ডানা মেলেছে ভারতীয় থিয়েটার আর চিত্রকলা, নেপথ্যে জেগে এক লাইব্রেরি
Bhulabhai Desai Memorial Institute: নামমাত্র মূল্যে যাঁরা গান ভালোবাসেন, নৃত্যকলা ভালোবাসেন, থিয়েটার ভালোবাসেন, তাঁদের খোঁজ করে আনা হত এই কেন্দ্রে।ভুলাভাইয়ের বাসগৃহটিই হয়ে উঠেছিল সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্তের হদিশ পাওয়ার ঠিকানা
মহারাষ্ট্রে বিধানসভা ভোট নিয়ে উত্তাল সংবাদমাধ্যম। বিদর্ভ অঞ্চলে ৬২ আর মারাঠওয়াড়ার ৪৬। এই মোট ১০৬টি আসনই কার্যত ‘গেটওয়ে অফ মুম্বই’ হয়ে উঠবে, বলছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বা সেফোলজিস্টরা। শেষ হয়েছে ভোট গ্রহণ। মোটের ওপর ৬০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে। মুম্বইয়ে ভোটের হার বরাবরই কম। এখন বুথ-ফেরত সমীক্ষার পালা। ফল প্রকাশ হবে আগামী ২৩ নভেম্বর। টিভি খুললেই দেখা যাচ্ছে পুরনো বোম্বাইয়ের ভোট-চিত্র। ক্যাডবেরি মোড় (Cadbury junction) থেকে একদিকে সোজা চলে গিয়েছে পেডার রোড। এই রাস্তার বাসিন্দা ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। আর সমুদ্রের গা বেয়ে চলে গিয়েছে পুরনো ওয়ার্ডেন রোড, অধুনা যাকে বলা হয় ভুলাভাই দেশাই রোড। এই পথ ধরে একটু এগোলেই ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতাল আর তার অনেকটা কোনাকুনি বিপরীতে ভুলাভাই দেশাই মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউট। একদা এই পথে বাস্তবিকই নির্জনতা ছিল। নাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের ছোট গ্রন্থাগার এবং আশপাশের যে বিপুল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হত, তা কি সম্ভব হত?
ভোটের বাদ্যি, শোরগোলের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের কথা আরও মনে পড়ে গেল সম্প্রতি এক বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে।লেখক-সাংবাদিক অর্ক দেবের ‘যখন যেমন ভাবি’ – এই নতুন বইয়ের শেষ লেখাটি পড়ছিলেন কিংবদন্তি কবি-ঔপন্যাসিক জয় গোস্বামী। সেও এক লাইব্রেরির কথা। লেখাটির শিরোনাম— ‘বইপাগলের পান্থশালা’। এই বইয়ের দোকানটি পাতালপুরীতে। জগৎসংসারের মাটিতে পায়ের চটি খুলে নেমে যেতে হয় বইপাগলের এই পান্থশালায়। সেখানে রয়েছে এক-একটি মাইক্রোফিল্ম— তাতে এক-একজন লেখকের আজীবনের কাজের সংকলন। এমনকি বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি , লেখকদের চিঠিচাপাটির প্রতিলিপি – সবেরই হদিশ মিলবে এই বইয়ের দোকানে। লেখকের হাতের লেখা, তাঁর ব্যক্তিগত সংলাপ, কণ্ঠস্বর দীর্ঘ ছায়া মেলে পাঠকের মনে। সেখানে রয়েছে এক হলঘর, সপ্তাহের একদিন আসেন দাস্তানগো। গল্প বলেন। তিনি বংশ পরম্পরায় গল্প-বলিয়ে। মহাকাব্য ঘোরে তাঁর ঝোলায়। শুক্রবার নবীন কবিদের কবিতা পড়ার দিন। হলঘরের শেষে ক্যানটিন, তার পাশে রাইটার্স রুম। এইসব সুবিধা পেতে নামমাত্র মূল্য দিতে হবে পড়ুয়াদের...।
আরও পড়ুন: ‘পথের পাঁচালী’-তে ছিলই না চরিত্রটি! যেভাবে এক ‘দেহাতি’ কিশোরী হয়ে উঠল বাঙালির দুর্গা
