৭৮ বছর ধরে বাঙালির ভরসা, এখন কী অবস্থা শালিমার নারকেল তেলের?

Shalimar Advertisement: টিভির পর্দায় এখনও অমলিন বাঙালির ৭৮ বছরের ঐতিহ্য শালিমারের বিজ্ঞাপন। দুর্গাপুজোর আগে সেই বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল এখনও শুনতে চায় বাঙালি‌।

বুকের ভিতর হতে,

ফুটে ওঠা বিশ্বাসে,

ফিরে আসে বারবার

বাঙালির ঘরে ঘরে শালিমার ...

মানুষের বিশ্বাসের উপরেই একটি ব্র্যান্ডের টিকে থাকা নির্ভর করে, আর এই সত্য বিভিন্ন মহাদেশে জাতীয়, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড নিয়ে হওয়া ‘টাগ অব ওয়ার’-কেও পিছনে ফেলে দেয়। মানুষের সেই ব্র্যান্ডের প্রতি অটুট বিশ্বাসই তাকে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে সাহায্য করে। কথা হচ্ছে বঙ্গবাসীর প্রিয় শালিমার ব্র্যান্ড নিয়ে, যা বাংলায় আছে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে। শালিমার (Shalimar Coconut Oil) নারকেল তেলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছোটবেলার নস্টালজিয়া। দুর্গাপুজোর ঠিক আগে একসময় টিভি খুললেই কানে ভেসে আসত বিজ্ঞাপনের চেনা সুর। বাঙালির প্রাণের পুজোর প্রেক্ষাপটে নিখুঁত গান বেঁধেছিল শালিমার। আজও পুজোর আগে আগে সেই সুর ভেসে ওঠে মোবাইলের স্ক্রিনে, টিভিতে।

বাঙালি যুবকরা ব্যবসা করে না, ব্যবসা করতে জানে না, বাঙালি অলস, অন্যের অধীনে থেকে কাজ করতেই তারা অভ্যস্ত, ব্যবসার ঝুঁকি নেওয়ার সাহস বা মানসিকতা কোনটাই তাদের নেই, বাঙালির দ্বারা কিস্যু হবে না, খালি খেতে আর ঘুমোতে জানে- স্বাধীনতার আগে শুধু নয়, স্বাধীনতার পরেও অনেকেরই এমনটাই ধারণা ছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘জনঅরণ্য’ সিনেমাতেও চাকরির খোঁজে বের হওয়া প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে (সোমনাথ) একই কথা বলেন উৎপল দত্ত (বিশুদা)। এর পাশাপাশি শোনা যায়, এ বিষয়ে গুজরাতি আর মারোয়াড়িদের প্রশংসা।

আজকের যুগে এখনও বাঙালিদের সম্পর্কে অনেক অবাঙালির একই ধারণা। এমন ধারণা অনেক বাঙালিরও বটে। কিন্তু জানলে অবাক হবেন, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই ব্যবসায় নেমে রীতিমতো ‘বিজনেস টাইকুন’ হয়ে উঠেছিলেন অনেক বাঙালি যুবক। ননীগোপাল মিত্রর ‘সুলেখা কালি’, গৌরমোহন দত্তের ‘বোরোলিন’ হয়ে উঠেছে বাঙলার অঙ্গ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই ব্যবসার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে বহু বাঙালি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিণত হয় স্বদেশি আন্দোলনে। এই আন্দোলন জন্ম দেয় এশিয়ান পেইন্টস, ল্যাকমি, টাটা স্টিল ইত্যাদির মতো অনেক আইকনিক ব্র্যান্ডের। এই ব্র্যান্ডগুলি কেবল বিদেশি পণ্য বিক্রয়ই কমায়নি, বরং ঐক্যবদ্ধ করেছিল বাঙালিকে।

আরও পড়ুন- মুম্বইয়ের রঙ কোম্পানি বদলে দিল বাংলার দুর্গাপুজো! কীভাবে শুরু হল থিমের পুজো?

