কাদম্বরী দেবীকে সারাজীবন স্মৃতিতে ধরে রাখলেন রবীন্দ্রনাথ
ভালবাসার সামগ্রিক কোনও ব্যাকরণ হয় কি না জানি না, ভালবাসার কারক প্রকরণ হলেও হতে পারে। বাক্যে ক্রিয়াপদের সঙ্গে অন্য পদের যে সম্পর্ক তাই কারক সম্পর্ক। যদি লিখি ‘রাম সীতাকে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে অযোধ্যা থেকে বনে পাঠিয়ে দিলেন’ তাহলে এই বাক্যে ‘পাঠিয়ে দিলেন’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে অন্য পদের সম্পর্ক নানা রকম– সেই সম্পর্ককে ব্যাকরণের ভাষায় কারক সম্পর্ক বলা চলে। কে বনে পাঠালেন? রাম। প্রজানুরঞ্জক রাম? সীতা প্রজা নন বুঝি তাঁর? গর্ভবতী রমণী প্রজা নন? যা-হোক রাম তো বাক্যের কর্তা, ক্ষমতাশালী কর্তা। তিনি কর্তৃকারক। কাকে বনে পাঠালেন? সীতাকে। জনকদুহিতা, অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণা সীতাকে। ক্ষমতাহীন, রামের ইচ্ছাধীন সীতা কর্মকারক। কোথা থেকে রাম তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন? অযোধ্যা থেকে। রামের অযোধ্যা, পিতৃসত্য পালন করে বনবাস থেকে ফিরে এসে ফিরে পাওয়া পিতৃরাজ্য অযোধ্যা। সেই অযোধ্যা থেকে সীতা নির্বাসিত। অযোধ্যা অপাদানকারক। কোথায় পাঠালেন সীতাকে? বনে। রামরাজত্বের বাইরের সেই বনে সীতা ঠাঁই পেলেন, জায়গা পেলেন। বন সীতাকে ফেলে দিল না, কোলে করে রাখল। এ অধিকরণকারক। এই বাক্যে আরও একটা ক্রিয়াপদও আছে। ঠেলতে ঠেলতে– অসমাপিকা ক্রিয়া। কী দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বনে পাঠালেন? হাত দিয়ে। পুরুষের হাত, ক্ষমতাশালী রাজার হাত। হাত করণকারক। এই যে ক্রিয়ার সঙ্গে অন্যপদের সম্পর্ক, তাই কারক সম্পর্ক। ভালবাসাও কি ক্রিয়া নয়? দু'জনের সাপেক্ষে দু'জনের যে ক্রিয়া, তাই তো ভালবাসা। সেই তো ভালবাসার কারক-প্রকরণ।
এ-পর্যন্ত লিখেই অবশ্য থামতে হয়– কারকের ছাঁচে পুরোপুরি ফেলা যাবে না দু'জনের ভালবাসাকে, ভালবাসার ধারণাকে, তবু হয়তো অনেকটাই মিলিয়ে দেওয়া যাবে। ভালবাসার মধ্যে ভাল-না-বাসাও থাকে মিশে, যেমন শৃঙ্গারের মধ্যে মিশে থাকে মিলন ও বিরহ; সম্পর্কের মধ্যে মিশে থাকে না-সম্পর্কের শীতলতা। সেই শীতলতা কিংবা নীরবতা বড় অসহ্য সংবেদনশীল মানুষের কাছে– গালিব তাই বলেন, ‘সব সম্পর্ক ছিন্ন করবেন না, যদি আর কিছু না থাকে তবে শত্রুতাই থাক।’ সম্পর্কের মধ্যে নীরবতার শীতলতাকে কেবল কি গালিব ভয় করতেন? ভয় করতেন রবীন্দ্রনাথও। কাদম্বরীর মৃত্যু হল। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, অভিমানে আত্মহত্যা করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির সম্মানরক্ষার্থে সে মৃত্যু সম্বন্ধে নীরবতা পালনই তখন পরিবার-পুরুষদের নির্দেশ। যিনি চলে গেলেন, তাঁর স্মৃতি মুছে দেওয়াই তখন পরিবার-পুরুষদের সামাজিক রীতি। ‘রুদ্ধ গৃহ’ নামের রচনায় রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন, এখানে মৃত্যুরও মৃত্যু হয়েছে।