দক্ষিণ কলকাতার এক বই বিপণীতে আয়োজিত হয়েছিল এই অনুষ্ঠান। জয় গোস্বামী পড়ছেন তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে। বাড়ি ফেরার সময় কেবলই কানে ভাসছে গিরিশ কারনাডের কণ্ঠস্বর। না না, জয় গোস্বামী এবং গিরিশ কারনাডের কণ্ঠস্বরে কোনও মিল নেই। জয় এবং গিরিশের মিল তাঁদের নাট্যানুরাগে এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের সংলগ্নতায়। মিলে যাচ্ছে পাতালপুরীর সেই বইয়ের দোকান আর অতীত বোম্বাইয়ের ওয়ার্ডেন রোডের সেই গ্রন্থাগার।
ভুলাভাই দেশাই-এর বড় পরিচয় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক। গান্ধীজির আহ্বানে দেশজুড়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বিনামূল্যে আইনি সহায়তার বিভিন্ন কেন্দ্র। লাল কেল্লার INA-র বিচারে তিনি সুভাষ-বাহিনীর পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন। ভালোবাসতেন গান, নাটক, সাহিত্য, চিত্রকলা। ওই যে ওয়ার্ডেন রোডের কথা— ওখানেই সেই স্বপ্নপুরী। ভেবে দেখুন, আপনি ওই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে শুনতে পেলেন সেতারের ঝংকার। সেতার হাতে ধ্যানমগ্ন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
আরেক দিকে দেখছেন, অজস্র রঙের বর্ণময় ছটা। Bombay Progressive Artists Group-এর তরুণরা ছবি আঁকছেন সেখানে। রয়েছেন তায়েব মেহতা, মকবুল ফিদা হুসেন, বাসুদেব গাইতোন্ডে, এস এইচ রাজা প্রমুখ। অন্যদিকে চলছে জমজমাট রিহার্সাল— নেতৃত্ব দিচ্ছেন এব্রাহিম আলকাজি। কখনও ঢুকে দেখলেন, ইংল্যান্ড থেকে হাজির হয়েছেন জর্জ হ্যারিসন। বিটলস্-এর এই সদস্য ভারত-অনুরাগী, ভালোবাসেন এদেশের শাস্ত্রীয় সংগীত। পণ্ডিত রবিশঙ্করের নিবিড় বন্ধু তিনি। পড়ুয়ারা থিয়েটারের শো দেখতে বা লাইব্রেরির সদস্যপদ নিতে অনেকটা ছাড় পান। মায়ানগরীর দাদরে শিবাজী পার্কে রয়েছেন নাট্য-বিশেষজ্ঞ ও লেখিকা শান্তা গোখলে। তাঁকে আমরা বলতেই পারি এক কথক ঠাকরুণ। পাতালপুরীর বইয়ের দোকানে আসেন দাস্তানগো, আর স্বপ্নপুরীর পরিসরে আমরা শুনি কথক ঠাকরুনের জবানী। চোখের সামনে দেখেছেন বিজয় তেন্ডুলকর, গিরিশ কারনাড, শ্যাম বেনেগল, সত্যদেব দুবে, বিজয়া মেহতা, মহেশ এলকুঞ্চওয়ার, তরলা মেহতাদের উত্থান। বই খুঁজতে সবাই যেতেন সমুদ্রের কাছ ঘেঁষা ওই সংস্কৃতি-কেন্দ্রে। গিয়েছিলেন আমাদের বাদলবাবুও। অর্থাৎ বাদল সরকার। এইসব দেখেছেন শান্তা। বক্তৃতা দিয়েছেন দেশ-বিদেশে। এইসব কথা লিখেওছেন বিস্তর। এঁর কাছে এবং মূলত গিরিশ কারনাডের স্মৃতিচারণ থেকে সে সময়ের নানা কথা জেনেছে এই প্রতিবেদক। ভারতজোড়া বিকল্প থিয়েটারের উত্থান-কাহিনির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যুক্ত রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
গিরিশ তখন থাকেন ব্যাঙ্গালোরের জে পি নগরের বসতবাড়িতে। গাছের শীতল ছায়া আর ঘর ভর্তি বইপত্রের সামনে তাঁর রকিং চেয়ারে বসে বলে চলেন নানা কথা। কথা শেষে অস্থায়ী আস্তানায় ফেরার সময় কানে বাজত দেবব্রত বিশ্বাসের গমগমে গলা— ‘এলেম নতুন দেশে—/
তলায় গেল ভগ্ন তরী, কূলে এলেম ভেসে।/ অচিন মনের ভাষা শোনাবে অপূর্ব কোন আশা/ বোনাবে রঙিন সুতোয় দুঃখসুখের জাল,/ বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল—/ নতুন বেদনায় ফিরব কেঁদে হেসে।’