চারের দশকের এক বাঙালি ব্যবসায়ীর হাত ধরে পরাধীন ভারতে গুটি গুটি পায়ে পথচলা শুরু করেছিল শালিমার। নেপথ্যে প্রকৃতিনাথ ভট্টাচার্য। মাত্র ১০ বছর বয়সে তাঁর বাবা জানকীনাথ ভট্টাচার্যর মৃত্যু হয়। জানকীনাথ ছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজের সংস্কৃতের অধ্যাপক। বাবার মৃত্যুর পর রেলকর্মী দাদা বিভূতিভূষণের সঙ্গে তিনি হাওড়ার শালিমারে চলে আসেন। তাঁর বাবা-দাদা সবাই ছিল চাকুরিজীবি। শিবপুর দীনবন্ধু ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে তিনি কলকাতার রিপন কলেজে বিএসসি পাশ করেন।

তিনের দশকে তখন হাওড়ায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রমরমা। কারিগরি শিল্পের দিকেই ঝুঁকছেন সকলে। প্রচলিত সেই ধারায় গা না ভাসিয়ে শিবপুর বাজারে গম পেষাইয়ের কারবার খুলে বসেন প্রকৃতিনাথ। অধ্যাপকের পুত্র হলেও প্রকৃতিনাথের বাসনা ছিল শিল্পসাধনার। সালটা ১৯৩৭। শিক্ষক দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায় প্রিয় ছাত্র প্রকৃতিনাথকে ২৫০ টাকা দিয়েছিলেন, আটা-চাকি খোলার জন্য। টুলো পণ্ডিত বংশের বামুনের এই মতিগতি মোটেই ভাল চোখে দেখেনি তৎকালীন সমাজ। তবে লোকজনের সেই তর্জনী উপেক্ষা করেই ব্যবসায় মন দেন তিনি। ওদিকে ‘শঙ্খ আটা কল’ দ্রুত জনপ্রিয়তা পেলেও ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ আর সরকারের খাদ্যনীতির ফরমানে তা বন্ধ করে দিতে হয়।

পরের বছরই ১৯৪৪-এ স্বল্প সঞ্চয়ে জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী মশাইয়ের পরামর্শে ইঞ্জেকশন অ্যাম্পুল তৈরির ব্যবসা শুরু করেন প্রকৃতিনাথ। প্রথম বছর ৭-৮ জন কর্মচারী নিয়ে কাজ করে অভূতপূর্ব সাফল্য পান তিনি। এক বছরের মধ্যে শালিমার থেকে কারখানা উত্তর কলকাতার নারকেলডাঙা মেন রোডে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। বছরখানেক সেই ব্যবসা চালানোর পর বন্ধু পঞ্চানন মণ্ডলের সঙ্গে মিলে শুরু করেন ‘শালিমার’। প্রথম প্রথম অপরিশ্রুত নারকেল তেল কিনে নিজেদের কারখানায় শোধনের পর শালিমার লেবেল এঁটে তা বিক্রি করা হতো। সাইকেলে চেপে কৌটোয় ভরা সেই তেল দোকানে দোকানে পৌঁছে দিয়ে আসতেন প্রকৃতিনাথ নিজে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা পরিস্থিতিতে নারকেল তেল, তিল তেল, পাউডার তৈরির ইউনিটগুলি চেতলা, সাহাপুর, রামকেষ্টপুরে সরানো হয়। শুরুর প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত অপরিশোধিত নারকেল তেল কিনে তা পরিশোধন করে বিক্রি করত শালিমার। ১৯৫৫ সাল থেকে নারকেল শাঁস কিনে তা মেশিনে পেষাই করে নারকেল তেল বিপণন শুরু হয়। দুই বন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রমে এই প্রতিষ্ঠান স্বীকৃত হয় বাংলার অন্যতম সফল শিল্প হিসেবে। দেশজোড়া খ্যাতির অধিকারী হন প্রকৃতিনাথ ভট্টাচার্য।

বছর চারেকের মধ্যে নরেন্দ্রপুরের কাছে কোম্পানি কিনে ফেলে ২৭ বিঘে জমি। বড় কারখানা তৈরি হয় সেখানেই। একে একে হায়দরাবাদে তৈরি হয় আরও তিনটি কারখানা। এখন শুধু নারকেল তেল নয়, রান্নাঘরেও পৌঁছে গেছে তার নাম। শালিমার শেফ গুঁড়ো মশলা, নন স্টিকি তেল, সরষের তেল অন্যতম পণ্য। যদিও এখনও শালিমারের নারকেল তেলই তাদের জনপ্রিয় এবং বিক্রিত পণ্য।

