ভাদু উৎসব

 বর্ষার শেষে আকাশ এখন নীল, সাদা  মেঘের ভেলা ভাসছে আকাশে, কোথাও আবার কাশফুলের দেখা মিলেছে । গোটা প্রকৃতি জানান দিচ্ছে   উমার  পিতৃগৃহে  ফেরার সময় আগত । এখন ঢাকের বাদ‍্যি শোনার   অপেক্ষায় দিন গুনছে গোটা বাংলা ।  ঠিক এই সময়, রাঢ় বাংলায় ঘরে   ফেরে ভাদু দেবী । পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া ও   মেদিনীপুরের কিছু অংশে এবং পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া বিহার ও ঝাড়খণ্ডের   কিছু অংশে সমগ্ৰ ভাদ্র মাস জুড়ে চলে এই ভাদু পরব । ভাদু দেবীর   আবির্ভাব সম্পর্কে একাধিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে । অনেকে মনে করেন,  পুরুলিয়ার রঘুনাথগঞ্জ মহুকুমার অন্তর্গত কাশীপুরের রাজা নীলমণি  সিংহদেওয়ের কন‍্যা  ভদ্রাবতীর নাম অনুসারে এই পরবের নাম হয়েছে ভাদু । অনেক গবেষকদের মতে, রাজকুমারীর জন্ম আনুমানিক ১৮৪১ সালে। যদিও পঞ্চকোট রাজবংশলতিকায় ভদ্রাবতী নামে কোন রাজকুমারীর উল্লেখ  পাওয়া যায়নি কিন্তু রাজা নীলমণি সিংহদেওয়ার নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় । শোনা যায়, ভদ্রেশ্বরী বা  ভদ্রাবতীর সাথে বাগদত্তা বর্ধমানের রাজকুমারের বিবাহ সম্পন্ন না হ‌ওয়ায় তিনি আত্মহত‍্যা করেন । বর বেশে রাজকুমার বিবাহের উদ্দেশ্যে র‌ওনা হলে, রাস্তার লাঠিয়ালের হাতে তাঁর প্রাণ যায় । রাজকুমারী ভদ্রাবতীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই এই ভাদু পরবের সূচনা ঘটে । অনেকের মতে আবার, রাজকুমারী এক অন্ত‍্যজ শ্রেণীর কুমারকে ভালোবাসলে রাজা নীলমণি তা মেনে নেয়নি তাই রাজকুমারী ভদ্রাবতী আত্মঘাতী হন । রাজা তাঁর মেয়েকে হারিয়ে স্মৃতির উদ্দেশ্যে ‘ভাদু’ উত্সবের প্রচলন ঘটায় । অনেকে মনে করেন প্রেম নয় কোন বিশেষ ব‍্যধিতে মৃত‍্যু ঘটে রাজকুমারীর ।   

          অনেকে আবার কৃষ্ণপ্রেমী মীরাবা‌ঈয়ের সাথে ভাদুর তুলনা করেছেন । জন্ম থেকে তিনি ছিলেন কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা । রাজা তাঁর বিয়ে ঠিক করলে মন্দিরে ধ‍্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি প্রাণত‍্যাগ করেন । আবার কিছুজনের মতে ভাদু ছিলেন বাঁকুড়ার মল্ল রাজাদের কন‍্যা। ভাদু নিয়ে নানান মত শোনা গেলেও কাশীপুর রাজবাড়ির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ভাদু গান রচিত হয়েছে  –

কাশীপুরের রাজার বিটি , আদরের দুলালী গো

ভাদুর জন্ম ও মৃত‍্যু দুই ভাদ্র মাসে । তবে অনেকে আবার বলে থাকেন, ভাদ্র মাসে পঞ্চকোট ও ছাতনার রাজার মধ‍্যে এক যুদ্ধ হয়, বিজয়ী হন পঞ্চকোটের রাজা । সেখান থেকেই ভাদু উৎসবের প্রচলন । রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় হারমোনিয়াম সহ বিভিন্ন বাদ‍্যযন্ত্র সহযোগে মার্গধর্মী উচ্চ সাহিত‍্যগুণ নির্ভর একধরনের ভাদু গান গাওয়া হতো । এই পরিবারের প্রকৃতীশ্বরলাল সিংদেও, রাজেন্দ্রনারায়ণ সিংদেও দরবারী ভাদু নামে এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেছিলেন কিন্তু সাধারণত যে ভাদু গান এই পরবে শোনা যায়, তা একেবারেই সরল-সাদা মাটির গান । গানের কথাতেও আঞ্চলিক ভাষার বহুল ব‍্যবহার লক্ষ‍্য করা যায় ।

