বুকের উপর আস্ত হাতি তুলতেন, বাঙালি ভুলেছে 'ভীম ভবানী'কে
বিশ শতকের গোড়ার কথা। ম্যালেরিয়ায় ভুগে চোদ্দ পনেরো বছর বয়সি একটা ছেলে প্রায় ধুঁকছে। এমনই একদিন, সমবয়সি এক ছেলের সাথে শুরু হল তার ঝগড়া। অনবরত রোগের কবলে পড়ে শারীরিক শক্তি তো বিশেষ ছিল না, আর সেই সুযোগেই তাকে বেদম মার মারল ছেলেটা। পরাজয়ের অপমান ভুলতে পারেননি ভবেন্দ্রমোহন। একটু শরীর সারতেই শুরু হল শরীরচর্চা। তারপর কেটে গেল কত কাল। শালপ্রাংশু সমবাহু আর প্রকাণ্ড ছাতির অধিকারী হয়ে বিডন স্ট্রিটের বর্ধিষ্ণু পরিবারের সেই ছেলে হয়ে উঠলেন 'ভীম ভবানী'। রোমাঞ্চকর সেই গল্প, আজও পাঠকের বুকে শিহরণ জাগায়।
ভবেন্দ্রমোহনের প্রথম জীবনের মুর্শিদ ছিলেন অতীন্দ্রকৃষ্ণ বসু। যদিও এ তথ্য নিয়ে সংশয়ের কিছু অবকাশ রয়েছে। যেটুকু যা জানা যায়, অতীন্দ্রবাবুর আখড়ায় বেশিদিন মন টেকেনি তাঁর। অল্প কিছুদিন পরেই তিনি গিয়ে হাজির হন ক্ষেতু গুহর আখড়ায়। দর্জিপাড়ার সেই আখড়া তখন ছিল বাংলার তাবড় তাবড় কুস্তিগীরদের তীর্থক্ষেত্র। এমন ভাবেই চলছিল, হঠাৎ কলকাতায় আবির্ভাব ঘটল কুস্তিগীর প্রফেসর রামমূর্তি নাইডুর। ভবেন্দ্রমোহনের মতো অমন শক্তপোক্ত চেহারার যুবককে তাঁর ভারী পছন্দ হল। সেদিনই তাঁকে প্রস্তাব দিলেন, 'আমার সার্কাসে এসো'। এদিকে ভবেন্দ্রর বাবার তখন মৃত্যু ঘটেছে, সার্কাসের খেল দেখাতে যাচ্ছেন শুনলে মা কিছুতেই ছাড়তে রাজি হবেন না। অবশেষে কোনোরকম উপায়ান্তর না দেখে তিনি এক রাতে বাড়ি থেকে পালালেন।
এখান থেকেই তাঁর শুরুওয়াত। রামমূর্তির প্রিয় শিষ্য ভবেন্দ্রমোহন তারপর তাঁর সার্কাস দলের সঙ্গে পাড়ি দিলেন রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর এবং জাভা। তাঁর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সংঘাতটা ঘটে এই জাভাতেই। লোকলস্কর নিয়ে সেখানে গিয়েছেন নাইডু সাহেব, সার্কাস চলছে পুরোদমে। এমন সময় তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসলেন এক ওলন্দাজ। রামমূর্তি ভবেন্দ্রর দিকে তাকালেন, আর তিনিও আস্তিন গুটিয়ে লেগে পড়লেন, 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী'। ঠিক তিন মিনিটের খেল, তারপর আশেপাশের মানুষজন দেখলেন, ভবেন্দ্রর প্যাঁচে কুপোকাত হয়ে পড়ে আছেন সেই ওলন্দাজ।
রামমূর্তির দলে ভবেন্দ্র বেশিদিন থাকতে পারেননি। ব্যক্তিগত কিছু টানাপোড়েনের ফলেই তিনি যোগ দেন প্রফেসর কে বসাকের হিপোড্রাম সার্কাসে। তাঁর খ্যাতি তখন দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দর্শকেরা অবাক চোখে দেখেন, ভবেন্দ্র বুকের উপর ৪০ মণের একটা পাথর চাপিয়ে শুয়ে আছেন, তার উপর বসে ঘন্টার পর ঘন্টা খেয়ালের অনুষ্ঠান করছেন অন্তত বিশ পঁচিশজন মানুষ। এ ছাড়াও ছিল একা হাতে তিনখানা মোটরগাড়ি থামানোর খেলা। ভরতপুরের রাসভায় গিয়ে একদিন রাজাসাহেবের অনুরোধে একা হাতে তিন তিনখানা মোটরগাড়ি টেনে ধরে রেখেছিলেন তিনি। তার একটাতে বসেছিলেন রাজাসাহেব নিজে, অন্যটাতে রাজমন্ত্রী এবং তৃতীয়টাতে ইংরেজ রেসিডেন্ট। প্রস্তুতিপর্ব শেষ হলে রাজার হুকুমে চাপ দেওয়া হল এক্সিলারেটরে, কিন্তু একটা গাড়িরও নড়ন চড়নের নাম নেই। সেগুলোকে শক্ত হাতে টেনে ধরে রেখেছেন 'ভীম ভবানী' ভবেন্দ্রমোহন। রাজা হতবাক হয়ে এক হাজার টাকা পুরস্কার দিলেন তাঁকে।
আরও পড়ুন-বিপ্লবী অজয় মুখোপাধ্যায়কে বাঙালি ভুলে গেল অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হল
আরেকদিনের গল্প। মুর্শিদাবাদের প্রাক্তন নবাবের অনুরোধে ভবেন্দ্রমোহন বুকের উপর একটা নয় ফুট সাত ইঞ্চির বুনো হাতি তুলে শুয়ে রইলেন খানিক্ষণ। খবর গেল বাংলার গভর্নরের দপ্তরে। তাঁর চক্ষু তখন ছানাবড়া। খাওয়াদাওয়া করতে বড়ই ভালোবাসতেন ভবেন্দ্রবাবু। তাঁর দৈনন্দিন ডায়েট চার্ট শুনলে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় থাকে না। ২০০ বাদামের শরবত, এক ছটাক গাওয়া ঘি, এক সের মাংস এবং আড়াই টাকার ফল। দুপুরের খাওয়া অবশ্য তিনি অল্পের উপর দিয়েই সারতেন। তাঁর মেনুতে তখন থাকত স্রেফ ডাল আর ভাত।
অমৃতলাল বসুর কল্যাণে ভবেন্দ্রমোহন লাভ করেন 'ভীম' উপাধি। স্বদেশি মেলায় তাঁর খেলা দেখে তিনি বলেন, 'মহাভারতের ভীম এমনই একজন বীর ছিলেন। তুমি দেখিতেছি কলিকালের ভীম। আজ হইতে আর তুমি শুধু ভবানী নহ, তুমি ভীম ভবানী!' কলিকালের এই ভীম সে সময় পরিণত হয়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের এক জলজ্যান্ত আইকনে। তখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে, এমতাবস্থায় ১৯২২ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হল তাঁর। ভীম ভবানীকে মনে রাখিনি আমরা। ঠিক একইভাবে ভুলেছি গোবর গুহ বা বিষ্টু ঘোষের নাম। দিন যায়, বাঙালির বার্বেল চ্যাম্পিয়নের স্মৃতিচিহ্নর উপর জমে ধুলোর পুরু আস্তরণ। এই কি তাঁর ভবিতব্য ছিল?