যে কারণে 'ভুলভুলাইয়া' ইতিহাস, সেই কারণেই চূড়ান্ত ব্যর্থ তার সিক্যুয়েল

২০২২ সালে, ভূতও দু'-তিনবার মরে গিয়ে খিল্লি হয়ে গেছে। ফলত হরর কোথাও নেই, মজা আছে আর লাস্টে আছে একটা টুইস্ট— যার সুবাদে একে 'রদ্দি' হরর-কমেডির বদলে 'চলনসই' সাসপেন্স-থ্রিলারের গোত্রে গোঁজা চলে।

 

শুরুটা হয়েছিল ভালোই। চকলেট বয় কার্তিক আর গ্ল্যামার গার্ল কিয়ারার কেমিস্ট্রি রোপওয়ে থেকে রাজস্থান হয়ে ভুলভুলাইয়ার নিজস্ব মেটাফিজিক্সটিকে ধ্বংস করার আগে অবধি অন্তত। কিন্তু শেষমেশ টিকল কই? মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার থেকে তা নেমে এল ভালো পেত্নি আর খারাপ ডাইনির চুলোচুলিতে! তা হোক, কিন্তু সমস্যাটা রয়ে গেল অন্যত্র।

কাল্ট-ক্লাসিক 'ভুলভুলাইয়া' সেই ২০০৭ সালে একটি 'ভূতের ছায়াছবি' প্রতিষ্ঠা করতে-করতে আকস্মিকভাবে ১৮০° অ্যাবাউট-টার্ন করে শিখিয়েছিল— ভূত বলে কিছু নেই, থাকলেও তা 'মনের গোপন ঘরে যে শ্বাপদ ভর করে', তারই অচেনা আদল; আর ২০২২ সালের 'ভুলভুলাইয়া ২' আসলে সেই পুরনো ফ্লেভারকে রিক্রিয়েট করার কষ্টকর চেষ্টা, কিন্তু প্রথম পার্টের ভূত যেখানে অবদমিত ইচ্ছার মেটাফর মাত্র, সেখানে ২০২২ সালের দ্বিতীয় পার্টে দেখা গেল হাভেলির ভূতটা সত্যিই ভূত। তবে ভুল করে ভূত। পুনর্বিবেচনাযোগ্য। আগেরবারের মতো 'ভূত'-কে মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা নয়, বরং জ্যান্ত-ভূতের নামে আদ্যন্ত ফাজলামি ও সস্তা ভিএফএক্স-এর ঘটিগরম এবং... ফলোচিত পতন।

জ্ঞানীগুণী মাত্রেই জানেন, 'ভুলভুলাইয়া' (২০০৭) আদতে ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণবাদেরই শিল্পভাষ্য। আমাদের ১.৩৬ কিলোর ফিজিক্যাল মাথারই কোনও অঙ্গরাজ্যে (এইসব ভুলভুলাইয়া-ল্যাবিরিন্থ-গোলকধাঁধা যা-ই বলুন-না-কেন) সেই ভার্চুয়াল ড্রাইভটি রয়েছে, অর্থাৎ ফ্রয়েড স্যারের সেই 'আনকনশাস'। ১৯১৫ নাগাদ স্যার প্রথম জানালেন, আমাদের চৈতনের ডগাটুকুকে আমরা অ্যাদ্দিন চৈতন্য বলে জেনে বসে আছি, আসলে সেটা হিমশৈলের চূড়াটুকু বই নয়। জলের ভেতরে মগ্নমৈনাক চৈতন্যের বেশিরভাগটাই আমাদের ডুব দিয়ে চুপ করে আছে, আর সেই নিষিদ্ধ ভূমিতে বড় হয়ে উঠেছে আমাদের যাবতীয় চোরা-ইচ্ছের গাছ— যাদের সামাজিকভাবে বয়কট করে চলছি 'কনশাস' আমরাই।

আরও পড়ুন: ইতিহাস ঠিক কতটা বিকৃত ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’-এ, কেন এমনটা করলেন অক্ষয়?

'ভুলভুলাইয়া'-তে (২০০৭) 'পিতা-অবনী-দিদা'-র সম্পর্কের সমীকরণটির ভাবলে, বোঝা যায় দিদার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে অবনীর অবচেতনে একটি পিতৃদ্বেষ সুপ্ত ছিল, যে পিতৃদ্বেষের আসল চেহারা অবনী সামাজিকভাবে স্বীকার করেনি (পিতৃহত্যার মতো আবেগকে কন্যার পক্ষে স্বীকৃতি দেওয়ার কথাও নয়), হয়তো চিনতেও পারেনি, কেননা ততদিন তো সে নিজের 'হাভেলি'-র দরজাটা খোলেই নি! সঙ্গিনীটির থেকে মঞ্জুলিকার গল্প শোনার অব্যবহিত পরেই অবনীর উক্তিটি স্মরণ করতে বলব পাঠককে‌:

'দেখেঁ তো হামারে ঘরমে হামারে ইজাজত কে বিনা কৌন রহ্ রাহা হ্যায়'

ব্যঞ্জনাটি ধরতে পারছেন নিশ্চয়ই। 'ঘর' খুলে পরিষ্কার করানোর ইচ্ছেটি সে তার স্বামী সিদ্ধার্থকে জানালে সেও সদ্যলব্ধ মালিকানাস্বত্বের গুমোরে জানায়:

'তুমহারা ঘর হ্যায়, যো চাহে কর লো'

