জন্মদিনে বন্ধুদের নিয়ে হইহুল্লোড়, তবুও ভুগছেন হতাশায়! কেন হয় এই 'বার্থডে ডিপ্রেশন'?

Birthday Anxiety Cause : পৃথিবীতে এমন মানুষও আছেন, যারা এই জন্মদিন পালন থেকে কয়েকশো হাত দূরে থাকতে চান। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে পার্টি নয়; সেখানে থাকে অবসাদ।

জন্মদিন মানেই বেশিরভাগ মানুষের কাছে একরাশ আনন্দ। পৃথিবীতে প্রথম পা রাখার দিনটা কি এত সহজে ভোলা যায়? শুধু তাঁর নয়, পরিবার, আত্মীয়দের কাছেও একটা বিশেষ দিন। কেক কাটা, নিত্যনতুন উপহার, বাড়িতে মায়ের হাতের রান্না, পায়েস… সেইসঙ্গে একটু আলাদাভাবে দিনটি কাটানো। প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে কিছু মুহূর্ত উদযাপন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হইহুল্লোড়, পার্টি – সব মিলিয়ে আনন্দেই কাটে অনেকের। বয়স তো না হয় আরও একধাপ বাড়ল; তাই বলে এমন বিশেষ দিনটিকে এড়িয়ে যাবেন! নৈব নৈব চ! তাই তো এমন উদযাপনের রীতি গোটা বিশ্বজুড়ে।

তবে লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে ‘বেশিরভাগ মানুষের’। অনেকেই জন্মদিনের আনন্দে মেতে ওঠেন বটে; কিন্তু সবাই নয়। এমনও বহু মানুষ আছেন, যারা এই বিশেষ দিনটি ঘিরে বেশ আতঙ্কে থাকেন। জন্মদিন শব্দটি শুনলেই তাঁদের মনে হয়, এটি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। অজস্র চিন্তা মাথার মধ্যে ভিড় করে। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই দিনটির কথা ভাবলেই হতাশা যেন আরও বেশি করে গ্রাস করে। নেমে আসে অবসাদ, দুশ্চিন্তা। জন্মদিন ঘিরে আবার অবসাদ! এ আবার হয় নাকি!

কিন্তু গবেষণা বলে, এমনটাও হয় থাকে। পৃথিবীতে এমন মানুষও আছেন, যারা এই জন্মদিন পালন থেকে কয়েকশো হাত দূরে থাকতে চান। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে পার্টি নয়; সেখানে থাকে অবসাদ। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় ‘বার্থডে অ্যানজাইটি’ বা ‘বার্থডে ডিপ্রেশন’। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই নামেই ডাকা হয় এই বিশেষ সমস্যাটিকে। ঠিক সমস্যা বললে হয়তো খানিক ভুল হবে, এটা এক ধরনের মানসিক অবস্থা। জন্মদিন ঘিরে এমন হা-হুতাশ বহু মানুষেরই হয়। কিন্তু কেন?

কী এই বার্থডে ডিপ্রেশন?

বার্থডে ডিপ্রেশন, বা বার্থডে অ্যানজাইটি কিংবা বার্থডে ব্লুজ। এরকম বেশ কয়েকটি নামেই ডাকা হয় একে। চিকিৎসকদের ভাষায়, জন্মদিনের কথা ভাবলেই অনেকে কষ্ট পান। এমনকী সেই বিশেষ দিনে বন্ধুবান্ধবদের ভিড়, আনন্দ এসব থেকেও দূরে থাকতে ইচ্ছে করে ওই মানুষদের। তাঁদের মনে হয়, জন্মদিন নিয়ে এই মাতামাতি না হলেই ভালো হয়। এই মানসিক অবস্থাকেই বার্থডে ডিপ্রেশন বলা হয়।

তবে কেবল এসব নয়, জন্মদিনে এই মানুষরা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েন। যেদিন একটু বেশি আনন্দ করার কথা, সেদিন যেন সমস্ত শক্তি কোথায় হারিয়ে যায়। বারবার একটাই কথা মনে হয়, “এতদিন ধরে জীবনে কী করলাম?” বয়স একটু একটু করে বাড়ছে, একাকীত্বও বাড়ছে, এমন চিন্তাও যেন আরও বেশি করে পেয়ে বসে। বিজ্ঞানীরা বলেন, বেশিরভাগ সময় জন্মদিনের দিনই এই চিন্তা ধরা দেয় বেশি করে। অনেক সময় তার পরেও কয়েকদিন পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যায় এই মানসিক কষ্ট।

কেন হয় এই বার্থডে ডিপ্রেশন?

