যৌন শোষণই নিয়তি! বাংলা সাহিত্যের নারীমন তবু চেনা ছকের বাইরে
Bengali Literature: ধূসর বিকেলে থেকে যায় সম্পর্কের ওম– শুধু বঞ্চনায়, যৌনতায় তার হিসেব মেলে না।
ফ্রানজ ফাননের 'ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্কস' পুরনো বই, সাদা উপনিবেশের সঙ্গে কালো মানুষের সম্পর্কের মনস্তত্ত্ব নিয়ে নানা কথা লিখেছিলেন তিনি। সাদা প্রভুদের সঙ্গে কালোদের সম্পর্ক জটিল ও বহুস্তরী, মনের ভূমিকা সেখানে বড় বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ। ফাননের লেখার মধ্যে বড় অংশে ছিল সেইসব কালোদের কথা, যাঁরা সাদাদের সমতুল হতে চাইছেন, পারছেন না, কিন্তু নিজের কালোভাইদের সামনে নিজেকে সাদাতুল্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন– ভাষায়, ব্যবহারে, আচারে, সংস্কৃতিতে সাদা হওয়ার কী আপ্রাণ চেষ্টা! ফরাসি নগরীতে জাত-ফরাসিদের মতো ফরাসি বলার চেষ্টা করে হাসির খোরাক হচ্ছেন যে কালো মানুষটি, তিনি নিজের প্রতিবেশে ফিরে এসে সহ-কালো মানুষদের থেকে নিজেকে উচ্চতর বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন ওই ব্যর্থ ফরাসি বুকনির প্রয়োগেই, কারণ সহমানুষরা তো কেউ ফরাসিনগরী দেখেননি। ফাননের বইতে একটি অধ্যায় ব্যয় করা হয়েছিল সাদা পুরুষ ও কালো নারীদের সম্পর্কের খতিয়ানে। অধ্যায়টির নাম ‘দ্য ওম্যান অফ কালার অ্যান্ড দ্য হোয়াইট ম্যান’। কালো নারীটির কাছে সাদা পুরুষটি দেবতা-সদৃশ। কিছুই চায় না সেই কালো মেয়ে, কেবল শর্তহীন সমর্পণের উদ্দেশ্য একটু রং, সাদা রং– সে চায় সেই রংটুকু লাগুক তার জীবনে। না, এই সমর্পণকে তো ভালবাসা বলা যাবে না। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অসামঞ্জস্যে বিজিত মানুষটির মনে এমন এক হীনতার জন্ম হয়েছে, যে হীনতার ফলে নিজের বর্ণগত অস্তিত্বকে সে ঘৃণা করে। নিজের প্রতি সেই ঘৃণা থেকে মুক্তির একটাই উপায়। যৌন-মিলনে যদি তার গর্ভে নেমে আসে রং-লাগা সন্তান, সাদা রং লাগা সন্তান।
ফাননের বই পড়তে পড়তে বাঙালি পাঠকদের মন অনিবার্যভাবে এসে বসে বাংলা সাহিত্যের কিনারে। ক্ষমতার ও ঔপনিবেশিকতার অভিজ্ঞতা বাঙালি জীবনে, বাংলা সাহিত্যে নানাভাবে ধরা দিয়েছে। ধরা পড়েছে যৌনক্ষমতা প্রদর্শনের আশ্চর্য সব নিদর্শন। অথচ যাদের ওপর প্রদর্শিত হলো এই যৌনক্ষমতার লিঙ্গনির্ভর পৌরুষ, সেই নারীরা কিন্তু সবসময় ভাবছে না, কেবলই বঞ্চিত হয়েছে তারা। মানুষের মন যে বড় আশ্চর্য বস্তু– মন সত্যি অতি বিষম বস্তু। তারাশঙ্করের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' উপন্যাসের কাহারদের কথা মনে নেই? কাহার নীলকুঠির সাহেবদের পালকি-বাহক। সেই সাহেবরা তাদের স্নানের জন্য পুকুর কাটিয়েছিলেন।
মধ্যে মধ্যে কুঠিয়াল সাহেবের কাছে সমাগত বন্ধুবান্ধব গোরা সাহেবরা এসে স্নান করতে নামত। স্নান করত নাকি উলঙ্গ হয়ে। সেই আমল থেকে কাহারদের কয়েকটা ঘরে রূপ এসে বাসা বেঁধেছে। পরম কাহারদের গুষ্টিটার রঙই সেই আমল থেকে ধবধবে ফরসা। সুচাঁদপিসীর কর্তাবাবা অর্থাৎ বাবার বাবার রঙ একেবারে সাহেবদের মতো ছিল।
