পুজোয় তো শাড়িও বেস্ট সেলিং হয়...
Best Seller Books: কমল মজুমদারের লেখা যারা সাজিয়ে রাখে তারা এইজন্যই রাখে যে, আমরা ভাই উপজাতিদেরও মানুষ বলে মনে করি।
মধুরিমা দত্ত: বইকে কেউ বলছেন মানুষের হাতিয়ার, কেউ বলছেন মানুষের সত্যিকারের বন্ধু। বন্ধু হোক বা হাতিয়ার, দুটোর সঙ্গেই এই 'সেল’, লাভ বিষয়টা জুড়ে গেল কী করে? শুধু সেল নয় অবশ্য, পাশাপাশি এল বেস্ট। সবচেয়ে বেশি বিক্রি অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি মুনাফা। বিক্রয়-মুনাফার এই ধারণার সঙ্গে হঠাৎ বই জড়িয়ে পড়ল কীভাবে?
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়: যখন থেকে ছাপাখানার আবিষ্কার হলো তখন থেকেই বই প্রাপ্তির দ্রুততা বাড়ল। বাইবেল খুব বিক্রি হলো, আমাদের যৌবনে মাও সে তুংয়ের রেডবুক খুব বিক্রি হতো, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোও এক ধরনের বেস্টসেলার ছিল। তাহলে বই, যা জ্ঞানচর্চার অথবা বৌদ্ধিক জীবনযাপনের উপাদান, তা ব্যবসার জগতে এল কীভাবে? এটাই কার্ল মার্ক্স ধরতে পেরেছিলেন। তিনি বললেন, কীভাবে পুঁজিবাদ এসে, বই বলো, পাপ বলো, আর পুণ্য বলো সবটাকেই ব্যবসার উপকরণ করে তুলল। বই মানে সেটা একটা বিনিয়োগ, ছাপতে টাকা লাগে। কিং জন ২-তে শেক্সপিয়ারও বলেছেন, কমোডিটি, দ্য বায়াস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড! সুতরাং লাভ যখন থেকে সভ্যতার পাসওয়ার্ড হয়ে গেল তখন থেকেই বেস্টসেলারের উৎপত্তি। অর্থাৎ 'পণ্ডিত' বা 'কবি' কথাটার মূল্যই কমে গেল। জন কীটসের বই বিক্রি হয় না সুতরাং জন কীটস কবি নাকি কবি নন, এই নিয়ে আলোচনা হতে পারে কিন্তু আমাদের কাছে জনপ্রিয় হবে সেই যার লেখা বিক্রি হয়। যেমন বব ডিলান। আমি ডিলানকে ছোট করছি না কিন্তু বিক্রয়টা হলো মূল জায়গা। এখানে শিল্পসৌকর্য বা অন্য কিছু আর মূল নয়।
মধুরিমা দত্ত: এই ধারণাটা এল কোত্থেকে?
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়: এই জায়গাটা গুরুত্ব পেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। মার্কিন দুনিয়ায় দুইখানি বড় অবদান আছে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে। এক হচ্ছে, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে স্টার রেটিং সিস্টেম আর দ্বিতীয় হচ্ছে বেস্টসেলার। এই যে মারিও পুজো, বা ধরো হ্যারি পটার, যদিও ইংল্যান্ডের, হ্যারল্ড রবিনস- এদের যা বিক্রি শুরু হয়েছিল ভাবা যায় না! ১৯৫৩ সালে, মানে ঠিক ৭০ বছর আগে জেমস বন্ড দিয়ে শুরুটা হলো বলা যায়। ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ক্যাসিনো রয়াল ছিল বেস্টসেলারের সূত্রপাত। সেই ইয়ান ফ্লেমিংই সেরা একটি কথাও বলেন। বলেছিলেন, স্টেশনে, বিমানবন্দরে, যে কোনও জায়গায় যে কোনও বইয়ের প্রথম পাতা শেষ করে যখন দ্বিতীয় পাতায় যেতে আপনার ইচ্ছে করে সেটাই বেস্টসেলার হওয়ার লক্ষণ। ডন কিহোতে, দ্য কাউন্ট অব মন্টিক্রেস্টো বা বাইবেল বেস্টসেলার হতে পারে। কিন্তু বেস্টসেলার বলতে আমরা আজকাল যা বুঝি তার সঙ্গে শিল্প সাহিত্যের যোগাযোগ নেই। যেমন বাংলা সাহিত্যে, আমাদের কৈশোর-যৌবনে, তখন বেস্টসেলার নামে ডাকা হতো না কিন্তু সমস্ত বাঙালিই কিছু বই অবশ্যই পড়ে ফেলেছিল। নিমাই ভট্টাচার্যের মেম সাহেব এবং বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম! সাহেব বিবি গোলামের এমন জনপ্রিয়তা ছিল যে জনশ্রুতি রয়েছে, যখন দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে সাহেব বিবি গোলাম বেরোচ্ছে তখন ভূগোল বই ছাপা যাচ্ছিল না।
মধুরিমা দত্ত: এরকম কেন?
