কেন আজও আদিবাসীদের 'ভগবান' বিরসা মুন্ডা, জেদেই ঘুম উড়িয়েছিলেন ব্রিটিশদের

Birsa Munda: তিনি ‘ভগবান’ বিরসা মুন্ডা। কেন 'ভগবান'? কেন তাঁর হাত ধরে বিরসা ধর্মের জন্ম হয়েছিল? ফিরে দেখা যাক সেই ইতিহাস।

ভারত সরকারের তরফে ১০ নভেম্বর, ২০২১ একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় যে, এবার থেকে বছরের একটি বিশেষ দিনে জনজাতি গৌরব দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এই দিনটি বীর আদিবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমর্পণ করা হয়। উদ্দেশ্য, নতুন প্রজন্মকে তাঁদের বিষয়ে জানানো। কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা অনুসারে এই দিনকে প্রতি বছর গৌরব দিবস হিসেবে পালন করা হবে এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মাথায় রেখে আদিবাসীদের ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে, গৌরব দিবস পালনের জন্য ১৫ নভেম্বরকেই কেন বেছে নেওয়া হয়েছে? আসলে এই দিনেই, ১৮৭৫ সালে একজন 'ভগবান'-এর জন্ম হয় মানুষের ঘরে। তিনি ‘ভগবান’ বিরসা মুন্ডা। কেন 'ভগবান'? কেন তাঁর হাত ধরে বিরসা ধর্মের জন্ম হয়েছিল? ফিরে দেখা যাক সেই ইতিহাস।

বিরসা মুন্ডার জন্ম হয় উলিহেতু গ্রামে, যা বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত। তাঁর জন্মের আগেই, ১৮৫৭ সালে, মহাবিদ্রোহের সময় চূড়ান্ত নৃশংসভাবে দমন করা হয় বিপ্লবীদের। বিপ্লব শেষ হয়ে গেলেও ইংরেজ তখন অনেক সতর্ক হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশদের তৈরি নিয়মে ভারতীয়রা ক্রমশই দুর্দশার চরমে নেমে যাচ্ছিল। বিশেষ করে, কৃষিব্যবস্থায় এমন অনেক নিয়ম ছিল, যার মাধ্যমে সহজেই ব্রিটিশরা ভারতীয় কৃষকদের ঠকিয়ে ক্রমাগত তাঁদের জমি দখল করে যাচ্ছিল। সেই সময়েই ব্রিটিশ শাসকরা আদিবাসী কৃষকদের ছোটনাগপুর গ্রামে চাষআবাদের জন্য বাধ্য করে। জানিয়ে রাখি, ছোটনাগপুর গ্রামের বিশেষ ভূমিকা আছে বিরসা মুন্ডার এই গল্পে।

আরও পড়ুন: সত্যিই কি বিরসা মুন্ডা ছিলেন বিষ্ণুর একাদশ অবতার?

বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ এবং পশ্চিমবঙ্গ, ও বিহারের কিছু কিছু এলাকা জুড়ে ছোটনাগপুর গঠিত। ১৮৭৪ সালের মধ্যে এই এলাকার মুন্ডা এবং বাকি জনজাতির আদিবাসীদের সামাজিক অবস্থা পুরোপুরি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। নিজেদের ঘরবাড়ি, জমি হারিয়ে, এই জাতি বাস্তুহারায় পরিণত হয়। ইংরেজরা এই জনজাতিদের মানুষের পর্যায়েই ফেলতো না। কেবলই অত্যাচার করা হতো তাঁদের ওপর। এইভাবে বছরের পর বছর অত্যাচার চলছিল। এরপর জন্ম হয় বিরসা মুন্ডার। জন্মের পর শিক্ষালাভের কারণে ধর্ম পরিবর্তন করে ক্রিশ্চান হয়ে যান তিনি। নতুন নাম হয় বিরসা ডেভিড। যদিও কিছু বছর পর, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের আদি ধর্মেই ফিরে যান তিনি। এভাবেই বিরসা মুন্ডা, ‘ভগবান’ বিরসা মুন্ডাতে পরিণত হন।

