বন্ধুত্বে অন্ধ! গাজার হাসপাতালে ইজরায়েলি ধ্বংসলীলার দায় অন্য ঘাড়ে চাপাচ্ছেন বাইডেন?
Joe Biden in Israel: প্রায় কুড়িটিরও বেশি দেশ ইজরায়েলের বিরোধিতা করে গাজার পাশে দাঁড়ালেও পুরনো বন্ধুত্বে আঁচড়টুকুও আসতে দেননি বাইডেন। তাই যুদ্ধের ভ্রুকুটি মাথায় নিয়েই ইজরায়েলে পৌঁছে গিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
বুধবার গাজার হাসপাতালে রকেট হেনেছে ইজরায়েল। এক নিমেষে 'নেই' হয়ে গিয়েছেন হাসপাতালে ভর্তি অসংখ্য অসুস্থ শিশু, মহিলা, পুরুষ। মাটিতে মিশে গিয়েছে আশপাশের ঘরবাড়ি, হাসপাতালের গা ঘেঁষে আশ্রয় নেওয়া মানুষজন। নিজের কর্তব্যটুকু পালন করতে শেষ হয়ে গিয়েছেন অসংখ্য চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী। অন্তত পাঁচশো মানুষের মৃত্যু হয়েছে এই হামলায়। আর এই নিহত মিছিলে সত্যিই যে ঠিক কতজন হামাস জঙ্গি ছিল, তা বলা কঠিন। অথচ হাসপাতালের মতো জায়গায় বোমা ফেলতে এক মুহূর্তও ভাবেনি নেতানিয়াহুর সেনা। সেই ইজরায়েলের রাজধানী তেল আভিভে বুধবার সকালেই পা রেখেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রায় কুড়িটিরও বেশি দেশ ইজরায়েলের বিরোধিতা করে গাজার পাশে দাঁড়ালেও পুরনো বন্ধুত্বে আঁচড়টুকুও আসতে দেননি বাইডেন। তাই যুদ্ধের ভ্রুকুটি মাথায় নিয়েই ইজরায়েলে পৌঁছে গিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তেল আভিভে তাঁকে স্বাগত জানাতে স্বাভাবিক ভাবেই বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
প্রাথমিক ভাবে বাইডেনের অবশ্য যাওয়ার কথা ছিল জর্ডনে। সেথানে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক নেতার সঙ্গেও দেখা করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু গাজার হাসপাতালে ইজরায়েলের বোমাবর্ষণের পর সেই যাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হন বাইডেন। কথায় বলে, ভালোবাসা অন্ধ। তবে শুধু ভালাবাসা নয়, কোনও কোনও সময় বন্ধুত্বও অন্ধ হয়ে যায়। আর সেটাই বারবার প্রমাণ করছেন জো বাইডেন সরকার। নাহলে গাজার উপর চালানো ইজরায়েলের নৃশংস হামলাকে শাক দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
আরও পড়ুন: গাজার হাসপাতালে ইজরায়েলি রকেট! রোগীদের ছিন্নভিন্ন দেহ গুনছে প্যালেস্তাইন
গাজার আল আহলি হাসপাতালে ইজরায়েলের হানা রকেট আদতেও কি ইজরায়েলের ছোড়া? এবার এমনই প্রশ্ন তুলে বসলেন বাইডেন। তাঁর দাবি, ইজরায়েলের সরকারি বাহিনী নয়, অন্য কোনও দলের ছোড়া রকেটই ধ্বংস করেছে গাজার ওই হাসপাতালটিকে। নেতানিয়াহুকে আলিঙ্গন করে নাকি সেই আশ্বাসই দিতে দেখা গিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে ওই হামলায় নিহত গাজাবাসীর জন্য শোকপ্রকাশ করেছেন বাইডেন।
এদিকে হামাস চালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে, আকাশ পথে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। যার ফলে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যদিও সেই হামলার দায় অস্বীকার করেছে ইজরায়েলের সেনাবাহিনী। তাঁদের বক্তব্য, ইজরায়েলের দিক থেকে নয়, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জেহাদ নামে অন্য একটি জঙ্গিদল এই হামলার জন্য দায়ী। এদিকে, সেই জঙ্গিদলটিও হামলার দায় স্বীকার করেনি।
বিশ্বের অন্যতম বাহুবলী দেশ আমেরিকার রাষ্ট্রনেতা গাজাবাসীর দুর্দশার কথা সবটাই জানেন, মানেনও। তবে বন্ধুত্বের খাতিরে তা স্বীকার করতে চান না। এদিকে বাইডেনের মতো রাষ্ট্রনেতার এই দাবি যেমন ইজরায়েলের এই ভয়াবহ নৃশংসতাকে মদত দিয়েছে, তেমন ভাবেই গাজাবাসীর সঙ্কটকেও বাড়িয়েছে বলেই মন অভিজ্ঞদের। যদিও মুখে সমাধান খোঁজার পরামর্শই শোনা গিয়েছে বাইডেনের মুখে। এমনকী গাজায় যাঁরা অহরহ মরছেন, তাঁরা যে নিরপরাধ সে ব্যাপারেও দ্বিধা নেই তাঁর।
কিন্তু একই সঙ্গে ৭ অক্টোবর হামাসবাহিনী ইজরায়েল জুড়ে যে ভয়ঙ্কর হামলা চালিয়েছে, যেভাবে ১৪০০ মানুষের প্রাণ কেড়েছে, সে কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে ইজরায়েল ও গাজার এই টানাপড়েন নিয়ে উদ্বিগ্ন আমেরিকা, জানিয়েছেন বাইডেন।