বৃহৎ বাড়ির মধ্যে কেবল একটি ঘর বন্ধ। তাহার তালাতে মরিচা ধরিয়াছে, তাহার চাবি কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। সন্ধ্যাবেলা সে ঘরে আলো জ্বলে না, দিনের বেলা সে ঘরে লোক থাকে না–এমন কতদিন হইতে কে জানে।
সে ঘর খুলিতে ভয় হয়, অন্ধকারে তাহার সমুখ দিয়া চলিতে গা ছম্ছম্ করে। যেখানে মানুষ হাসিয়া মানুষের সঙ্গ কথা কয় না, সেইখানেই আমাদের যত ভয়। যেখানে মানুষে মানুষে দেখাশুনা হয় সেই পবিত্র স্থানে ভয় আসিতে পারে না।
দুইখানি দরজা ঝাঁপিয়া ঘর মাঝখানে দাঁড়াইয়া আছে। দরজার উপর কান দিয়া থাকিলে ঘরের ভিতর যেন হু হু শব্দ শুনা যায়।
এ ঘর বিধবা। একজন কে ছিল সে গেছে, সেই হইতে এ গৃহের দ্বার রুদ্ধ। সেই অবধি এখানে আর কেহ আসেও না, এখান হইতে আর কেহ যায়ও না। সে অবধি এখানে যেন মৃত্যুরও মৃত্যু হইয়াছে।
মানুষ তো মারা যাবেই– সেই চলে যাওয়ার পর তাঁর থেকে যাওয়া স্মৃতিতে, কথায়। অন্যরা তাঁর কথা ভাবছেন, বলছেন। তখন মৃত্যু জীবনের মধ্যে ঠাঁই পায়। যদি সেই ভাবনা আর কথার ওপর জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা– তখন মৃত্যুরও মৃত্যু হয়। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুকেও মেরে ফেলতে চাওয়া হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ– সারাজীবন ধরে কাদম্বরী দেবীকে ঠাঁই দিলেন তাঁর স্মৃতিময় রচনায়। রবীন্দ্র-স্মৃতি ধরে রাখল কাদম্বরীকে, স্মৃতিই অধিকরণ।
আরও পড়ুন: একই মানুষের বহু যৌনসম্পর্কে আগ্রহ, কেন এমন হয়!
ভালবাসার মৃত্যু হলেও ভালবাসা স্মৃতিতে বেঁচে থাকে, কিন্তু ভয়ংকর হল ভালবাসার মৃত্যুর মৃত্যু। যাকে ভালবাসছি, বেসেছি, তার কোনও স্মৃতিচিহ্নই যদি আর না থাকে! সেখানেই ভালবাসার মৃত্যুরও মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথ প্রেম থেকে চলে যাওয়া মেনে নেন, ভালবাসার মৃত্যুও মেনে নেন, কিন্তু ভালবাসার মৃত্যুর মৃত্যু মেনে নিতে পারেন না কিছুতেই। ‘যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।/ যদি থাকি কাছাকাছি,/ দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি/ তবু মনে রেখো।’ এখানে প্রেমের মৃত্যু হয়েছে, নতুন প্রেমের জালে হারিয়ে গেছে পুরাতন প্রেম, কিন্তু প্রেমের মৃত্যুরও মৃত্যু যাতে না হয় তারই জন্য কবির এই আকুতি, ‘তবু মনে রেখো।’
আচ্ছা, আমরা কি ক্রমশই মেনে নিচ্ছি ভালবাসার মৃত্যুর মৃত্যু! আমাদের স্মৃতি কি ক্রমশই হয়ে উঠছে স্বল্পায়ু! এই যে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমাদের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠছে নানা বিকল্প পণ্য, জিনিস, বস্তুপ্রপঞ্চ- তাই কি আমাদের ক্রমশই ক্ষীণস্মৃতি মানুষে পরিণত করে তুলছে? ঋষির অভিশাপে রাজা দুষ্মন্ত হারালেন শকুন্তলার স্মৃতি। শকুন্তলাকে বিবাহ করেছেন, তাঁর সঙ্গে যাপন করেছেন প্রণয়-মুহূর্ত- তা বেবাক ভুলে গেলেন রাজা। সেই বিস্মৃতি থেকে স্মৃতির