সবার আগে বলে রাখা ভালো, এটি কোনও মানসিক অসুখ নয়। বরং মনের একটি বিশেষ অবস্থা, যা ওই বিশেষ দিনটিতেই আঘাত করে। মনোবিদরাও পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন, বার্থডে ডিপ্রেশন কোনওভাবেই মানসিক অসুখ নয়। কিন্তু কেন হয় এমন? মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এর পেছনে অনেকগুলি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। হয়তো জন্মদিনের আগে বড় কোনও মানসিক ঝড় বয়ে গিয়েছে ওই মানুষটির জীবনে। সেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে। আর জন্মদিন বারবার হয়তো সেই মন খারাপের, সেই ট্রমার ইঙ্গিতই দিয়ে যায়। কিংবা আগে কোনও খারাপ ঘটনা ঘটলে, জন্মদিনের দিন সেটি হঠাৎ করেই মনে দাগ বসায়। সেজন্যও এমন অবসাদ আসতে পারে।

এছাড়াও জন্মদিনের আগে বা তার কাআছাকাছি সময় যদি এমনিই অবসাদ এসে ধরা দেয়, তাহলে সেটি কায়েম থাকে। সেই কারণেও বার্থডে ডিপ্রেশন হতে পারে। জন্মদিন আসা মানে একধাপ করে বয়স বাড়া। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ছে, মাথায় একটা দুটো করে পাকা চুল দেখা দিচ্ছে, শরীরে বাসা বাঁধছে রোগ, আগের মতো আর চনমনে নেই – এমন চিন্তাও ভিড় করে জন্মদিনের মুহূর্তে। বয়স বাড়ার এই চিন্তাও একটা পর্যায় অবসাদ ডেকে আনে।

বার্থডে ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলি কী কী?

বার্থডে ডিপ্রেশন বা বার্থডে ব্লুজের বেশকিছু লক্ষণ থাকে। সাধারণত মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এটি। মানুষও ভেঙে পড়ে একেবারে। সাধারণত এরকম লক্ষণই দেখা যায় –

১) জন্মদিনের দিন বা তার আগে পরে হঠাৎ করে মুড বদলে যাওয়া। আনন্দ নয়, বরং সারাক্ষণ দুঃখ ঘিরে থাকবে আপনাকে।

২) অন্যান্য সময়ের থেকে একটু বেশিই দুঃখ, মুখ-চোখ শুকনো দেখাবে। মনে হবে, সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকি, ঝিমিয়ে থাকি।

৩) অন্যান্য সময়ের থেকে একটু বেশিই কান্না পাবে।

৪) বারবার অতীতের ঘটনাগুলির দিকে ফিরে দেখা, ভুলগুলো মাথার মধ্যে আউড়ে যাওয়া। এছাড়াও জীবনে এখনও অবধি কী পাননি তা নিয়ে বারবার আফসোস করা।

৫) খাওয়া দাওয়া, ঘুমনোর স্বাভাবিক সময়ের অদলবদল।

৬) বারবার মনে হওয়া ‘আর কতদিন বাঁচব?’

৭) নিজেকে একেবারে একা করে দেওয়ার ভাবনা

৮) শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যন্ত্রণা

কী করে বার্থডে ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসা যাবে?

মুক্তির উপায় খুঁজতে মনোবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বেশকিছু পরামর্শ দেন। যেমন –

১) নিজের ভেতরে যা চলছে, যা মনে হচ্ছে সেটাকে চেপে না রেখে বাইরে আনা। যদি মনে হয় হইহুল্লোড় করতে ইচ্ছে করছে না, তাহলে জোর করে করতে হবে না। নিজেকে সময় দেওয়াটা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে নিজের ভেতরে যা কিছু চলছে, সেসব বাইরে নিয়ে আসাটাও দরকার।

২) নিজেকে বোঝা, নিজের মনের অবস্থা বোঝা খুব প্রয়োজন। মানুষের মনের ভেতর কী চলছে, সেটা বাইরে থেকে দেখলে হয়তো আন্দাজ করা যায়, কিন্তু আসল জায়গাটা যে ভুক্তভোগী সে-ই জানে। তাই তাঁর দরকার নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা। নিজের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ সমস্ত কিছুকে খোলাখুলি বোঝা। আপনি বুঝলে তবেই এর সমাধানের রাস্তা খুঁজে বের করতে পারবেন।

৩) বিশ্বাস আর ভরসা, এটা খুব বড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস। জীবনে এমন মানুষ থাকা খুব জরুরি, যাকে আপনি মন খুলে ভরসা করতে পারেন, কথা বলতে পারেন। তিনি যে কেউ হতে পারেন। সেই মানুষটির সঙ্গে কথা বলুন, নিজের কষ্টের কথা চেপে না রেখে তাঁকে বলুন। কথা বলাটা জরুরি। কেবলতে পারে, হয়তো এর মাধ্যমেই ভালো থাকার দরজা খুলে গেল!

৪) বাকিরা পার্টি করছে, আনন্দ করছে মানে আপনাকেও করতে হবে, তার কোনও মানে নেই। জন্মদিন আপনি যেভাবে পালন করতে চান, করতে পারেন। কেউ আপনাকে বাধা দেবে না। সেটা সম্পূর্ণ আপনার নিয়ন্ত্রণে।

More Articles