আরও পড়ুন: বিপ্লব আর প্রেম রূপকথা নয়! রূপ-যৌনতার ঊর্ধ্বে ‘রক্তকরবী’-র ভালবাসা
দেশ থেকে দূরে থাকা নীলকর সাহেব ও তাদের বন্ধুদের মেমসাহেবরা সবসময় এদেশে আসতেন না। এলেও পুরুষের বহুগামী যৌনবাসনা সহজে পাওয়া রমণীদের দিকে ধাবিত হতো। সহজলভ্য তারা। রঙের লোভে সহজলভ্য। রূপের বাসনায় সহজলভ্য। আর কিছু চায়নি তারা। গর্ভের সন্তানের রংটুকু ছাড়া। তাদের বাচনে পরবর্তীকালে ভালবাসা মানে তাই রং-লাগা। ‘এ দেশের এরা, মানে হাঁসুলী বাঁকের মানুষেরা, নরনারীর ভালোবাসাকে বলে রঙ।'
তারাশঙ্করের এই উপন্যাস ফাননের 'কালো চামড়া সাদা মুখোশ' বইটির অনেক আগেই লেখা। ১৯৪৬ সালে 'আনন্দবাজার পত্রিকা'-র শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাসখানি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তারাশঙ্করের এই উপন্যাস পড়ে একটি চিঠিতে লেখককে জানিয়েছিলেন,
আপনার বইয়ে একটী জিনিস পাইলাম যাহা অন্যত্র পাইবার নয়,- আপনি বাঙ্গলা দেশের আদিম যুগের মানুষের মনের একখানি নিখুঁত ছবি দিয়াছেন। হাঁসুলী বাঁকের যে বাউড়ী কাহারদের ছবি আপনি আঁকিয়াছেন তাহা অবশ্য তাহাদের পিতৃপুরুষের স্বাধীন, স্বতন্ত্র, পারিপার্শ্বিকের বাতাবরণ হইতে ভ্রষ্ট ...।
কেন তারা স্বাধীনতা থেকে ভ্রষ্ট হলো? তাদের ভ্রষ্ট করল বাণিজ্য-সভ্যতা, তাদের ভ্রষ্ট করল নীলকুঠি, তাদের ভ্রষ্ট করল অঙ– মানে রঙ। যৌনবস্তু হয়ে স্বাধীনতা হারাল তারা।
আশিস নন্দী অনেকের মতোই এদেশে আসা সাহেবদের দু'-ভাগে ভাগ করেছিলেন। একদল সাহেব যাঁরা এসেছেন ভাগ্যান্বেষণে, নীলচাষের জন্য তাঁদের সঙ্গে পরবর্তী প্রশাসনিক ব্যবস্থালগ্ন সাহেবদের মন-মানসিকতার মিল নেই। এই আগে আসা সাহেবরা এদেশের মানুষদের সঙ্গে বিচিত্র সম্পর্কে মিলে-মিশে যান। সে মিলমিশের মধ্যে বঞ্চনা, আধিপত্যের গল্প যেমন থাকে, তেমনই এদেশের নারীদের অবুঝ মনের কথাও থাকে। সাদা সাহেবদের অবস্থাবিশেষে অসহায়তাও কি থাকে না! দু'-পক্ষের মধ্যে নিবিড় শত্রুতার সম্পর্ক– ভালবাসার একটা মানে তো নিবিড় শত্রুতা। সব সম্পর্ক ছিন্ন করবেন না, যদি আর কিছু না থাকে তবে শত্রুতাই থাক। গালিবের পদ না হয় ভুলভাবেই উচ্চারণ করা যাক। বিজয়ীর কাছে বিজিত কেমন? সে মন বঞ্চিত, সে শরীর বঞ্চিত, তবু কিছু একটা থেকে যায় বিজিতের পক্ষে। সেই যেটুকু থেকে যায়, তা যেন বঞ্চনার অতিরিক্ত। হতে পারে তা-ই অতিরিক্তের অনুভব, যে বঞ্চিত হলো তারই মনের কল্পনা, নিজের মর্যাদা বজায় রাখার ব্যর্থ কল্পনা– তবু থেকে যায়।
