বারবার ব‍্যর্থতা, বারবার ঘুরে দাঁড়ানো! ফিরে দেখা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সেরা পাঁচটি কামব‍্যাক

Sourav Ganguly: ফিরে দেখা যাক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের সেরা পাঁচটি কামব্যাক।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ‘কামব্যাক’ শব্দটি। টিভি শো হোস্ট থেকে সিএবি প্রেসিডেন্ট, ম্যাচ গড়াপেটায় জর্জরিত ধুঁকতে থাকা একটি টিমকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দাঁড় করানো থেকে শেষ মুহূর্তে খেলা ঘুরিয়ে দিয়ে বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হওয়া- সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতীয় ক্রিকেটের প্রকৃত অর্থে কামব্যাক কিং। একথা জলের মতো পরিষ্কার যে, বিসিসিআই সভাপতি হওয়ার দৌড় থেকে ছিটকে গেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন ‘মহারাজ’। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে সৌরভ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, প্রশাসক হিসেবে মসনদ হারালেও জীবনে ‘আরও বড় কিছু’ করার লক্ষ্য নিয়ে ফেলেছেন তিনি। এই মানসিকতাই তো সৌরভ গাঙ্গুলীকে ক্যাপ্টেন থেকে লিডার বানিয়েছিল। সৌরভের মন্তব্য থেকে এতটুকু পরিষ্কার যে, স্টিভ ওয়া-র টানা টেস্ট জয়ের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকে দেওয়া সৌরভ হাল ছাড়ছেন না। কামব্যাক তিনি করবেনই, জীবনে এর আগেও বহু কঠিন পরিস্থিতি থেকে কামব্যাক করেছেন তিনি। চলুন, ফিরে দেখা যাক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের সেরা পাঁচটি কামব্যাক।

'আমি কোনও রামু নই, আমি মহারাজ'

Sourav Ganguly

লর্ডসে সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর সৌরভ

১৯৯২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রথম সিরিজে ব্যাট হাতে আহামরি কিছুই করতে পারেননি তিনি। বছর উনিশের তরুণ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ফার্স্ট ক্লাস কেরিয়ারও তখন অত উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। সেই সময় বিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। এই দুইয়ের মিশেলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কপালে জুটল ‘কোটার খেলোয়াড়ের’ তকমা। শোনা যায়, সেই সময় কোনও সিনিয়র খেলোয়াড় সৌরভ গাঙ্গুলীকে মাঠে জল নিয়ে যেতে বলেছিলেন, পাল্টা প্রত্যুত্তরে সৌরভ বলেছিলেন, “আমি কোনও রামু নই, আমি মহারাজ।” সঙ্গে সঙ্গে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়া হল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এবং চার বছরের জন্যে টিম থেকে ড্রপড হলেন তিনি। ফের সুযোগ মিলল ১৯৯৬ সালের ইংল্যান্ড ট্যুরে। এবারও বিভিন্ন সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল, ‘কোটার জোরে সুযোগ পেয়েছে’। কিন্তু নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে সমালোচকদের একদম চুপ করিয়ে দিলেন সৌরভ। প্রথম ইনিংসে বল হাতে গ্রাহাম হিক্স এবং নাসির হোসেনের উইকেট তুলে নেন সৌরভ। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে তাঁর ব্যাটে আসে লর্ডসের ময়দানের সেই ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি। সৌরভের টেস্ট কেরিয়ার শুরুই হয়েছিল কামব্যাক দিয়ে।

লর্ডসে ঘুরপাক জামা মানে দাদাগিরি
২০০০ সালের কাউন্টি ক্রিকেট সিজনে ল্যাঙ্কাশায়ার দলের হয়ে খেলেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মাঠে বরাবরই আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে খেলেন সৌরভ। সেই সিজনে একবার আউট হয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে ফেরার সময় বিপক্ষের বোলারকে কটাক্ষ করায় সৌরভ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আমার রান আমি এখানে নষ্ট করতে আসিনি, যেখানে দরকার সেখানেই মারব।” কাউন্টি ক্রিকেটের প্রতি এমন অবমাননাকর মন্তব্য শুনে বেজায় ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন কাউন্টি ক্রিকেটাররা। একই সঙ্গে বিরক্ত হয়েছিলেন সৌরভের ল্যাঙ্কাশায়ারের সতীর্থ খেলোয়াড়রাও। ওই ল্যাঙ্কাশায়ার দলে ছিলেন আরেক তরুণ খেলোয়ার, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ। তরুণ ফ্লিনটফ ঠিক করে নিয়েছিলেন এই মন্তব্যের প্রতিশোধ নেবেন। সুযোগ এল দুই বছর পর মুম্বইতে। মুম্বইতে ম্যাচ জিতে মাঠেই জার্সি খুলে দৌড়েছিলেন ইংরেজ অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ। চোখে জল নিয়ে সাইডলাইন থেকে তৎক্ষণাৎ উঠে যান সৌরভ। সেই সময় চোখে জল নিয়ে উঠে গেলেও যথাযথ প্রতিশোধ নিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ওই বছরেরই জুন মাসে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি ফাইনাল জিতে লর্ডসের গ্যালারিতে জার্সি খুলে উড়িয়েছিলেন মহারাজ। ফ্লিনটফের আচরণের যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন 'মহারাজ'।