পথে ফেরার একটাই উপায় নির্দিষ্ট ছিল আদি মহাভারতে, কালিদাসের নাটকে। তাঁর হাতে যদি আসে সেই সম্পর্কের ইঙ্গিতবাহী কোনও চিহ্ন, অভিজ্ঞান, তাহলেই মনে পড়বে আবার সব কথা। তাঁর মন, ভালবাসার মন, ঢেকে দিয়েছিল যে বিস্মৃতি, তা এবার সরে যাবে– যেমন সরে যায় মেঘ ও কুয়াশা, তেমনই সরে যাবে বিস্মৃতি। জেগে উঠবে কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো স্মৃতির মিনার। সত্যজিতের ছবি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’– সে ছবিতেও মেঘ আর কুয়াশা সরে যেতেই হিমালয়ের শৃঙ্গ আত্মপ্রকাশ করল। সে ছবিতে যে দম্পতির বিচ্ছেদ আসন্ন হয়ে উঠছিল, সেই বিচ্ছেদের চাদর সরে, উঠল জেগে, ফেলে-আসা মিলনের ছবি। আংটি, অঙ্গুরীয়, কালিদাসের নাটকের পরম অভিজ্ঞান– প্রেমের স্মৃতিতে ফেরার বস্তুগত অভিজ্ঞান সেই আংটি।
অথচ বস্তু, অজস্র-অনন্ত বিকল্প বস্তুই কি এখন আমাদের স্মৃতিহারা করে তুলছে? আজ যে জিনিস কিনতাম, কাল অন্য জিনিস দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করছি। আজ সাদা পেস্ট, কাল লাল, পরের দিন নীল– কোনও একটার স্বাদ স্থায়ী হচ্ছে না দাঁতে আর মুখে। একই বর্গের মধ্যে কত পণ্য– কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনি? কবি যশোধরা লেখেন ‘পণ্য থেকে পণ্য নিলে পণ্যই থেকে যায়।’ তখন এদেশে সবে মুক্ত অর্থনীতি প্রবেশ করেছে, গত শতকের নয়ের দশকের প্রথম দিক। অনেক, অনেক, চারিদিকে শুধুই অনেক। এককে কোথায় পাই! চোখ ঘুরছে এক থেকে আর একে। এই জামা থেকে ও-জামায়, এ-শাড়ি থেকে ও-শাড়িতে, এ-বাইক থেকে ও-বাইকে, এ-নারী থেকে ও-নারীতে, এ-পুরুষ থেকে আর পুরুষে। আমাদের এই পণ্য-সংহিতায় যে কারকটি বড় প্রবল, তার নাম অপাদানকারক।
আমরা অপাদানকারক লিখছি। দিনগুলি রাতগুলি ধরে-ধরে লিখছি।
রামের আঁখি-পাখি জিন্স ও টপ পরিহিত সীতার থেকে হাফ-প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা সীতার দিকে ধায়।
রামের আঁখি-পাখি হাফ-প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা সীতার থেকে ফিনফিনে শাড়ি পরা সীতার দিকে ধায়।
রামের আঁখি-পাখি তন্বী শ্যামা সীতার গ্লসি ঠোঁট থেকে তন্বী-শ্বেত সীতার লাল উষ্ণ ঠোঁটের দিকে ধায়।
সীতার আঁখি-পাখি উদ্ধত-ডেনিম যুবার থেকে বাইক যুবার দিকে যায়।
সীতার আঁখি-পাখি সানগ্লাস যুবার থেকে এককানে দুল যুবার দিকে যায়।
সীতার আঁখি-পাখি টল-হ্যান্ডসাম কোট-টাই শোভিত যুবার থেকে বন্য-রুক্ষ গেঞ্জি-দাড়ি যুবার দিকে যায়।
এই যে প্রতি মুহূর্তে আমাদের চোখ পাখির মতো উড়ু-উড়ু, প্রতি মুহূর্তে বস্তুর অনুষঙ্গে চলে যাচ্ছে এক একজন নারী বা পুরুষের দিকে, এই যে আমাদের ঝটিতি সফর এক থেকে আর একে তা যেতে যেতে, প্রতি মুহূর্তে যেতে যেতে, ক্রমশই দাঁড়াতে ভুলে যাচ্ছে। ক্রমশই ভুলে যাচ্ছে আগে যাকে দেখেছিল তাকে। আমাদের এই দ্রুত-গতি যাত্রা, যা অপাদানকারকের মূল– এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, এক