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়: তখন তো লেটার প্রেস, লেটারপ্রেসে এই 'ভূ' অক্ষরটা খুব কম তৈরি করা হতো। ফলে 'ভূ' সব যদি বিমল মিত্রের ভূতনাথে চলে যায়, তাহলে ভূগোল কী করে ছাপবে! কয়লা বা ভারী জিনিস যেমন বিরাট দাঁড়িপাল্লায় কাঠের পাটাতনে ওজন করা হয়, বেনিয়াপুকুর লেনে সাহেব বিবি গোলাম তখন নাকি ওভাবেই বিক্রি হয়েছিল।
কোন বইটা সিনেমা হবে এটাও একটা বড় বিষয় বেস্টসেলারের ক্ষেত্রে। গুরু দত্ত সাহেব বিবি গোলাম করলেন। নায়িকা মীনা কুমারী এমন বিরহের প্রতীক হয়ে গেলেন যে বিমল মিত্র সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এক নাম হয়ে উঠলেন। শরৎচন্দ্রের দেবদাসের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাহেব বিবি গোলাম। বেস্ট সেলার।
মধুরিমা: কিন্তু এখন বেস্টসেলারের ধারণা তো এমন নয়। এখন নির্দিষ্ট কিছু প্রকাশনার উপর নির্ভর করছে। সেই প্রকাশনা যে বইগুলোকে মুনাফার দিক থেকে সেরা ভাবছে সেগুলোকেই পাঠকের পাঠের ক্ষেত্রেও সেরা ভাবানো হচ্ছে। কিন্তু মুনাফায় ভালো মানেই সেই বই জ্ঞানের খিদে মেটাতেও যে যথোপযুক্ত তা কি বলা যায়? দৃষ্টিভঙ্গিটা তো প্রতিষ্ঠান ঠিক করছে এক্ষেত্রে, পাঠক নয়।
সঞ্জয়: যে যুগে বাস করছি তা শিল্পের নয়। অর্থাৎ সেখানে শিল্পের মাত্রা, মানে জীবনানন্দ বা কাফকা কত ভালো লিখেছেন তা আর পুঁজির জগতে গুরুত্বপূর্ণ নয়। পুরোটাই ব্যবসার মুখাপেক্ষী। আর্ট আর কালচারের তফাত আছে, কথাটা প্রথম ধরতে পেরেছিলেন জার্মান ভাবুক আদরনো। বইমেলার গিল্ড আসলে 'কালচার ইন্ডাস্ট্রি'। তারা আর্টের পরোয়া করে না। এই জায়গাতেই আমাদের ভুল হয়ে যায়, আমরা ভাবি সত্যিই বই হলো শিল্পের আধার। সংস্কৃতি তো এখন ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠেছে। লেখকের মাথার পিছনে যে নিজস্ব উজ্জ্বল আভা, তা হরণ করেছে বাঙালি প্রকাশকরা। সত্যিই তো, যদি বাউন্সার নিয়ে বইমেলার মাঠে লেখক বা লেখিকাকে দেখা যায় তাহলে বই বিক্রি কতটা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করেই বইয়ের গুরুত্ব তৈরির চেষ্টা হবে। এখানে লেখকের লিখন ভঙ্গিমা গুরুত্বপূর্ণই নয়। জীবনানন্দের সাতটি তারার তিমিরের চেয়ে যদি সচিত্র আরব্য রজনী বেশি বিক্রি হয় তাহলে এই মানদণ্ডে ওই বইটিই জীবনানন্দের বইয়ের চেয়ে বড় লেখা। ভ্যান গঘ বিক্রি না হলে তাঁর কোনও গুরুত্বই নেই। তাঁর বিক্রির মূল্য দেখেই ছবির মূল্য ঠিক করা হয়। আমাদের দেখার চোখ বদলে গেছে, প্রাইস ট্যাগ আমাদের জিনিসের গুরুত্ব ঠিক করতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন- স্টল নয় টেবিল, লিটল ম্যাগাজিনের স্পর্ধা আজও আকাশছোঁয়া
মধুরিমা: আনন্দ বা দে'জ বা আরও কিছু বড় প্রকাশনা যাদের সঙ্গে একটা সময় বিখ্যাত লেখকরা যুক্ত ছিলেন...