Sourav Gangulyলর্ডসে জামা খুলে ওড়ানোর সেই আইকনিক দৃশ্য

'কহিঁ ভুলে তো নেহি মুঝে'
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং গ্রেগ চ্যাপেলের দ্বন্দ্বের কাহিনি কারও অজানা নয়। অধিনয়াক সৌরভের হাত ধরেই ভারতীয় দলের কোচ হয়ে এসেছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। পাল্টা রাজনীতি করে সেই সৌরভ গাঙ্গুলীকেই জাতীয় দল থেকে বাদ দিয়ে দেন গ্রেগ। ২০০৫ সালে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন সৌরভ। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করে, ঘরোয়া ক্রিকেটে ক্রমাগত রান করে দলে ফিরলেন তিনি। ‘কহিঁ ভুলে তো নেহি মুঝে...’ গ্রেগ চ্যাপেল জমানায় জাতীয় দলে কামব্যাকের সময় এমনই বিজ্ঞাপন তৈরি হয়েছিল সৌরভকে নিয়ে।

Sourav Ganguly

সৌরভ গাঙ্গুলীর সেই কামব্যাক ইনিংস

একপ্রকার বাধ্য হয়ে ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে সাউথ আফ্রিকা সফরে সৌরভকে দলে ফেরান চ্যাপেল। সেই সাউথ আফ্রিকা সফরে একপ্রকার বাধ্য হয়েই টেস্ট সিরিজে সৌরভকে খেলান গ্রেগ। প্রথম টেস্টে ব্যাট করতে নেমে ভারতের স্কোর যখন ৩৭/৪, তখন ব্যাট করতে আসেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রায় এক বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেমেই ৮৩ রানের সেই ঐতিহাসিক ‘কামব্যাক ইনিংস’ খেলেন সৌরভ। পরবর্তী শ্রীলঙ্কা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ব্যাট হাতে কার্যত তাণ্ডব করেন সৌরভ গাঙ্গুলী! গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি।

'পুরো ইডেনটাই তো আমার'
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং রবি শাস্ত্রীর মধ্যের তিক্ততার কথা সকলেরই জানা। অনেকের মতে, ২০১৭ সালে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অঙ্গুলিহেলনের কারণেই শাস্ত্রীকে সরিয়ে অনিল কুম্বলে-কে কোচ করা হয়। নাম না করলেও বিভিন্ন সময় পরস্পরের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন দু'জনই। ভারতীয় দলের ক্রিকেট কোচ হিসেবে শাস্ত্রীর মেয়াদ শেষ হয় গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর। শাস্ত্রীকে সরিয়ে রাহুল দ্রাবিড়কে ভারতীয় দলের কোচ করার পিছনেও বড় ভূমিকা ছিল সৌরভের।

Sourav Gangulyরবি শাস্ত্রী এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বৈরথ পুরনো

তবে ঘটনাটি বেশ কয়েক বছর আগেকার। সেবার ইডেনে ম্যাচের ধারাভাষ্য করার সময় রবি শাস্ত্রী সৌরভ গাঙ্গুলীকে প্রশ্ন করেছিলেন, “তোমার কি মনে হয় না, ইডেনে তোমার নামে একটা স্ট্যান্ড হওয়া উচিত ?” সৌরভের জবাব দিয়েছিলেন, “পুরো ইডেনটাই তো আমার।” সৌরভের এহেন মন্তব্যে হঠাৎ মুখের রং পাল্টে যায় রবি শাস্ত্রীর। বলাই বাহুল্য, সৌরভ গাঙ্গুলীর অপসারণে সামনে প্রকাশ না করলেও যথেষ্ট খুশি রবি শাস্ত্রী। অন্তত তাঁর তরফ থেকে আসা বয়ানগুলি তো সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ওস্তাদের মার শেষ রাতে
জগমোহন ডালমিয়ার পর যতটা প্রত্যাশিতভাবে সিএবি প্রেসিডেন্ট পদে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বসেছিলেন, ২০১৯ সালে বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট পদে ততটাই অপ্রত্যাশিতভাবে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। শ্রীনিবাসনের পর মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে, ব্রিজেশ প্যাটেল বসছেন বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে। সব প্রায় ঠিক, হঠাৎ আগের দিন রাত ন'টা নাগাদ খবর এল ব্রিজেশ প্যাটেল নয়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হচ্ছেন বিসিসিআই-এর নয়া প্রেসিডেন্ট। সেই সময় বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট পদ না পেলেও ব্রিজেশ প্যাটেল পেলেন আইপিএল-এর চেয়ারম্যানের পদ। রাতারাতি সব অঙ্ক পাল্টে দিয়ে পরদিন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। একই সঙ্গে বিসিসিআই-এর সচিবের পদে শপথ নেন অমিত শাহ-র পুত্র জয় শাহ। মনে করা হয় সেই সময় দেশের গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ-র হস্তক্ষেপেই বিসিসিআই-এর মসনদে বসেছিলেন সৌরভ।

Sourav Gangulyবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

অনুরূপভাবে অনেকেই মনে করছেন, সৌরভের অপসারণ-ও অমিত শাহর নির্দেশেই। অনেকের মতে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে শাহ-র ‘ডিল’ হয়েছিল যে, বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিজেপিতে যোগ দেবেন সৌরভ। একুশের নির্বাচনকে মাথায় রেখে বিজেপি চেয়েছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিজেদের মুখ্যমন্ত্রী চেহারা করতে। কিন্তু সৌরভ শেষ পর্যন্ত বিজেপিতে যোগ না দেওয়ায় তাঁকে সময়ের আগেই সরে যেতে হচ্ছে পদ থেকে। তবে কারণ যাই হোক না কেন, অতীতেও এরকম বহু পরিস্থিতি থেকে ফিরে এসেছেন মহারাজ। এমনি এমনি তাঁকে ‘কামব্যাক কিং’ বলা হয় না। বর্তমানে বাংলার পাশাপাশি গোটা দেশ তাকিয়ে থাকবে সৌরভের দিকে আরেকটি ‘গাঙ্গুলীয়’ কামব্যাক দেখার জন্য।

More Articles