বিকল্প থিয়েটারের প্রসঙ্গে বলতেই হবে গণনাট্য সংঘের কথা। বোম্বাই শহরের মাড়ওয়ারি বিদ্যালয় হল-এ ১৯৪৩ সালের ২৫ মে, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠা। একই সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস। এই অধিবেশনে যজ্ঞ দিতে এসেছিলেন কবি, লেখক, লোকগায়ক, নাট্যকার, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, সারা দেশ থেকে। লাল পতাকার মেলা ভরে উঠেছিল গানে গানে, কবিতায়, নৃত্যছন্দে— শতজল ঝর্নার ধ্বনি। এর আগে অবশ্য প্রগতি লেখক সংঘের পালা। আর ১৯৪৪ সালের ২৪, ২৭ অক্টোবর এবং ১০, ১৩, ১৪, ১৭ ও ২০ নভেম্বর, ‘নবান্ন’ নাটকের প্রযোজনা। ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের নাট্য বিভাগ, যা ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শাখা, তারাই প্রযোজনা করল বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘নবান্ন’। যুগ্ম নির্দেশক শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্য। ক্রমশ গণনাট্য সংঘের কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়ল পূর্ববঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি অঞ্চলে। আধুনিক ভারতীয় নাটকের এই এক বিস্তার। সেই সঙ্গে ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ১৯৪৮ সালে। দেশের পশ্চিমে, আরব সাগরের তীরে উপস্থিত হচ্ছেন এব্রাহিম আলকাজি। Royal Academy of Dramatic Arts (London) বা রাডা-এ প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ইংলিশ ড্রামা লিগ এবং বিবিসি-র সম্মান পাচ্ছেন। লন্ডনে কাজ করার সুযোগ পেয়েও ফিরে আসছেন বোম্বাইতে। সেটা গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের গোড়ার সময়। মনে রাখতে হবে, তিনি জলরং, চারকোল, স্কেচ পেন, প্যাস্টেল, কার্বন ট্রেসিং – এগুলিতে দক্ষ ছিলন। প্রথমে যুক্ত হয়েছিলেন বম্বে প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্টস্ গ্রুপ-এ। তাঁর সহযাত্রীরা ছিলেন আকবর পদমসি, তায়েব মেহতা, এম এফ হুসেন, এস এইচ রাজা প্রমুখ। এঁদের সকলের কাজের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল বোম্বাইয়ের ভুলাভাই দেশাই মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউট। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল ১৯৪৬-এ, যে-বছর প্রয়াত হন ভুলাভাই দেশাই। তাঁর পুত্রবধূ মাধুরীবেন দেশাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই সংস্কৃতিকেন্দ্রের। মাধুরীবেন নিজেও ছিলেন শিল্প-ইতিহাসবিদ। এঁদের সংগ্রহে ছিল বহুসংখ্যক বই।
গিরিশ কারনাডের মনে পড়ে, তিনি এবং তাঁর বন্ধু অশোক কুলকার্ণি, উভয়ই এসেছিলেন বেলগাঁও থেকে। গিরিশ তখন বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিবিজ্ঞানে এমএ ক্লাসের ছাত্র। অশোক ছিলেন থিয়েটার বিষয়ে প্রবল উৎসাহী। নৃত্যশিল্পী মার্থা গ্রাহাম এসেছিলেন বোম্বাইতে। নৃত্যকলা ও থিয়েটারের সম্পর্ক নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল ওয়ার্কশপের। এই উদ্যোগে শামিল হয়েছিলেন আলকাজি নিজে এবং তরুণ সত্যদেব দুবে। ওয়ার্কশপের দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ভুলাভাই দেশাই মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটে। সেই