সঞ্জয়: হ্যাঁ, আনন্দ অনেক ভালো ভালো বই প্রকাশ করেছে। এমনকী তারা কমল মজুমদারের লেখাও প্রকশ করেছে।
মধুরিমা: হ্যাঁ, একটা সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইমেলা আলো করে বসতেন। তাঁর লেখা বই কেউ ভালোবেসে কিনেছেন, কেউ সুনীলের ওই 'আভা' থেকে বেরোতে না পেরে কিনেছেন। এখন কোনও প্রতিষ্ঠান লেখক তৈরি করছে- এটা কমে যাচ্ছে। এখন যারা বেস্টসেলিং, তাঁদের লেখা নির্বাচনও হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে জনপ্রিয়তা দেখে। এই লেখক লেখিকাদের লেখা অনেক বেশি লাইক-শেয়ার পায়। মানেই তাঁর একটা সম্ভাব্য ক্রেতা গোষ্ঠী আছে। অর্থাৎ ৫০০ শেয়ার হলে অন্তত ২৫০ ক্রেতা তো আছেই। এই মুনাফা কেন্দ্রিকতার সঙ্গে নিবিড় পাঠের সম্পর্ক কোথায়?
সঞ্জয়: সংস্কৃতিকে এখন শিল্প হিসেবে দেখতে হবে, অর্থাৎ ইন্ড্রাস্ট্রি, যার বাজার থাকেই। সুনীল বা সমরেশ বসু, শরৎচন্দ্রের বাজার ছিল ঠিকই কিন্তু লেখকের গুরুত্বও ছিল অন্য। সিনেমায় যেমন আমেরিকানরা প্রচার করতে পেরেছিল যে শিল্পী বড় নন, কোন স্টুডিওতে তৈরি হচ্ছে সেটা বড়। অর্থাৎ এমজিএম নাকি ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ছবি, নাকি ২০ সেঞ্চুরির ছবি সেটাই বড়। দেখবে, ওদের কিয়স্কের বিজ্ঞাপনে এই লোগো এত বড় থাকত যে লোকে ব্র্যান্ড দেখে কিনত, সিনেমা দেখত। তুমি যে বড় প্রকাশনার কথা বলছো, আনন্দ বা দে'জ বা গাংচিল, কারিগর, এরা ব্র্যান্ড তৈরি করছে। অর্থাৎ লেখক না, আমরা ছাপছি বলে এই লেখাগুলোর একটা মান আছে। এবং আপনি এই লেখাগুলো পড়বেন বিনা অনুশোচনায়, বিনা অনুতাপে। আপনি ব্যস্ত মানুষ, একটা লেখা যদি আপনাকে গভীর ভাবায়, আপনার দিন নষ্ট করে তাহলে আর কাজ করতে পারবেন না। আপনাকে এই বই ট্রেনে, বাসে বা গাড়িতে পড়তে হবে। এখন খুব বড়লোক হলেও তাঁর বাড়িতে জায়গা কোথায়! সেখানে ডিজিটাল বিনোদনের যে স্থান, বইয়ের জন্য বরাদ্দ কতই বা জায়গা? এত বই বইমেলা থেকে কিনলেও সেগুলো 'ইউজ অ্যন্ড থ্রো', শাশ্বত মূল্য নেই। এমনকী জীবনানন্দ, যামিনী রায়, সত্যজিৎ রায়- মানে কালচারাল আইকন হয়ে উঠেছেন যাঁরা, তাঁরা আছেন কারণ এদের দেখে বোঝা যায় যে আমাদের নির্দিষ্ট পেডিগ্রি আছে, যেমন কুকুরের থাকে। লিটল ম্যাগাজিনের সূত্রে সুনীলের সাহিত্যে প্রবেশ বলে তাঁর নিজস্ব এক প্রতিষ্ঠা ছিল। এখন তো তুমি কোথায় চাকরি করো, সেই জন্য তুমি বিখ্যাত। ইন্ড্রাস্ট্রি থেকে বেরিয়ে এলেই তুমি সধারণ, তোমাকে কেউ পাত্তাও দেবে না। সাহিত্যেও তোমার ভূমিকা নেই। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্য। জীবনানন্দ এক জীবনে যত কবিতা লিখেছেন আজকাল একটা বইমেলাতেই যে কোনও কবি তার চেয়ে ঢের বেশি লিখে ফেলেন।
মধুরিমা: কারণ মুনাফা ও বাজার বেশি বেশি উৎপাদন চাইছে?