বিরসার নেতৃত্বে শুরু হয় 'মুন্ডা উলগুলান'। এটি সেই বিদ্রোহ, যেখানে আদিবাসীরা নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য লড়াই শুরু করে। ১৮৯৫ সালে চালকার গ্রামে বিরসা মুন্ডা ইসাই ধর্ম ত্যাগ করেন। এরপর তিনি নিজেকে ভগবানের প্রতিনিধি ঘোষণা করেন, এবং নিজের উপজাতির মানুষের জন্য অধিকারের লড়াই শুরু করেন। তিনি আদিবাসীদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, এবার রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্ব শেষ হয়ে, মুন্ডারাজ্যের উত্থান হবে। চলতি বছরই অগাস্ট মাসে, বিদ্রোহ চলাকালীন তাঁকে গ্রেফতার করে নেওয়া হয়। এবং দু'বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৮৯৮ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সে ফের পুরনো সামাজিক কাজে যোগ দেন তিনি, যে সূত্রে ফের তাঁর শাস্তি হয়েছিল। ফের তিনি আদিবাসীদের মধ্যে বিদ্রোহের বীজ বুনতে থাকেন। যদিও এবার তাঁর চিন্তাভাবনা খানিক অন্য ছিল। এইবার তিনি ধর্মান্তকরণের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুললেন। সেই বছরই ২৮ জুন সমানাধিকারের দাবিতে তিনি ফের বিদ্রোহ শুরু করেন। এইভাবেই দিনের পর দিন বিদ্রোহ চলতে থাকে। এরপর ১৮৯৯ সালে, বড়দিনের কিছুদিন আগে প্রায় ৭০০০ মানুষ উলগুলানের প্রারম্ভের জন্য একত্রিত হলো। তাঁরা স্বরাজ কায়েম করে তাঁদের নিজস্ব ধর্মের প্রচলন শুরু করে। হাজার হাজার আদিবাসী সেই সময়ে ইসাই ধর্ম গ্রহণ করে ফেলেছিল, তাই বিরসা মুন্ডাকে আদিবাসীদের পুনরজাগরণের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। প্রতিদিন দলে দলে আদিবাসী জনতা খালি পায় দূর দূর থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসত। তাকে নিজেদের সমস্যার কথা জানাত। এইভাবে ধীরে ধীরে তিনি আদিবাসীদের কাছে একজন গুরু, একজন ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। এখনও বাংলার বিভিন্ন এলাকায় বিরসা মুন্ডার প্রভাব লক্ষ করা যায়।

১৮৯০ সালের ৫ জানুয়ারি, বিরসা গ্রামের দু'জন পুলিশ কনস্টেবেলকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ছিল, দু'দিন বাদে তিনি ফের আরও একজন কনস্টেবেলকে হত্যা করেন। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং বাড়তি বিদ্রোহ দমন করতে পুলিশের একটি দল পাঠানো হয়েছিল। ওপরমহলের নির্দেশে তারা বিদ্রোহ দমন করতে, আদিবাসীদের ওপর গুলিবর্ষণ আরম্ভ করে, যেমনটা ঠিক জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, সেই গুলিবর্ষণে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়, কাউকে কাউকে খাদে ফেলে দেওয়া হয়, তো কাউকে জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে এত কিছুর মধ্যেও সেদিন বিরসা কোনও ভাবে পালিয়ে বেঁচে গেছিলেন। বেশ কয়েকদিন ছদ্মবেশে থাকলেও আপনজনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই ধরা পরে যান বিরসা মুন্ডা। এরপর ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁকে 'ভগবান' বলে মেনেছিল গোটা জনজাতি। তাই তাঁর পার্থিব শরীরের মৃত্যু হলেও তাঁর চিন্তা-ভাবনা, আদর্শ এবং শিক্ষা প্রবাহিত হয়েছে সমগ্র জাতির মধ্যে।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিরসা মুন্ডার ভূমিকা অতুলনীয় এবং চিরস্মরণীয়। তাঁর নেতৃত্বে সেই সময়ে মুন্ডাদের নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের গল্প এবং বিরসা মুন্ডার জীবনকাহিনি কথিত আছে ‘অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসে। যা রচনা করেছেন লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী।

More Articles