আমার 'নিজের' ঘর হলেও সেখানে যারা বসত করে, তারা আমার অধীন নয়— এই সত্য সম্পর্কে সিদ্ধার্থ বা অবনী উভয়েই অজ্ঞ। এই অসাবধানতার মূল্যই তারা চোকাবে, এই ঘটনাকে হ্যামারশিয়া এবং তাদের অজ্ঞান-উক্তিকে আয়রনি বললে বলতেই পারেন। কারণ, আমরা জানি যেদিনই সেই ঘর খোলা— হাভেলির মঞ্জুলিকার গল্প আমেরিকার অবনীর আত্মচরিতে আরোপ হয়ে সে বেধে যাবে এক বিষম গেরো! রাজার জায়গায় রাজার বংশধর সিদ্ধার্থ, রাজবৈদ্য শশধরের জায়গায় প্রফেসর শরৎ আর বাঙ্গালন মঞ্জুলিকার জায়গায় কে— তা আর বলতে হবে না নিশ্চয়ই। পাশাপাশি (সোচ্চারে না-ঘোষিত হলেও) বাস্তবে বাল্যকালের পিতার সেই অথরিটেটিভ অবস্থানে অচিরেই হয়তো এসে পড়ছিল স্বামী সিদ্ধার্থ, ওদিকে কাম্যবস্তু দিদাকে হয়তো প্রতিস্থাপন করছিলেন শশধর। ফলে পূর্বস্মৃতি-বাস্তব ও মিথ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে করে ফেলল এক অচ্ছেদ্দ্য অ্যাসোসিয়েশন। কাজেই এই আঁতাতের সবটা জেনেও, আসলে কিছুই জানল না বেচারি মেয়েটা। কাজেই তাকে ভুগতে হল।

অতএব, ব্যক্তিগত আনকনশাসের নিষিদ্ধ দরজা দিয়ে সেই 'হাভেলি' উর্ফ দুর্গম দুর্গটিতে পা-রেখো না। দোস্ত তফাৎ যাও! তালা ভেঙো না। দরজাটা খুলো না। ভুলভুলাইয়ার ভেতর থুড়ি অবচেতনের চোরকুঠুরিতে যে-গোপন কথাটি লুকিয়ে-থাকা-ভূত হয়ে আছে, তাকে উসকে দিও না। 'সত্যি' হলেও সব সত্যির তো ফিরে আসা ঠিক নয়। 'ভুলভুলাইয়া ২' সেখানে এর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে দর্শককে বলে গেল কিছু-কিছু কথার ফিরে আসাও দরকার, আর তা 'সত্যি' বলেই। অবচেতনের 'হাভেলি'-তে যাকে এতকাল একা আটকে রেখেছ, তাকে সময়সুযোগে নেড়েচেড়ে দেখো— কখনও মনে হতে পারে এভাবেও আটকে রাখার দরকার ছিল না। ভূত হলেও কাজটা ভুলই ছিল হয়তো। তাই দীর্ঘদিন না-খোলা মরিচাজীর্ণ তালার হে মালিক, সাহস করে হাভেলির দরজাটা মাঝেমধ্যে খুলেও দেখো।

প্রসঙ্গত, মনসমীক্ষণের ক্ষেত্রে অনেকেই পরবর্তীতে false memory বলে একটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। অস্যার্থ, আদতে রোগী যে অবদমিত স্মৃতির পীড়নে 'রোগী', তাঁর সেই স্মৃতিটিই সম্পূর্ণ মনগড়া! বাস্তবে অমন ঘটনা কখনও ঘটেনি, মানবমস্তিষ্কের কেরামতিতে অন্য কোনও ঘটনার জাস্টিফিকেশনের স্বার্থেই এই ছদ্ম-স্মৃতিটি অবচেতনে তৈরি হয়েছে। 'ভুলভুলাইয়া ২'-তে ভূত এই false memory, তাহলেও, তার পীড়ন তো সত্য, তাই রোগীও মিথ্যে নয়। 'হাভেলি'-র দরজা দেখি খুলেও বিড়ম্বনা, না-খুলেও তাই। সত্যিই তো, স্যারও পক্ষান্তরে বলেই গেছেন— দমে থাকা সব আবেগের দরজা না-খোলাই ভালো, কিন্তু তবুও হাভেলির দরজায় তালা দিয়েই কি শান্তিতে বসে থাকা চলে? অবদমনের ওপর ভর করেই কি সামাজিক থাকা যায়? 'ভূতটা' তো বেরিয়ে আসেই নিজের দাঁত-নখ নিয়ে। স্বপ্নে। কাজেই শক্তিশালী করো বিবেকবোধ অর্থাৎ সুপার ইগো, তার ভরসায় দরজা খুলে দু'-একবার নিজের গোপন ভূতগুলো তো দেখা যেতেই পারে, না কি? রাতের অন্ধকারে দেখার চেয়ে তাকে দিনের নরম রোদ্দুরে ফেলে দেখা ভালো, কে বলতে পারে, ইতিহাস পালটে যাবে কি না।

যদিও ২০২২ সালে, ভূতও দু'-তিনবার মরে গিয়ে খিল্লি হয়ে গেছে। ফলত হরর কোথাও নেই, মজা আছে আর লাস্টে আছে একটা টুইস্ট— যার সুবাদে একে 'রদ্দি' হরর-কমেডির বদলে 'চলনসই' সাসপেন্স-থ্রিলারের গোত্রে গোঁজা চলে। বোদ্ধা দর্শকের একমাত্র আক্ষেপ থাকবে— ছ্যাঃ, শেষমেশ সত্যিকারের ভূত আর চ্যাংড়া তারানাথ তান্ত্রিক দেখিয়ে বলিউডে নিজের ইউনিকতম জেনেরিক কাঠামোটা নষ্টই করে ফেললি? আরে 'ওম শান্তি ওম' তো অলরেডি আমাদের ছিলই!

 

 

 

More Articles