এরপর তো শুধুই ইতিহাস। বিজ্ঞাপনের সেলিব্রিটিদের প্রচার কৌশলে বাঙালির ঘরে ঘরে 'মেরা প্যায়ার শালিমার'। মা-কাকিমাদের প্রথম পছন্দ আজও এই শালিমার। হাওড়ার শিল্পোদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি, ‘শালিমার’ ব্র্যান্ডের নারকেল তেলের টিনের কৌটো আজ বিলুপ্তির পথে। একটা সময় চাল মাপার কাজে ব্যবহার করা হতো, সেই কৌটো, আর বাজারে দেখা যাবে না। কোম্পানি এনেছে প্লাস্টিকের বোতল। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানবসভ্যতা যতই উন্নত হয়েছে, চুলের যত্ন নেওয়ার জন্য নতুন নতুন কোম্পানির নারকেল তেলের আমদানিও ততই বেড়েছে। জনপ্রিয়তার কঠিন লড়াইয়ে পিছিয়ে যাওয়ায়, কোম্পানির নতুন প্রজন্মকে পরিবর্তন করতে হয়েছে টিন থেকে প্লাস্টিকের ব্যবহারে। আধুনিকতার নতুন মোড়কে পরিমাপেরও পরিবর্তন হয়েছে। বাতিল হয়েছে পুরনো দিনের সব অভ্যাস।

আরও পড়ুন- কীভাবে বাংলায় এল জনপ্রিয় ক্যাপ বন্দুক! অবাক করবে দুর্গাপুজোর এই খেলনার ইতিহাস

৭৮ বছর ধরে বঙ্গজীবনের অঙ্গ শালিমার। প্রকৃতিনাথ পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন ১৯৮৮ সালে। আজ তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাঁধে ভর করেই এগিয়ে চলেছে ‘শালিমার’। পণ্য বিপণনের পাশাপাশি সিনেমার প্রযোজনাতেও হাত পাকিয়েছে সে। ৭৮ বছরের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে চলেছে শালিমার। কুঁড়ি থেকে সে এখন হয়ে উঠেছে বিরাট বটবৃক্ষ।

পরাধীন ভারতে শালিমারের কুঁড়ির ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গিয়েছিল। তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, বিশ্বযুদ্ধর ভ্রূকুটি- একের পর এক ঢেউয়ে টালমাটাল শালিমারকে দু’হাতে আগলে রেখেছিলেন প্রকৃতিনাথ ভট্টাচার্য। দেশ স্বাধীন হলে ব্যবসায় গতি আসে। বিজ্ঞাপনকে হাতিয়ার করে সে ব্যবসাকে আলাদা মাত্রায় নিয়ে যান তিনি। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের শালিমার। ছকভাঙা এক ব্যতিক্রমী হিসেবে এই ব্যবসায়ীকে আজীবন মনে রেখে দেবে বাঙালি।

আগেকার দিনে নারকেল তেল ফুরিয়ে গেলেই বাড়ির মা-কাকীমারা সেই নারকেল তেলের কৌটোটিকে পরিবর্তন করে ফেলতেন চাল মাপার কৌটোয়। বেশ কিছু বছর আগেও দেখা যেত এরকমভাবেই এই কৌটোগুলির ব্যবহার। তবে টিভির পর্দায় এখনও অমলিন বাঙালির ৭৮ বছরের ঐতিহ্য শালিমারের বিজ্ঞাপন। দুর্গাপুজোর আগে সেই বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল এখনও শুনতে চায় বাঙালি‌। সেই গানের বিজ্ঞাপনে এখন শ্রীকান্ত আচার্য থেকে লোপামুদ্রা মিত্র, রূপম ইসলাম থেকে অনিন্দ্য-চন্দ্রিল-উপল ত্রয়ী- সকলকে দেখা যায়। পুজো এলেই বাঙালির নস্টালজিয়ায় দোলা দিয়ে বেজে ওঠে, 'এই মহামিলনের ক্ষণে/এই চিরনতুনের টানে...'।

More Articles