বিয়ের মরীচিকায় ধরা দেয়নি শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর প্রেম
রবি ঠাকুর, আপনাকে শরৎচন্দ্রর হয়ে আজকাল চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে। আপনি শরৎচন্দ্রকে একটু ঘুরিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। যে-কথা প্রকাশ্যে স্পষ্ট বলতে পারেননি, সে-কথাই বলিয়েছিলেন বঙ্গদেশের প্রেমে হেরে-যাওয়া সাধারণ এক মেয়ের মুখ দিয়ে। ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতাটি একসময় আবৃত্তিকারদের বড় প্রিয় ছিল, তখন 'বাচিকশিল্পী' শব্দটি একালের মতো এমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবে বাঙালি শ্রোতারা আবৃত্তিকারদের কণ্ঠশিল্পী বলেই মনে করতেন। তাঁদের কণ্ঠে সেই সাধারণ মেয়ের আকুতি মনকেমনিয়া বাঁশির মতো কানে বাজত।
কবিতার মেয়েটি ভালবেসেছিল নরেশকে। নরেশ নামের ছেলেটি যখন দেশে ছিল, তখন মেয়েটিকে বলত, ‘কেউ চোখে পড়েনি’ তার ‘মতো’। তারপর নরেশ গেল বিলেতে। বিলেতে নরেশ সেনকে কদর করার মেয়ের অভাব ছিল না। তাদের সঙ্গে সমুদ্র-যাপনেও নরেশ কসুর করেনি। দেশে ফেলে আসা মেয়েটিকে শেষ চিঠিতে খবর দিয়েছিল, ‘লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্র নাইতে।’ সাধারণ মেয়েটি বুঝল, কপাল ভেঙেছে, হার হয়েছে তার। এই হেরে যাওয়া মেয়েটিকে দিয়ে, রবি ঠাকুর, আপনি লিখিয়ে নিয়েছিলেন ইচ্ছেপূরণের চিঠি। সে চিঠি লিখেছিল শরৎবাবুকে। শরৎবাবু ছাড়া মেয়েদের ইচ্ছেপূরণের গল্প কে আর লিখবেন সেদিনের বাংলা সাহিত্যে! সেই চিঠির বয়ান যে কী নাটকীয়! মেলোড্রামাটিক!
মেয়েটি বলেছিল শরৎবাবুকে, তার হয়ে একটি জিতিয়ে-দেওয়ার গল্প ফাঁদতে। সে-গল্পে মেয়েটির নাম হবে মালতী। সে গল্পে নরেশ বিলেতে থাকুক, ফেল করুক। আর ততদিনে মেয়েটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কে এমএ পাশ করুক। যেমন-তেমন পাশ নয়– শরৎচন্দ্রের কাছে তার আবদার, ‘গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।’ তারপর এই মেয়েটিও যাবে, বিলেতে। সেখানে যত জ্ঞানী, বিদ্বান, বীর, শিল্পী পুরুষরা আছে, তারা আবিষ্কার করবে তাকে। ‘কেবল বিদুষী বলে নয়, নারী বলে।’ তারপর সেই মেয়ের ‘অনারে’ ডাকা হবে সভা। সেই সভায় সবাই সেই মেয়ের চাহনিতে খুঁজে পাবে, ‘রমণীয় ভারতীয়’ দৃষ্টি। রবি ঠাকুর, আপনার কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় আপনি বুঝি মোনালিসার আশ্চর্য হাসির মতো শরৎবাবুর না-লেখা উপন্যাসের নায়িকার চোখে ধরে রাখতে চাইছেন আশ্চর্য ‘ভারতীয়’ দৃষ্টি। ‘সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র/ মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে।’ সে সভাতে আসবে নরেশ সেনও, আসবে তার সেই অসামান্য মেয়ের দল। তারা দাঁড়িয়ে থাকবে এক কোণে। দেখবে মালতীর সজল-উজ্জ্বল চোখের উপাসনায় কীভাবে ‘য়ুরোপীয় রসজ্ঞের’ দল মূর্ছা যাচ্ছে। আর তখনই হবে সাধারণ মেয়ের জয়।