সময়ে, একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র— নানারকম অর্কেস্ট্রা, ব্যালে প্রভৃতির নিয়মিত যাতায়াত। সেইসঙ্গে আসছে রাশিয়ান সাহিত্য। কে নেই তাতে— পুশকিন, গোগোল, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, আন্তন চেকভ, ম্যাক্সিম গোর্কির একের পর এক বই। বইয়ের গাড়ি এসে দাঁড়ায় ওয়ার্ডেন রোডের এই কেন্দ্রে। গিরিশ বলতেন, পূর্ব ভারত আর পশ্চিম ভারতে যুগ্ম সূর্যোদয়। পূর্বে শম্ভু মিত্র এবং পশ্চিমে এব্রাহিম আলকাজি। ব্রিটিশ থিয়েটারের গণ্ডীতে আবদ্ধ না থেকে আলকাজি উন্মোচন করছেন পশ্চিম দিগন্তের মঞ্চমায়া। তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হচ্ছে জঁ আন্যুই-এর ‘আন্তিগোনে’, ‘ইউরিডিসে’, হেনরিক ইবসেনের ‘হেডা গেবলার’, অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের ‘মিস জুলি’, তাছাড়া লোরকা, চেকভ ইত্যাদি। জঁ আন্যুই-এর ‘আন্তিগোনে’-র বিপুল প্রভাব গিরিশের নাট্য-চিন্তায়। ওই যে ‘venom-spewing’ নারী চরিত্র এবং ‘big confrontations’, তিনি ধরতে চাইছেন ‘আন্তিগোনে’ দেখার পর। যযাতি পুরাণ-আশ্রিত তাঁর প্রথম নাটক ‘যযাতি’ রচনা এই সময়ে। যযাতিকে কেন্দ্র করে শর্মিষ্ঠা আর দেবযানীর তীব্র বাকযুদ্ধ এই নাটকের বড় সম্পদ। থিয়েটার আর থিয়েটার। এমএ পরীক্ষা দেওয়া হল না। বাড়িতে তুলকালাম পরিস্থিতি। ইতিমধ্যে জানা গেল, গিরিশ Rhodes scholar হয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ‘ভাগ্যিস পেয়েছিলাম’। ১৯৬৩ সালে পশ্চিম দেশের পড়াশোনা শেষে ফিরে এলেন বোম্বাইতে। তবে পশ্চিমের টান রয়েই গেল পরবর্তীকালেও। পরে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হলেন। ইংল্যান্ডের Haymarket Theatre-এ প্রযোজিত হল তাঁর ‘বলি দ্য স্যাক্রিফাইস’ নাটকটি। নাম ভূমিকায় নাসিরুদ্দিন শাহ। মার্কিন দেশের Guthrie Theatre-এ প্রযোজিত হল ‘নাগমণ্ডল’।
আরও পড়ুন: থিয়েটারে বাস্তবে যেভাবে প্রতিবাদের মুখ হয়েছে মণিপুরের মেয়েরা
শ্যাম বেনেগল আলকাজিকে একটি ব্যক্তি-নাম মনে করেন না। বরং তাঁর মতে আলকাজি এক নবজাগরণ। Kemp’s Corner-এর একটা ছোট্ট আবাসনে থাকতেন আলকাজি, ভুলাভাই ইন্সটিটিউটের অদূরে। শ্যাম মনে করেন, ওই ইন্সটিটিউটকে কেন্দ্র করে এগিয়ে এল নতুন প্রজন্ম। সত্যদেব দুবে চেকভ ভালোবাসেন। নিজে লিখতেন ছোট ছোট নাটক। পরে তাঁর ‘যযাতি’, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘পাগলা ঘোড়া’ প্রভৃতি প্রযোজনা ঝড় তুলবে ভারতজুড়ে। শ্যাম বেনেগল তখন বিবাহিত। ঘরে রয়েছে তাঁর শিশুকন্যা। বিজয় তেন্ডুলকর এবং গিরিশ কারনাড সেদিন রয়েছেন
তাঁর ফ্ল্যাটে – উপলক্ষ্য, একটি চিত্রনাট্য রচনা। মধ্যরাত্রে দু’জনের এমন তর্কাতর্কি যে ভয় পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করল বাচ্চা মেয়েটি। শ্যাম বাধ্য হয়ে দুই তার্কিককে নামিয়ে দিলেন বাড়ির নীচে ফুটপাতে। বললেন, তর্ক শেষ হলে ফিরে এসো।