সঞ্জয়: একদম! তোমাকে নিরন্তর লিখতে হবে কারণ বাজার নিরন্তর প্রোডাকশন চায়। তুমি একটা ভালো জিনিস করেছো বলে সেটা রেখে দেবে, যুগে যুগে তাই ব্যবহৃত হবে তেমন আর নেই। আমাদের আসবাব, পোশাক যেভাবে বদলায় বইয়ের মোড়কও সেভাবেই বদলাবে। আর গভীরতা হলো সবচেয়ে লঘু! যাদের কবিতায় দ্রুত অন্তমিল, বাণী বিতরণ, সমাজের ভালো-মন্দ দ্রুত ঠিক করে দিতে পারে, ঈশপের নীতিকথার মতো দ্রুত, চকলেটের মতো সমাজ বদলের প্রতিশ্রুতি দেয়, তাঁরাই লেখক।
মধুরিমা: এসবের মাঝে সোশ্যাল মিডিয়াকে অস্বীকার করা তো যায় না...
সঞ্জয়: সোশ্যাল মিডিয়া ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ধ্রুপদী সাংবাদিকতার কথা ধরা যাক। প্রিন্ট, বা ইলেকট্রনিক্স- তার যা অবস্থা হয়েছে তাতে মানুষ আর সেই সাংবাদিকতাকে গুরুত্বও দেয় না। কেউ মনেও করে না সেই সাংবাদিকতার পিতা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, যার বাড়িটা ভেঙে অন্য বাড়িও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া গণতান্ত্রিকভাবে মানুষের মতামত প্রকাশের অধিকার দিচ্ছে। এবার দেখো, বেস্টসেলারের কোনও মাপ হয় না। ইংল্যান্ডে ২০-২৫ হাজার টাকার বই বিক্রি হলেও সেটা বেস্টসেলার। আমাদের এখানে মূলত লাইব্রেরিতে বিক্রির উপরই সবটা দাঁড়িয়ে। কাউন্টার সেল খুবই কম। আমরা আমাদের বন্ধুদের বই কিনি, বন্ধুরা আমাদের বই কেনে, অনেকটা বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন। তুমি আমাকে নিমন্ত্রণ করলে, আমিও পালটা করলাম। তাতে বেস্টসেলিং নেই। সোশ্যাল মিডিয়া কুমারী বাজার। তাতে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য প্রকাশকদের তুমুল আগ্রহ। ডিজিটাল মেমোরি তো প্রবল নয়, অমরত্ব দিতে পারে একমাত্র প্রিন্ট। তাই আমাদের কিছু নস্টালজিয়া কাজ করে। আহা! পথের পাঁচালি বই হয়ে ছাপা হয়েছিল, আমার লেখা কেন বই হবে না? এই যে দুর্বলতা, এই যে স্মৃতি মেদুরতা- তাই নতুন লেখকদের প্রকাশকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
মধুরিমা: আমাদের ডিজিটাল জীবন অত্যন্ত দ্রুত, তাতে প্রতি স্ক্রলে জীবন পালটে যাচ্ছে। অথচ শিকড়ে আমরা এখনও নস্টালজিক বাঙালি। একটা যদি বই বেরোত... এই আশা আর দ্রুতগামিতার ভারসাম্য রাখতে গিয়েই কোথাও কি 'মাস’-এর কথা ভাবতে হচ্ছে? দীক্ষিত পাঠক ধারণাটা এখন কীভাবে রয়েছে?