আরও পড়ুন: কাদম্বরী দেবীকে সারাজীবন স্মৃতিতে ধরে রাখলেন রবীন্দ্রনাথ
শরৎবাবু তো এমন জিতিয়ে দেওয়া গল্প-উপন্যাস লেখেননি। মেয়েটির মুখ দিয়ে, রবি ঠাকুর, আপনি গল্প ‘লেখার দাবি’ তুলেছিলেন মাত্র। সে দাবি মেটেনি বলে মেয়েটির জীবনযাত্রা শেষ হয় পরাজয়ে– মেয়েটি লেখে, ‘তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল,/ স্বপ্ন আমার ফুরোল।’ তার জীবন-কাহিনি নরেশ সেনের অন্য মেয়ের কাছে চলে যাওয়ার কাহিনি– মেয়েটি নিতান্ত কর্মপদবাচ্য। নরেশ মেয়েটিকে ফেলে রেখে বঙ্গদেশ থেকে চলে গেল। মেয়েটির জীবনে কোনও যাত্রা নেই, পড়ে থাকা আছে। আর কর্তৃত্ব যে পুরুষের হাতে, সেই নরেশের জীবন অপাদান কারকের জীবন– একটি মেয়ে থেকে আরেকটি মেয়ের দিকে যাওয়া। নরেশ সেন ‘সাধারণ মেয়ে’-র থেকে চলে যাচ্ছে লিজির, লিজিদের কাছে একে একে। এই বাক্যে সাধারণ মেয়ের থেকে চলে যাওয়া ব্যাকরণের বিচারে অপাদান কারক।
রবি ঠাকুর, আপনি এ-কবিতায় সন্দেহ নেই, শরৎচন্দ্রকে নিয়ে একটু চাপা রসিকতাই করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, শরৎ-সাহিত্যে যে নর-নারীদের কথা আছে, তাদের ভাষায় আবেগের তারল্য, তাদের জীবনে ঘটনার ঘনঘটা। যে উচ্চকিত হাসি-কান্না, অনুরাগ-কলহ প্রকাশ করে তারা, পড়লেই বোঝা যায়, রাবীন্দ্রিক আভিজাত্যের সঙ্গে যেন এসব মিলছে না। আপনার উপন্যাসের নর-নারীরা যে সামাজিক শ্রেণির মানুষ, তাদের এমন ভাষায় এমনভাবে কথা বলা সাজে না। এমন অতিনাটকীয় ঘটনা তারা ঘটায় না। তাদের জীবনে 'পল্লীসমাজ'-এর এমন সরব উপস্থিতি নেই । ঘর-সংসারের ‘মেয়েলি’ বাঁকা কথার নিদর্শন, কলহের বিবরণ আপনার উপন্যাসে যে নেই, তা নয়– তবে সেসব শরৎচন্দ্রীয় নয়, রাবীন্দ্রিক। শরৎবাবুর তুলনায় তা অনেক সংযত ও কম মেলোড্রামাটিক।
তবে কি জানেন রবিবাবু, শরৎচন্দ্রকে এইসব বলে বাঙালি ‘মেধাজীবী’-রা খানিকটা ‘অশ্রদ্ধা’ করে দূরেই রেখে দিলেন। তাতে শরৎবাবুর কী ক্ষতি হল, জানি না, তবে বাঙালি পাঠকের অনেককিছু তেমন করে চোখে পড়ল না। শরৎচন্দ্রকে আপনার ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতার মতোই ঠারে-ঠোরে পল্লিসমাজের ও নগরপল্লির অতিনাটকীয় কথাকার হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হল, তাঁকে মেয়েদের ইচ্ছেপূরণের শরৎবাবু করে রাখা হল। মেয়েদের ইচ্ছেপূরণেরই বা বলি কেন, মেয়েদের ইচ্ছে না-পূরণের কথাকারও তো তিনিই। বাঙালি মেয়েদের উপস-তাপাস, সংস্কার, ভালবাসা তার মধ্যে ইচ্ছের বিবেচনাহীনতা যেমন থাকে, তেমনই থাকে নিজেকে দমন করার শুচিতা– এ দুই খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর উপন্যাসের মেয়েদের মধ্যে। তবে কি জানেন, শরৎচন্দ্র মেয়েদের কাছে গিয়ে মেয়েদের বুঝতে চেয়েছিলেন। এই মেয়েরা আবেগের আতিশয্যে, অবিবেচনায় অনেকেই হয়তো সাধারণ, কিন্তু সেই সাধারণ-যাপনেই তারা বড় টাটকা। তাদের মনের বুদ্ধি শরৎবাবুর কলমে পড়েছিল ধরা আর আপনি মনের বুদ্ধির কথা অস্বীকার না করলেও, মেয়েদের বুদ্ধির মনকেই প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন আপনার উপন্যাসে।