কুসুম বেহল্, তরলা মেহতা, অলকনন্দা সামর্থ, সুলভা দেশপান্ডে প্রমুখ দাপুটে অভিনেত্রীদের উত্থান এই সময়ে। শান্তা গোখলের পর্যবেক্ষণে, বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার আদানপ্রদানেরও কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই ইন্সটিটিউট। প্রিয়া আদারকর অনুবাদ করলেন তেন্ডুলকরের ‘শান্তাতা! কোর্ট চালু আহে’ ইংরেজিতে (‘Silence! The Court is in Session’)। সর্বভারতীয় খ্যাতি পেলেন বিজয় তেন্ডুলকর। তিনি নিজে মারাঠিতে অনুবাদ করলেন গিরিশের ‘তুঘলক’ এবং মোহন রাকেশের ‘আধে আধুরে’। গিরিশ নিজে অনুবাদ করলেন বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ (‘Evam Indrajit’)। বিজয়া মেহতা তদানীন্তন Berlin Ensemble-এর সহযোগিতায় প্রযোজনা করলেন ব্রেখট্-এর ‘Caucasian Chalk Circle’ মারাঠিতে।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর প্রথম সংগীতশিক্ষা কেন্দ্র ‘কিন্নরা’ প্রতিষ্ঠা করেন ভুলাভাই দেশাই মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটে। পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, তবলিয়া শঙ্কর ঘোষ, কণ্ঠসংগীত শিল্পী শোভা গুর্তু একের পর এক অনুষ্ঠান করেছেন এখানে। পণ্ডিত রবিশঙ্কর-এর ‘Rhythm and Melody’ শীর্ষক প্রযোজনায় আলো করলেন আজকের শতবর্ষীয়ান তাপস সেন, নৃত্যপরিচালনা করলেন বৈজয়ন্তীমালা বালী। চিত্রকর বাসুদেব গাইতোন্ডে ছিলেন এই প্রযোজনার শিল্পনির্দেশক।
পরবর্তীকালে বম্বের ওয়ালচন্দ টেরেস এবং ছবিলদাশ স্কুলের হল-এ যে নাট্য আন্দোলন, তার সূচনাও এই কেন্দ্রকে ঘিরে। এখন সব অলীক! অতএব ভরসা বুঝি পাতালপুরী! দস্তয়েভস্কির আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যানের মতো বলতে হয়— ‘ I am a sick man… I am a spiteful man. I am an unattractive man. I think my liver is diseased…’
‘দোকানটা কোথায়?’
জুহু বিচে পৃথ্বী থিয়েটারে প্রবেশপথে বইয়ের দোকানটি মনে করিয়ে দেয় ভুলাভাই ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরির কথা। তবে সোলি বাটলিওয়ালার মতো শিল্প-অনুরাগী মানুষ আজ কোথায়! তিনি ছিলেন এই সংস্থার মুখ্য ব্যবস্থাপক। নামমাত্র মূল্যে যাঁরা গান ভালোবাসেন, নৃত্যকলা ভালোবাসেন, থিয়েটার ভালোবাসেন, তাঁদের খোঁজ করে আনা হত এই কেন্দ্রে। ভুলাভাইয়ের বাসগৃহটিই হয়ে উঠেছিল সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্তের হদিশ পাওয়ার ঠিকানা। আধুনিক শিল্পের অন্তর্বলয়ে প্রবেশের এই কেন্দ্রকে ঘিরে বাসুদেব গাইতোন্ডের একটি বিখ্যাত বক্তব্য উদ্ধৃত করা হল—
“Artists need to be in contact with other professions, music, theatre, books… You can’t stop thinking. You have to go out of your way to listen to music. A writer must know what a painting is, what music is… both Indian as well as world… a dancer must know about theatre… and so on.”
গ্রন্থ সহায়:
১) যখন যেমন ভাবি, অর্ক দেব, ঋত প্রকাশন, ২০২৪
২) The Scenes We Made: An Oral History of Experimental Theatre in Mumbai, Ed. Shanta Gokhale, Speaking Tiger, 2016
৩) Introductory essay from ‘The Scenes We Made’ by Girish Karnad
৪) নবান্ন : প্রযোজনা ও প্রভাব, সুধী প্রধান, প্রসঙ্গ সংস্কৃতি প্রকাশন, ১৯৯৬
৫) এই প্রতিবেদকের সঙ্গে গিরিশ কারনাডের দীর্ঘ কথোপকথন
৬) এছাড়াও কথা বলেছেন শান্তা গোখলে, সত্যদেব দুবে