অভিনেতাদের দর্শক ধরে রাখার সফলতা আঁচ করা যায়।

এই নাটকের দু'টি বিষয় নিয়ে আলাদা করে কথা বলতেই হয়, প্রথমটি অর্ঘ্য দে সরকারের অভিনয়। তিনি যে চরিত্রটিতে অভিনয় করছেন, সেটি তাঁর নিজস্ব বয়সের থেকে অনেকখানিই বেশি। তবে তাঁর শরীরী অভিনয়, তাঁর বাচনভঙ্গি ও অভিব্যক্তি এতটাই যথাযথ যে, তা বহুদিন মনে থেকে যেতে বাধ্য। দ্বিতীয়টি হলো, মঞ্চনির্মাণে দাবার ছকের মতো দেখতে একটি কার্পেটের ব্যবহার, যে কার্পেটটি মঞ্চ থেকে নেমে আসে অডিটোরিয়ামের মেঝেতে। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, সাদা-কালোর এই দ্বন্দ্ব কার্পেটের মাধ্যমে আলাদা মাত্রা পেয়েছে এই নাটকে।

একটি খুন ও খুনিকে কেন্দ্র করে বারো জন জুরির বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে এই নাটক আবারও বাংলা নাট্যমঞ্চ মাতাতে প্রস্তুত। বিগত কিছু অভিনয়ে এই নাটক বাংলা থিয়েটার দর্শকের মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, তা যথাযথই নান্দীকার-সুলভ।

More Articles