আরও পড়ুন: ‘সোনার কেল্লা’ কমেডি থ্রিলার, বলেছিলেন সত্যজিৎ
বুদ্ধির মন দিয়ে আপনি লিখলেন ‘শেষের কবিতা’, আঁকলেন লাবণ্যকে। উপন্যাসে লাবণ্য-অমিতর কথা লেখা হয়েছিল ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতার বছর তিনেক আগেই। আপনার উপন্যাসে বাঙালি মেয়েরা এমনিতে স্বাধীনজীবী নন। লাবণ্যর অবশ্য ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। গৃহ-শিক্ষকতার স্বাধীন জীবিকা ছিল তার। কলকাতার অমিত-র সঙ্গে শিলং পাহাড়ে যে ক'টা দিন কেটেছিল তার গাঢ় প্রণয়ে, তা ভরে ছিল অমিত-র কথার চকমকিতে। সত্যি কথা বলতে কি, অমিতর কথা শুনে কেন জানি না আপনার পরে লেখা ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতার নরেশ সেনের বাচনভঙ্গি মনে পড়ে। নরেশ সেনকে তার সমুদ্র-যাপনের নারী লিজি বলেছিল, ‘এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে;/ ঝিনুকের দুটি খোলা,/ মাঝখানটুক ভরা থাক্/ একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে-/ দুর্লভ, মূল্যহীন।’ লিজির এই ক্ষণপ্রেম দর্শনের মুগ্ধ টীকাকার নরেশ সেন। নরেশ তার ফেলে আসা হেরে-যাওয়া প্রেমিকা সাধারণ মেয়েকে লেখে, ‘কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী,/ কিন্তু চমৎকার-/ হীরে বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবু কি সত্য নয়।’ এই নরেশ সেনের মতোই কথায় পারদর্শী আগে লেখা ‘শেষের কবিতা’-র অমিত। তার কথাও হিরেবসানো সোনার ফুল, সত্য নয়, তবু সত্য বলে ভাবতে ইচ্ছে করে। অমিত বিয়ে না-করার কারণ দেখানোর জন্য, ফ্যাশন-স্টাইলের পার্থক্য বোঝানোর ঝোঁকে, বিদ্যে ও কালচারের মধ্যে ভেদ তৈরি করার উৎসাহে কত কথা যে বলে! সবই যেন নরেশ সেন-মার্কা, অথবা নরেশ সেন অমিত-মার্কা। এই অমিত কলকাতা থেকে শিলং পাহাড়ে গেল নির্জনতা যাপনে। সঙ্গে নিল ভাষাচার্য সুনীতিকুমারের বই। তবে সে ভাষাতত্ত্বে মন মজল না তার। তার মন মজল লাবণ্যে। তারপর! সে প্রেম রইল না। লাবণ্য বুঝল, অমিত যা-বলে আর অমিত যা-করে, দুয়ের মধ্যে মিল হয় না। অমিত তার একান্ত পুরুষ হয়ে থাকতে পারে না।