তারাশঙ্করের উপন্যাসের পাশাপাশি রাখতে ইচ্ছে করে বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’ উপন্যাসটিকে। বিভূতিভূষণ জানিয়েছিলেন এই উপন্যাস, ‘মূক জনগণের ইতিহাস।’ মূক জনগণেরও কিন্তু মন নামের বস্তুটি থাকে– তা তোলপাড় হয়। এই উপন্যাসে আছে মোল্লাহাটির নীলকুঠির কথা। সেই নীলকুঠির বড়সাহেব শিপটন। সেই শিপটনের সঙ্গে সম্পর্ক বরদা বাগদিনীর মেয়ে গয়া-র। তাকে সবাই গয়া মেম বলে ডাকে। বয়স পঁচিশের মধ্যে। গায়ের রং কটা। বড় বড় চোখ। কালো চুলের ঢেউ ছেড়ে দিলে পিঠ পর্যন্ত পড়ে। মুখখানা বড় ছাঁচের, কিন্তু টলটলে। থাকে বড়সাহেবের হলদে কুঠিতে। প্রসন্ন চক্রবর্তীরা গয়াকে কামনা করে কিন্তু পায় না, জানে ‘বড্ড উঁচু ডালের ফল।’
এই যে পুরুষের বাসনার শিকার মেয়েরা, তারা কী ভাবে তাদের যৌনসঙ্গীদের সম্বন্ধে? জানে এই সম্পর্ক অসমান, জানে এই সম্পর্কে খানিকটা বস্তুগত পাওয়া ও সাহেব-পুরুষের যৌনবাসনা পরিপূর্ণ করাই তার কাজ। কিন্তু যৌনতা, মানুষের যৌনতা কি যান্ত্রিক একপাক্ষিক পরিতৃপ্তির চাইতে আরেকটু বেশি কিছু দেয়! বিশেষ করে যে বিজিত, নিরুপায়ভাবে উপনিবেশিত, সে অপর পক্ষকে তার থেকে উচ্চতর বলে মনে করে বলেই কি নিজেকে কেবল বঞ্চিত বলে ভাবে না? ওপরওয়ালার কাছে যা পেল, তাকে বেশ পাওয়া বলে ভেবে নিল। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে গয়ামেম আর শিপটন সাহেবকে ঘিরে আশ্চর্য কিছু মুহূর্তের বিবরণ আছে।
গয়া মেম জানে শিপটন সাহেবের সাদা মেম আছে। গয়া মেম জানে, প্রসন্ন চক্রবর্তী তাকে বাসনা করে, কিন্তু সেই বাসনা পরিপূর্ণ করতে পারে না শিপটনের জন্য। প্রসন্ন চক্রবর্তীকে খানিকটা করুণা করে গয়া। করুণা করতে পারে শিপটনের জন্যই। শিপটনরা না থাকলে ব্রাহ্মণ চক্রবর্তীরা গয়াকে সহজেই উচ্চবর্ণের দাপটে ভোগ করতে পারত। শিপটনদের জন্য পারে না। শিপটনদের অনুগত প্রসন্ন, তার ব্রাহ্মণ্যধর্ম উপনিবেশের প্রভুর কাছে পরাভূত। গয়া শিপটনের খাস আয়া। তাকে প্রসন্ন কী অধিকারে স্পর্শ করবে? তাই প্রসন্নকে করুণা করার সুযোগ পায় গয়া। খবর দেয়, সাহেবরা চলে যাবে। নীল বিদ্রোহ ছড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক নীলের পরিবর্তে বাজারে আসছে কৃত্রিম নীল। শিপটনের মেম বিদেশে চলে গেল। আর শিপটন? কোথায় যাবে সে? গয়াকে বলে, ‘আমি চলিয়া যাইব, না এখানে ঠাকিব?’ গয়ার উত্তর, ‘কোথায় যাবে সায়েব? এখানেই থাকো।’ শিপটন থাকে। আর গয়া? ‘চিরকাল তোমার কাছে আছি, অনেক খাইয়েচ মাখিয়েচ– আজ তোমার অসময়ে তোমারে ফেলে কনে যাবো? গেলি ধম্মে সইবে, সায়েব!’ গয়ামেমকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে শিপটন সাহেব।
এ কি শাসক-শাসিতের আলিঙ্গন? এ কি দুঃসময়ের মুখোমুখি হওয়া শাসকের শাসিতের প্রতি ভালবাসা? এ কি সাদা পুরুষের কালো নারীর প্রতি আশ্লেষ?
সাহেব মরে যাওয়ার পর সাহেবের কবরে নিভৃতে ফুল ছড়িয়ে আসত গয়া, বিকেল তখন সন্ধের দিকে ঢলছে।
ঔপনিবেশিক বঞ্চনার আখ্যানে সন্ধের মুখোমুখি লেগে থাকা ধূসর বিকেলে থেকে যায় সম্পর্কের ওম– শুধু বঞ্চনায়, যৌনতায় তার হিসেব মেলে না। অঙ, মানে রং কতভাবে যে লাগে! মন অতি বিষম বস্তু। সাদা মন কালো মনের বাইরে মানুষের অঙ-লাগা ধূসর মন।