সঞ্জয়: নেইই। দেখবে, এখন একটা কথা শোনা যাচ্ছে, "আমার একটা বই বেরিয়েছে, দেখো"। আজকাল আর কেউ বইটা পড়তে বলে না। দেখো! আমরা যাইনি মরে আজও তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়, এই দৃশ্যের জন্মটাই আসল। ফেসবুকে আমরা কালীপুজোর শ্যামাপোকা, প্রতিদিন যাদের জন্ম হয়, প্রতিদিনই মৃত্যু হচ্ছে- বই সেক্ষেত্রে একটু ধ্রুপদী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এবং আমাদেরও কোনও কোনও মুহূর্তে স্মৃতিমেদুর হয়েই মনে পড়ছে, বিভূতিভূষণ বই লিখতেন, ওয়েব সিরিজে আসেতেন না। নেটফ্লিক্স বা মুবির সম্পত্তি ছিলেন না। আমাদের প্রথম প্রেমিকাকে দেখলে যেমন মমতা জাগে, তেমনভাবেই মনে হয়, আহা একটা বই হোক না। এই দুর্বলতাকেই প্রকাশকরা ব্যবহার করেন।
মধুরিমা: একটা প্রশ্ন তাহলে আসেই, পকেটে যারা মধ্যবিত্ত তারা ব্র্যান্ডভ্যালুকে ধরবে কীভাবে? যে যে প্রকাশনার কথা হচ্ছিল, তারা ব্র্যান্ড তৈরি করতে গিয়ে বইয়ের খরচও বাড়াচ্ছেন। খরচ বৃদ্ধির সমস্ত দিক মাথায় রেখেও প্রশ্ন জাগছে, এক একটা বইয়ের দাম যা দাঁড়াচ্ছে তাতে বই সাধারণ নিবিড় পাঠকের নাগালে থাকছে না। পড়াশোনার মৌলিক অধিকারের জায়গা থেকে একটা বড় অংশ কি সরে যাচ্ছে এভাবেই?
সঞ্জয়: তোমার সঙ্গে একমত। সংস্কৃতির মফসসলে, এই ধরনের সুদৃশ্য বই, তার যা অঙ্গসজ্জা, বাঁধাই তাতে তা ঘর সাজানোর উপঢৌকন হয়ে উঠছে। অনেকে সেই জন্যও অবশ্য কেনে। এই বই সংখ্যাতেও কম ছাপা হয়, কম বিক্রিও হয়। শহর কলকাতায় এখন একটা 'এলিট ক্লাসের' জন্ম হয়েছে যাঁরা উদারীকরণ নীতির ফলে অর্থবান। তাঁদের আয়করের যা পরিমাণ, তারা অন্য জিনিস যা দামে কেনেন তাতে মনে করেন একটা বইয়ের দাম ১০০০ হলে ক্ষতি নেই কারণ একটা শাড়ি বা ট্রাউজার কিনতেই ৫০০০ টাকা লাগে।
আরও পড়ুন- এক চিলতে জমি থেকেই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন, যে দাগ রেখে যাচ্ছে ছোট প্রকাশনা
মধুরিমা: কিন্তু এদের সংখ্যা তো বিপুল নয়। সাধারণ মানুষের সংখ্যা আজও বেশিই। তারা তো বইয়ের কাছে পৌঁছতে পারছে না। যে ক্লাসের কথা বলছেন, তাঁদের কাছে পড়াশোনা বা দামী বই লাইফস্টাইলের অঙ্গ হতে পারে, বাকিদের কাছে তো পড়াশোনাটা প্রয়োজন, বিনোদন না।
সঞ্জয়: তোমার কাছে পড়াশোনা আত্মার পানীয়, অন্নজল। কিন্তু এদের কাছে একটা ভালো ডেনিম পরা আর হাতে একটা সুদৃশ্য বই থাকা একই- তা এক ধরনের জীবনযাত্রার ইঙ্গিতবাহী। এই বইগুলো পড়া হচ্ছে বলে তো আমার মনে হয় না। এগুলো দেখা হচ্ছে বা দেখানো হচ্ছে। আমি আগেই বলেছি, বিরাট লাইব্রেরি কলকাতায় কারও বাড়িতেই দেখবে না। বইমেলার বইগুলো তাহলে যাচ্ছে কোথায়?