কিন্তু লাবণ্য তো 'পুনশ্চ'-র সাধারণ মেয়েটির মতো নয়। এই সাধারণ মেয়েটিকে তো আপনি সৃষ্টিই করেছেন শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের লক্ষণ বাইরের দিক থেকে বিচার করে। আপনার লাবণ্য কি বলতে পারে শরৎবাবুকে তার হয়ে চিঠি লিখতে? পারে না, পারে না। তাই সে কোনওদিনই শরৎবাবুকে চিঠি লিখতে বলেনি তার হয়ে। সে নিজেই তার একদা প্রেমিক অমিত-কে প্রত্যাখ্যান করে, বিবাহ করে শোভনলালকে। সে অমিত-কে দোষ দেয়নি, অমিত-র থেকে চলে গিয়ে স্থিত হয়েছিল শোভনলালে। অমিতকে কর্মপদবাচ্য বানিয়ে অমিত-র থেকে চলে যেতে পারে লাবণ্য – কোনও ইচ্ছেপূরণের ব্যর্থ স্বপ্ন-কল্পনা করতে হয় না তাকে। বাঙালি পাঠকেরা আপনার ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসকে সচরাচর পরে লেখা ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে পড়েন না। মিলিয়ে পড়লে তারা খুঁজে পেতেন, কতগুলি সমান্তরাল ঘটনাবাহী বাক্য।
নরেশ সেন সাধারণ মেয়েকে ফেলে চলে গেল বিলেতে।
বিলেতে এক লিজি থেকে অন্য লিজি তারপর আরও এক লিজি এভাবেই তার চলা।
পড়ে রইল সাধারণ মেয়ে।
স্বপ্ন দেখল, জেতার স্বপ্ন। লিখতে বলল তা শরৎবাবুকে।
বাস্তবে সে পড়েই রইল।
শেষের কবিতার লাবণ্য টের পেল, কথার চকমকিতে পারঙ্গম অমিত অন্য নারীতে বাগদত্ত।
লাবণ্য পড়ে রইল না সাধারণ মেয়ের মতো।
লাবণ্য চলে গেল শোভনলালের কাছে, বিবাহে হল স্থিত।
শোভনলালের মনে ও জীবনে স্থান পেল লাবণ্য।
অমিত-ও শেষ অবধি লাবণ্যের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিয়ে করল হাল-ফ্যাশনের মেয়েকে।
রবিবাবু, আপনার ‘শেষের কবিতা’ শেষ পর্যন্ত বিয়েরই গল্প। পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে চলে গিয়ে আর কাউকে বিয়ে করে। এই চলে যাওয়া তাদের অপাদান, আর কাউকে বিয়ে করে তাদের জীবনে স্থিতি অধিকরণ। লাবণ্য-অমিতর হিরে বসানো সোনার ফুলের মতো মিথ্যে কথার সত্যে ভরা শিলং পাহাড়ের প্রেমপর্ব বাদ দিলে এই উপন্যাসে এমন কী আর আছে! সন্দেহ নেই শোভনলাল ছেলেটি ভালো, অমিতর মতো নয়। সেই লাবণ্যের যথার্থ অধিকরণ। আর অমিতও তো শেষ অবধি বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের অধিকরণেই স্থিতি পেল। তবে এই সাধারণ পরিণতিকে আপনি অসামান্য করে তুলেছিলেন লাবণ্যের চিঠিতে, সেই চিঠিতেই ছিল অমিত-কে লেখা লাবণ্যর শেষ কবিতা, সেই তো শেষের কবিতা।
এই উপন্যাসে অমিত ও লাবণ্যর কথোপকথনের সূত্রে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছিল, যা বাঙালি রবীন্দ্রভক্তরা প্রবাদ-বাক্যের মতো উচ্চারণ করেন। লাবণ্য বলছে, না অমিত বলছে কথাখানি, তা না ভেবেই শব্দবন্ধগুলি আউড়ে যান। এমনই শব্দবন্ধ ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’। 'শেষের কবিতা'-র পাঠকমাত্রেই এই ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ আর ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’ শব্দবন্ধ খুবই ব্যবহার করেন। ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ একথা উচ্চারণ করে তাঁরা মুগ্ধ। এ যেন দু'জনে সম্পর্কে আছে আবার নেই, দু'জনে থাকবে, কিন্তু পরস্পরকে বাঁধবে না। রবি ঠাকুর, আপনার মনে পড়বে ‘শেষের কবিতা’ যখন প্রকাশ পেয়েছিল, তখন বুদ্ধদেব বসুর মতো তরুণ বাঙালি কবিরা খুবই খুশি হয়েছিলেন এই উপন্যাস পড়ে। তাঁদের মনে হয়েছিল, আপনার এই উপন্যাসে এইসব ধ্যান-ধারণার প্রয়োগ খুবই আধুনিক।