পণ্য থেকে আরেক পণ্যে, এক শরীর থেকে আরেক শরীরে- তা স্মৃতিহারা করে দেয় আমাদের ক্রমশ। আমরা একজনকে চোখ দিয়ে দেখি মাত্র, মন দিয়ে দেখি না। মনে রাখি না। মনে রাখার আগেই অন্যত্র চলে যাই। আমাদের মন তার অধিকরণ হয়ে ওঠে না। চোখের সামনে দিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে সরে-সরে যায় কার্টুন-চ্যানেলের কার্টুনের ফ্রেম, মনোবিজ্ঞানীরা বলেন এই দ্রুতি দর্শকদের মনে স্মৃতিধার্যতার সময় দেয় না।
এই যে আশ্চর্য এক অপাদানকারকের জগতে বিহার করছি আমরা, বিহার করছি পণ্যের বিকল্প প্রাচুর্যে, তা ক্রমশই আমাদের স্মৃতিহারা করে তোলে মানুষ ও বস্তু সম্পর্কে।
যে জগতে এমন বিকল্প পণ্য ছিল না, সে জগতে পণ্যেরও প্রাণ ছিল। অপ্রাণী-বাচক বস্তুপ্রপঞ্চের ওপর আমরা প্রাণের মহিমা আরোপ করতাম। সুবোধ ঘোষ লিখতে পারতেন ‘অযান্ত্রিক’-এর মতো গল্প। সুবোধ ঘোষ লেখেন, "বিমলের একগুঁয়েমি যেমন অব্যয় তেমন অক্ষয় তার ট্যাক্সির পরমায়ু।... দেখতে ... জবুথবু, কিন্তু কাজের বেলায় অদ্ভুতকর্মা।" বিমল তার গাড়িকে ডাকে জগদ্দল। খনি অঞ্চলের লাইনের ড্রাইভাররা গাড়ির প্রতি বিমলের এই ঐকান্তিকতা দেখে ঠাট্টা করে। "পিয়ারা সিং বিমলকে টিটকিরি দিয়ে কথা বলে, ‘আর কেন, এ বিমলবাবু? এবার তোমার বুড়িকে পেনশন দাও।’ ‘হুঁ, তারপর তোমার মতো একটা চটকদার হাল-মডেল বেশ্যে রাখি।’ বিমল সটান উত্তর দেয়।" আমরা অপ্রাণীকে প্রাণিত্বে উন্নীত করি না। আমরা স্মৃতিকে ধারণ করি না। আমরা গাড়ি বদলাই, নারীও বদলাই, নারীরও পুরুষ বদলে যায়– আমাদের জীবনে অপাদানকারক সত্য, একমাত্র সত্য। এই অপাদান স্মৃতিহারা অপাদান।
যদি এ সত্যি হয়, তাতে দোষ কোথায়?
এই কি মানুষের ধর্ম নয়?
রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম’ লেখায় ছিল মানুষের আছে পথ, পশুর আছে গুহা। মানুষ চলেছে– চলাটাই তার ধর্ম। নিত্যনূতন ঔৎসুক্যে সে এগিয়ে যায়। যদি তাই হবে, তাহলে কেন এই কান্নাকাটি, বিষাদ – অপাদানকারক নিয়ে এত আপত্তি। অন্তত প্রকাশ্য স্পষ্টতায় না বললেও ঠারে-ঠোরে তো বলাই হচ্ছে সেই আপত্তির কথা।
না, মানুষের ধর্মে যে চলার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই চলার সঙ্গে চোখের, স্মৃতিহারা মনের এই চলাচলের মিল নেই কোনও। এক পণ্য থেকে আরেক পণ্যে অনবরত বিহারের মতো এক শরীর ও মন থেকে আরেক শরীর ও মনে যে ক্রমাগত চলে চলে যাওয়া- এ তো ঠাঁই দেয় না ‘তবু মনে রেখো’-র আকুতিকে।
এই যাত্রায় অধিকরণ নেই, কেবল অপাদান আছে। কোথায় রাখব? মনে। মন কী? মন অধিকরণ– স্থানাধিকরণ।
যে যাত্রায় অধিকরণ নেই, কেবল অপাদান আছে, সেই যাত্রাকে বড় নির্মম বলে মনে হয়।
অধিকরণহীন, স্মৃতিহীন মানুষ ধর্ষণ করে নির্বিকার চলে যেতে পারে।
অধিকরণহীন, স্মৃতিহীন মানুষ খুন করে চলে যেতে পারে।
উপাদান আর অধিকরণহীন অপাদানের যাত্রায় আমরা যারা নিয়োজিত, তারা দানব না দেবতা উত্তর মেলে না! সত্যি কি মেলে না!