মধুরিমা: মফসসলের কথা বললেন যেহেতু, একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। বেস্টসেলিং ধারণাটাই কি রাজধানীকেন্দ্রিক নয়? মফসসলের বইমেলায় কাউকে কোনওদিনই সেভাবে জিজ্ঞেস করতে শুনিনি এবারের বেস্টসেলার কী!
সঞ্জয়: ওই যে বললাম, বইকে একটা অংশে প্রোডাক্ট মনে করা হচ্ছে। পুজোয় কোনও কোনও শাড়ি বেস্টসেলিং হয়, কোনও কোনও জিনিস হঠাৎ খুব বিখ্যাত হয়ে যায়, সবাই কেনে। তেমনই বইকেও জ্ঞানচর্চা বা সংস্কৃতি চর্চার বদলে যখন দ্রব্য হিসেবেই ভাবা হলো তখনই বেস্টসেলিং এল। যাদের আজকাল বেস্টসেলিং বলা হয়, তাদের বিক্রির যদি সংখ্যা পাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, আশাপূর্ণা দেবী, বিমল মিত্র, নিমাই ভট্টাচার্য বা নবকল্লোলের লেখকরা, শরৎচন্দ্র তো বাদই দিলাম, তাঁদের তুলনায় এরা লেখকই না। শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ বা শ্রীকান্ত যত বিক্রি হতো এখন কোনও ঔপন্যাসিকের লেখা অত বিক্রিই হয় না, সম্ভবও না। বিবরের বিক্রি আজকের কোনও উপন্যাস ছুঁতে পারবে না। বেস্টসেলিং একটা তকমা, বিজ্ঞাপনের ক্যাচ লাইনের মতো। কমল মজুমদারের লেখা যারা সাজিয়ে রাখে তারা এইজন্যই রাখে যে, আমরা ভাই উপজাতিদেরও মানুষ বলে মনে করি।
মধুরিমা: মানে 'জাতে তোলার' ব্যাপার...
সঞ্জয়: হ্যাঁ, পড়ার জায়গা থেকে না। বেস্টসেলিং হচ্ছে, তুমি র্যাংলারের জিন্স যে প্রবণতা থেকে পরো সেই প্রবণতা থেকেই বইটা কেনো, সংস্কৃতি মূল্য নেই।
মধুরিমা: লেখক হিসেবে আপনার তৃপ্তি কীসে হয়? আপনার বই সকলে হামলে পড়ে কিনল, অথবা বহুকাল পরে আপনার লেখা পড়ে কেউ তর্ক করতে এল, আলোচনা করতে এল। কোনটা?
সঞ্জয়: অমিয়ভূষণ বলতেন, রূপসীর কৃপণ হাসি গণিকার প্রগলভতার তুলনায় আদরণীয়। হ্যাঁ জনপ্রিয়তা ভালো লাগে, তবে শুধু যদি সেটাই চাইতাম, আমি লিখতাম না, অভিনয় করতাম, খেলতাম। যেখান থেকে নাদাল বা মেসি তৈরি হয়। একজন লেখকের পক্ষে মেসি হওয়া সম্ভবই হবে না। মাও সে তুং বা মেসি আমার আদর্শ তখনই হবে যদি জনপ্রিয়তা আমার লক্ষ্য হয়। যদি লেখা আমার কাজ হয়, জন কীটস বা জীবনানন্দকেই নেব সঙ্গে। এঁরা অনশ্বর হওয়ার জন্য সংখ্যালঘু থেকে গেছেন, চিরকাল, চিরকাল। এক বিরল মুহূর্তে যখন কোনও যুবক বা যুবতী আমার চোখে চোখ রেখে আমার লেখাকে ভালো বা খারাপ বলে, সেটা প্রথম চুম্বনের মতো স্বাদ দেয়। জনতার মাইল মাইল সমুদ্রে একজন হয়ে ওঠা কোনও বিষয় না, সে তো মন্ত্রীরাও হয় নির্বাচনের আগে।