তলিয়ে ভাবলে অবশ্য বোঝা যায় এই বন্ধনহীন গ্রন্থি যাপনের মানুষ হয়ে থাকতে পারল না অমিত। লাবণ্য বিদায় নিল– কোনও ক্রোধ-আক্রোশ প্রকাশ করে নয়, সে বিদায় নিল না-থাকার কথা জানিয়েই। চিঠিতে পাঠানো তার শেষের কবিতায় লিখল, ‘মোর লাগি করিয়ো না শোক,/ আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।/... তোমারে যা দিয়েছিনু তার/ পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।/... ওগো তুমি নিরুপম,/ হে ঐশ্বর্যবান,/ তমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান-/ গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।/ হে বন্ধু, বিদায়।’ রবি ঠাকুর, আপনি লাবণ্যকে দিয়ে এই চিঠিখানি লিখিয়ে নিলেন। চিঠির একপাতে ছিল শোভনলালের সঙ্গে লাবণ্যের বিবাহের খবর, অপর পাতে ছিল এই কবিতা। এই কবিতায় বন্যা (লাবণ্যকে 'বন্যা' নামেই ডাকত অমিত) জানিয়েছে, ‘আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।’ অমিত-র সঙ্গে প্রেমের গ্রন্থিতে সে আটকে রইল না, বন্ধনহীন নিজেকে সম্প্রসারিত করে দিল কর্মে। বলে দিল আরও একটি কথা। অসীম ক্ষমায় তাকে গ্রহণ করতে পারে যে, সেই শোভনলালের কাছেই থাকবে সে। আর অমিত? তার কাছে কি রইল না কিছু? রইল। রইল সেইসব স্মৃতি। সেইসব দিনযাপনে অমিতকে লাবণ্য যা দিয়েছিল, তা তো অমিত-রই দান– কারণ অমিত-র জন্যই তো লাবণ্য আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছিল ওভাবে।
লাবণ্যর এই চিঠি অপাদান আর অধিকরণের উপাদানে গড়া। চলে যাওয়া তার অপাদান, শোভনলালের কাছে থাকা তার অধিকরণ। আর অমিতর কাছে যা রইল, স্মৃতিতে যদি থাকে তা, সে অধিকরণের আরেক রূপ। শোভনলালের কাছে লাবণ্যর থাকা বর্তমানে সে স্থানাধিকরণ আর অমিতর কাছে রইল তার স্মৃতি– সে কালাধিকরণ।
আপনার এই অমিত-লাবণ্য কথা আমাকে শরৎবাবুর লেখা একটি উপন্যাসের সম্মুখে দাঁড় করায়। সে উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল চার খণ্ডে ১৯১৭ থেকে ১৯৩৩- এই কালপর্বে। শরৎচন্দ্র ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্ব যখন লিখছেন, তখন আপনি ‘সবুজ পত্র’ পর্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা ছিল না প্রথমে, শ্রীকান্তর মধ্যে যে নিজের আত্মজীবনের নানা উপাদান যাবে, সেই বিষয়ে শরৎচন্দ্র সচেতন ছিলেন। চিঠিতে লিখেছিলেন, আপনার ‘জীবনস্মৃতি’-র কথা। 