          খুব সহজ ভাবে বলতে গেলে, যেহেতু এই পরব ভাদ্র মাসে পালন করা হয় এই কারণেও এর নাম হয়ে থাকতে পারে ভাদু । ভাদু আসলে টুসুর মতোই ফসলের উৎসব । রাঢ় বাংলার হতদরিদ্র মানুষের অভাবের মাস ভাদ্র । রাঢ় অঞ্চলের উঁচু-নীচু অনুর্বর জমিতে এই সময় বিশেষ কোন ফসল হয় না । ভাদু হল এক কল্পিত শস‍্য উর্বরতার দেবী বা বলা ভালো মানসকন‍্যা । এই কারণেই সম্ভবত ভাদু মূলত নিম্নবর্গীয় মানুষদের মধ‍্যেই বেশি প্রসিদ্ধ । রাজবাড়ি থেকে এই উৎসবের প্রচার হয়ে থাকলে এই বিভেদ থাকার কথা যদিও ছিল না ।  

       ভাদ্র মাসের শুরুর দিন থেকেই রাঢ়বাংলায় শুরু হয় ভাদুর আরাধনা । ভাদু কখনো মাতৃরূপে আবার কখনো বা কন‍্যারূপে পূজিত হয়ে থাকে । এই পূজায় বিশেষ জাকজমক লক্ষ‍্য করা যায় না , মূলত গ্ৰামের কুমারী মেয়েরা এবং বিবাহিত মহিলারা এই পূজা করে থাকেন, পূজায় থাকে না কোন পুরোহিত । কোথাও বা পুরুষেরাও এই পূজা করে থাকেন । ভাদুর পুরুষ মূর্তিরও চল আছে বিভিন্ন জায়গায় । কোথাও কোথাও মূর্তির চল আছে আমার কোথাও ভাদু দেবী অবস্থান করেন কেবল কল্পনায় । ভাদু পূজার রীতি অনুযায়ী মূর্তি স্থাপন করতে হয় পিড়িতে । প্রসাদ হিসাবে বানানো হয় রকমারি খাজা-গজা এবং জিলিপি । এই পরবকে কেন্দ্র করে মেলাও বসে বিভিন্ন অঞ্চলে । বিভিন্ন পেশাগত গায়ক-গায়িকারা ভাদু গীত পরিবেশন করে থাকেন । ভাদু গান মূলত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথা বলে, গল্প বলে দুঃখ- দুর্দশার । পাঁচালীর সুরে এই গান গীত হয় । ভাদু সমগ্ৰ রাঢ় বাংলার উৎসব হলেও বিশেষ প্রসিদ্ধ বাঁকুড়া জেলায় ।

         অনেকে মনে করেন , ভাদ্র মাসে যে সমস্ত লক্ষীপূজা হয়ে থাকে তার‌ই এক আলাদা পরব হিসাবে রাঢ় বাংলায়  স্থান কেড়েছে ভাদু । গোটা ভাদ্র মাস জুড়ে চলতে থাকে ভাদু পরব । ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদু মূর্তি ভাসান দেওয়া হয় । সমগ্ৰ রাঢ় বাংলায় সেদিন শোনা যায় বিষাদের সুর –

ভাদু যায়ো না জলে

কোলের ভাদু যায়ো না মোরে ছেড়ে

গটা ভাদর থাকলে ভাদু গো

মা বলে তো ডাকলে না

 

মানুষ প্রতিনিয়ত যে হারে পা বাড়াচ্ছে শহরের পথে, তাতে বাংলার বিভিন্ন লোকজ উৎসব আজ কোনক্রমে টিকে আছে । সময়ের সাথে হারিয়েও গেছে বহু গানের সুর, বহু সংস্কৃতি । আজ ইট সুড়কির পথে পা বাড়ানো মানুষগুলোর উপস্থিতির অভাবে ভাদু পরবের মেজাজ আর আগের মত প্রায় নেই বললেই চলে । ভাদু এখন  খানিকটা অঞ্চলভিত্তিক  পরবে পরিণত হয়েছে ।

 

 

তথ্য সূত্র –

Website : www.anandabazar.com

bn.banglapedia.org

thebengalstory.com

More Articles