এদিকে বিপদের সময়, বিশেষ করে এমন যুদ্ধের সময়, যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই পাশে দাঁড়ায়নি ইজরায়েলের, তেমন একটি মুহূর্তে আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশকে পাশে পেয়ে খুশি ইজরায়েলের শাসক বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিনি জানান, বাইডেনের তেল আভিভে আসার সিদ্ধান্ত তাঁকে আস্থা জুগিয়েছে। এর জন্য আমেরিকাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পাশপাশি নেতানিয়াহু বাইডেনকে জানান, সভ্যতার বাহিনী আর বর্বরতার বাহিনীর মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আর এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে হামাসকে প্রতিহত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ইজরায়েল। হামাসরা আইএসআইএসদের চেয়ে ভয়ঙ্কর বলে জানিয়ে নেতানিয়াহুর দাবি সভ্য পৃথিবীর উচিত তাঁর এই লক্ষ্যের সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করা। তবে তা যে হচ্ছে না আদপেই, তা ভালোই বুঝতে শুরু করেছেন নেতানিয়াহু। দিন কয়েক আগেই সামনে আসে কুড়িটি দেশের একটি দীর্ঘ তালিকা, যারা ইজরায়েলের এই গাজাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এই নৃশসংতাকে সমর্থন করেনি মোটেই।
ইজরায়েল সফরে এসে বাইডেনের দেখা করার কথা রয়েছে হামাসদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত ও পণবন্দিদের পরিবারের সঙ্গে। তবে গুরিয়ন বিমানবন্দরে নেমেই প্রথমেই তাঁর দেখা হয় তাঁর কাউন্টারপার্ট নেতানিয়াহুর সঙ্গে। এক মাস আগেই রাষ্ট্রপুঞ্জের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে দেখা হয়েছি দুই রাষ্ট্রনেতার। সেখানে নেতানিয়াহপ প্রসঙ্গ তুলেছিলেন ইজরায়েল ও সৌদি আরবের ঐতিহাসিক শান্তি নিয়ে। তবে গাজার সঙ্গে যুদ্ধের জের যত বাড়ছে, ততই ক্ষীণ হচ্ছে নেতানিয়াহুর সঙ্গে আরব-প্রতিবেশী সম্পর্কে উন্নতির সম্ভাবনা। এখনও পর্যন্ত ইজরায়েলের একের পর এক হামলা ধেয়ে এসেছে গাজার দিকে। এখনও পর্যন্ত খুব কম করে হলেও তিন হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়়ে আছেন কম করে হলেও ১২০০ জন। তারা বেঁচে আছেন না মারা গিয়েছেন এতদিনে, তা জানার উপায় নেই। এমনকী উপায় নেই উদ্ধারেরও। অসংখ্য মানুষ পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন বটে, তবে দিনের শেষে ধ্রুব শুধু গাজাবাসীর মৃত্যু। বুধবার ঠিক কী কারণে গাজার ওই হাসপাতালে বোমা ফেলা হল, পরিষ্কার নয় তার কারণও। সেই হাসাপাতালটিতে চিকিৎসা চলছিল অসংখ্যা যুদ্ধাহতের। তাঁদের যেটুকু বেঁচে যাওয়ার আশা ছিল, সেটুকুকেও কার্যত নিভিয়ে দিয়েছে ইজরায়েল, সাম্প্রতিক এই হামলায়। পশ্চিম ব্যাঙ্কের দিকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন অসংখ্য মানুষ।
আরও পড়ুন: গাজাকে ঢাল করে লড়ছে হামাস, ইজরায়েল
এদিকে গাজার যুদ্ধে শামিল হতে শুরু করেছেন বেইরুট, লেবানন, আম্মান, জর্ডনের মচো জায়গা থেকে মানুষ। ইজরায়েলি দূতাবাসের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তাঁরা। হাসপাতালে বোমা ফেলার ঘটনায় তিন দিনের শোকদিবস ঘোষণা করা হয়েছে। জো বাইডেনের সফরসূচি বাতিল করে কার্যত বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমেরিকার সঙ্গে অন্তত ইজরায়েল নিয়ে একমত হতে পারছে না আরব নেতারা। যদিও ওয়াশিংটনে ফেরার আগে আরব নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপের কথা রয়েছে বাইডেনের। তবে আদৌ তা হবে কিনা তা নিয়েও বেশ খানিকটা সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যত ইজরায়েলের দিকে ঝুঁকছে আমেরিকা, ততই আরব দেশগুলো এক পা এক পা করে পিছন দিকে হাঁটতে চাইছে, তাতে সন্দেহ নেই। ইজরায়েলে হামাসের হামলার ঘটনা নিন্দনীয় তো ছিল বটেই। তবে তার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যে ভাবে অবিরাম গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল গাজা জুড়ে, তাতে ক্রমশ সব রকম সহানুভূতিই হারাচ্ছে নেতানিয়াহুর দেশ। এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কবে মোহভঙ্গ হয়, আদৌ হয় কিনা, সেটাই দেখার।