'জীবনস্মৃতি'-তে আপনি যেমন নিজেকে গৌণ করে বিষয়গুলিকে মুখ্য করে তুলেছিলেন, তেমনই শরৎচন্দ্র তাঁর 'শ্রীকান্তশর্মার ভ্রমণকাহিনী' নামে প্রথমে চিহ্নিত এই লেখাটিতে নিজেকে নয়, বিষয় ও অভিজ্ঞতাকেই বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন। এই উপন্যাসের শ্রীকান্ত তো এক অর্থে অপাদান কারকে গড়া মানুষ। এই লেখার প্রথম খণ্ডের শুরুতেই ‘শ্রীকান্ত’-র স্বীকারোক্তি, ‘আমার এই ভবঘুরে জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া’ এর এক একটা অধ্যায়ের কত কথা মনে পড়ছে। ভবঘুরে শ্রীকান্ত অপাদানের শেষে যখন দাঁড়ালে, তখন তার মনের কালাধিকরণে ভেসে উঠল কতজনের কথা। তারই মধ্যে আশ্চর্য এক অধ্যায়, শ্রীকান্ত আর রাজলক্ষ্মীর সম্পর্ক। এ-দু'জনেই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের বাইরে সম্পর্ক-যাপন করেছে। রাজলক্ষ্মীর অবশ্য বৈবাহিক জীবনের ভূত অর্থাৎ অতীত ছিল। কেমন সে জীবন? সুরলক্ষ্মী আর রাজলক্ষ্মী দুই বোন। তাদের বাবা দুই মেয়ে-সহ তাদের মাকে ত্যাগ করেছিলেন। বাপের বাড়ি এলেন মা, সঙ্গে দুই মেয়ে। মামা এক পাচক বামুনের ঘাড়ে টাকার বিনিময়ে দুই ভাগ্নিকে চাপিয়ে দিলেন। বিবাহের সেই চাপ সইল না। রাজলক্ষ্মী কালে-দিনে পিয়ারি বাইজি। সেই বাইজি পিয়ারির সঙ্গে বড়লোক কুমারের তাঁবুতে বন্ধু-মোসাহেব হিসেবে শ্রীকান্তের দেখা। শ্রীকান্তকে চিনত রাজলক্ষ্মী, সেই ছেলেবেলায়। সেই চেনা যে কখন ভালবাসা হয়ে গিয়েছিল! শ্রীকান্ত জানতে পারেনি, রাজলক্ষ্মী জানতে পেরেছিল। কুমারের তাঁবুতে শ্রীকান্তকে দেখে পিয়ারির ভেতর থেকে রাজলক্ষ্মী উঁকি দিলে।
রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত আখ্যানে রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তের পথ রোধ করেনি। তাকে টেনে আনতে চায়নি বিবাহের প্রতিষ্ঠানেও। পিয়ারি বাইজি তার স্বাধীন জীবিকা থেকে আর ফিরে আসতে চায় না কোনও অলীক সমাজে। শুধু নিজের মধ্যে ধারণ করে শ্রীকান্তের প্রতি তার ভালবাসা। ভবঘুরে শ্রীকান্তর জীবনে নানা মুহূর্তে তার এসে পড়া, সঙ্গে পিয়ারির অনুগত ভৃত্য রতন। শ্রীকান্তকে শ্মশানের বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য পিয়ারি তার ভৃত্যদের এক মাসের বেতন আগাম দিয়ে পাঠিয়েছিল। সেকথা যখন জানতে পারল শ্রীকান্ত, তখন সে স্বীকার করেছিল, তার ‘সমস্ত মনটা উন্মত্ত ঊর্ধ্বশ্বাসে’ রাজলক্ষ্মীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। এই যে টান, ছুটে যাওয়া- তার থেকেই জন্ম নিয়েছিল ঐকান্তিক কিছু মুহূর্ত। দু'জনেই জানত সে মুহূর্ত চিরস্থায়ী হবে না। শেষ পর্যন্ত দু'জনে দু'-পথে যাবে চলে। পিয়ারির ওপর শ্রীকান্তর কিংবা শ্রীকান্তর ওপর পিয়ারির কোনও অধিকারই নেই– অধিকার নেই বলে, অধিকার দাবি করে না বলে, অকপট অভিমানহীন যাপন। যেটুকু অভিমানের মায়া থাকে, তা লীলামাত্র। এ যেন অপাদানকে, চলে যাওয়াকে স্বীকার করেই থেকে যাওয়া। বিশ্বাস করুন রবিবাবু, অমিত আর লাবণ্য চাইলেও এই জাতীয় ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’ যাপন করতে পারত না। তাদের সামাজিক শ্রেণিগত অবস্থান তাদেরকে এই জীবন যাপনের অধিকার দিত না। কিন্তু পিয়ারি আর শ্রীকান্তর তো সামাজিক শ্রেণিগত সংস্কার ও দায় ছিল না। একজন বিবাহ ও সমাজশাসনের কদর্য বালাইয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন পিয়ারি হয়েছিল। অন্যজন ভবঘুরে জীবন নিয়েছিল বেছে। শ্রীকান্তেরও তাই বিবাহের মরীচিকায় মন দেয়নি ধরা। দু'জন মনের উন্মত্ত ঊর্ধ্বশ্বাস টানে কাছে এসেছে। আবার মুক্তির খোঁজে, স্বাধীনতার অধিকারে গেছে দূরে। এই চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি কারণও ছিল– শ্রীকান্তের রাজলক্ষ্মীর, গানওয়ালি পিয়ারির, তৃতীয় আরেকটি পরিচয়ও ছিল। সেই পরিচয়ে সে বঙ্কুর মা– বিমাতা হয়েও প্রকৃত মা। বঙ্কু কলেজে পড়ে। সেই পড়ার দায়-দায়িত্ব সব বহন করে রাজলক্ষ্মী। শ্রীকান্ত বুঝতে পেরেছিল, এই পরিচয় রাজলক্ষ্মীকে কর্মের আরেক জগতে মুক্তি দিয়েছে। রবিবাবু, আপনার লাবণ্য তার বিদায়ী চিঠিতে অমিতকে লিখেছিল, "আমার রয়েছে কর্ম আমার রয়েছে বিশ্বলোক।" এই কর্ম আর বিশ্বলোক তো পিয়ারিও গড়ে তুলতে পেরেছিল তার ‘ছেলে’ বঙ্কুকে ঘিরে। বঙ্কু শ্রীকান্তকে বলেছিল, কত কী করে রাজলক্ষ্মী, তার মা, গ্রামের মানুষদের জন্য। তারা করাটুকু নেয়– সম্মান দেয় না অবশ্য। শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মীর কাছে থেকে কিংবা রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে কাছে রেখে নতুন কোনও সামাজিক কলরবের জন্ম দেয়নি। তারা চলে গিয়েছিল দু'-পথে। ভবঘুরে জীবনের শেষে এসে রাজলক্ষ্মীর কথা ভাবতে ভাবতে শ্রীকান্ত সেই অতীতের কথা ভেবে লিখেছিল, "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না– ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ছোটখাটো প্রেমের সাধ্যও ছিল না– এই সুখৈশ্বর্য-পরিপূর্ণ স্নেহ-স্বর্গ হইতে মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য আমাকে আজ একপদও নড়াইতে পারিত।"
এই অপাদান ছিল বলেই রাজলক্ষ্মীর মনের অধিকরণে শ্রীকান্ত আর শ্রীকান্তর মনের অধিকরণে থেকে গেল রাজলক্ষ্মী।
ভালবাসাকে মনের অধিকরণে ধরে রাখতেই সাহায্য নিতে হয় অপাদান কারকের, চলে যেতে হয় একের কাছ থেকে নিজের পথে। এই চলে যাওয়া 'শেষের কবিতা'-র চলে যাওয়া নয়, এই চলে যাওয়া অন্য কোনও অধিকরণের কাছে যাওয়া নয়, এই চলে যাওয়া নিজের ভেতরের অধিকরণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চলে যাওয়া।
শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর কাহিনিতে কান্না, নাটকীয়তা, উচ্চকণ্ঠ সবই আছে, শরৎবাবুর লেখাতে সাধারণ নর-নারীর জীবনের এই টাটকা দিকগুলি যেমন থাকার, তেমনই আছে। কিন্তু, তাদের জীবনের এই বন্ধনহীন গ্রন্থির ইতিহাসটুকু তাই বলে ফেলনা নয়।