মুঘল নয়, খোদ সংস্কৃতে উল্লেখ রয়েছে বিরিয়ানির! জিভে জল আনা এই পদ আসলে কতটা প্রাচীন?
Biryani Origin History : মুঘলরা আসার কয়েকশো বছর আগে থেকেই ভারতে বিরিয়ানি বা বিরিয়ানির মতো বেশকিছু পদের প্রচলন ছিল।
বিরিয়ানি – এই শব্দটিকে বর্ণনা করার নতুন করে বোধহয় কোনও দরকার নেই। কেবল কলকাতাই নয়, গোটা ভারত জুড়ে রমরমিয়ে চলছে এই বিখ্যাত পদটি। যার গন্ধ, স্বাদ আর পরিবেশনই মানুষের মনে তুফান তোলে। বিরিয়ানি ভালোবাসেন না, এমন মানুষ বোধহয় খুব কমই আছে। লখনউ হোক বা হায়দ্রাবাদ, কলকাতা, ঢাকা – প্রতিটা জায়গায় বিরিয়ানির বিভিন্ন রকম বৈচিত্র্য। কেউ মাটন, কেউ চিকেন, কেউ আবার আলু আর ডিমেই খুশি। কিন্তু একটা প্রশ্ন বারবার সামনে চলে আসে, কে শুরু করল বিরিয়ানি? কীভাবে জন্ম নিল এমন জিভে জল আনা কিংবদন্তি একটি পদ?
বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ইতিহাস আমাদের সামনে এসেছে। কেউ কেউ বলেন, আরবের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে প্রাচীন ভারতে বিরিয়ানির প্রবেশ ঘটেছে। তবে প্রচলিত মতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুঘল বাদশাহের পরিবার। তখন ছিল শাহজাহানের রাজত্বকাল। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ছিলেন মুমতাজ বেগম। একদিন তিনি সৈন্যদের অবস্থা সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, মুঘল সেনারা প্রায় প্রত্যেকেই অত্যন্ত ক্লান্ত, করুণ অবস্থা। এরকম করলে বাঁচবে কী করে? যুদ্ধই বা করবে কী করে? এরপরই উপায় বের করলেন মুমতাজ বেগম। রান্নাঘরে গিয়ে খানসামাকে বললেন, সৈন্যদের জন্য বিশেষ পদ তৈরি করতে। মশলা সহযোগে ভাত এবং মাংস একসঙ্গে দিয়ে এমন একটা পদ, যা একবার খেলেই পেট ভরা থাকবে। সেইসঙ্গে শক্তিও হবে। সেখান থেকেই নাকি বিরিয়ানির জন্ম।
এখনকার আধুনিক শেফরা বলেন, বিরিয়ানি এমন একটি পদ, যেটা দেওয়ান-ই-আম থেকে দেওয়ান-ই-খাসে ঢুকেছে। অর্থাৎ রাজ পরিবারের খাস পদ হওয়ার আগে সৈন্য সামন্ত, সাধারণ মানুষরা এসব খেতেন। কিন্তু শাহজাহানের সময় থেকেই কি বিরিয়ানির সূত্রপাত? ইতিহাসের ভেতরে ঢুকলে সেই তত্ত্ব নস্যাৎ হয়ে যাবে। বরং বলা ভালো, মুঘলরা আসার কয়েকশো বছর আগে থেকেই ভারতে বিরিয়ানি বা বিরিয়ানির মতো বেশকিছু পদের প্রচলন ছিল। সেসবই বিবর্তিত হয়ে আজকের জিভে জল আনা বিরিয়ানি উৎপন্ন হয়েছে।
আরও পড়ুন : কোথা থেকে বিরিয়ানি এল এই শহরে? কেন কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানিতে আলু ‘মাস্ট’
মহাভারত
ভারতের এই মহাকাব্যে বিভিন্ন ঘটনাই ধরা পড়েছে। তবে একটি ব্যাপারের দিকে নজর দেওয়া ভালো। সেটি হল ‘পলান্ন’। মহাভারতের নানা জায়গায় এই বিশেষ পদের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। কখনও ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে পলান্ন খাওয়ার কথা বলছেন। কখনও আবার দ্রৌপদী ও পাণ্ডবরাও এই পদ খেতেন। পল যুক্ত অন্নকেই বলা হয় পলান্ন। এই ‘পল’ শব্দটির অর্থ মাংস। তাহলে কি পলান্ন-ই আজকের বিরিয়ানি? সাধারণত ইতিহাসবিদরা বলেন, পলান্ন থেকে এখনকার পোলাওয়ের জন্ম। কিন্তু বিরিয়ানির পূর্বপুরুষও যে হতে পারে মহাভারতের এই পদ, সেটাও বলেছেন ঐতিহাসিকরা। তবে ভাতে আর মাংসে মিলন হলেই সেটা বিরিয়ানি হয় না।
ভারতের অন্যান্য সংস্কৃতি
কেবল মহাভারতের ‘পলান্ন’ই নয়; ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে এরকমই কিছু নাম সামনে আসবে। তামিল সংস্কৃতিতে একটি শব্দ পাওয়া যাবে – ‘পুরুক্কাল’ বা ‘পুজহুঙ্গাল’। যার আক্ষরিক অর্থ হল ‘রান্না করা ভাত’। একইভাবে আর্য সভ্যতায় এই শব্দটিই বদলে হয়ে গিয়েছে ‘পুলাকা’। সংস্কৃতে এর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। শুধু তাই নয়, পঞ্চম শতকে রচিত ‘যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি’তে এই বিশেষ পদটির উল্লেখ আছে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, ‘পুলাকা’, ‘পুরুক্কাল’ আসলে পলান্নের দিকেই ইঙ্গিত করছে। বিরিয়ানির পূর্বপুরুষ হিসেবেই একে উল্লেখ করেছেন ঐতিহাসিকরা। আর এই গোটা সময়টা কিন্তু মুঘল যুগের বহু আগের।
আরও পড়ুন : বাংলার বিরিয়ানির বিশ্বজয়, যে ভাবে বিশ্বমঞ্চে কিস্তিমাত করল বাঙালির প্রিয় খাবার
বিদেশে
অনেকেই বলেন, বিদেশ থেকে, মূলত আরব, আফগানিস্থানের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে বিরিয়ানি ভারতে এসেছে। কিন্তু ঐতিহাসিকদের একাংশের মতে, ওখান থেকে বিরিয়ানি আসেনি। বরং ভারত থেকেই প্রাচীন আরব ও মধ্য প্রাচ্যে এই পদ ছড়িয়ে পড়েছিল। তার প্রমাণস্বরূপ হাজির করেছেন আলেকজান্ডারের সময়ের কথা। সেই সময় উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিস্তান বলে কিছু ছিল না। ওই বিস্তীর্ণ জায়গাটির নাম ছিল সগডিয়ানা। এর পাশাপাশি ছিল ব্যাক্ত্রিয়া। বুখারা, সমরখন্দ, খুজান্দের মতো প্রাচীন শহরও ছিল। এই পুরো এলাকাটি সিল্ক রুটের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। চিন থেকে ভারত হয়ে মধ্য প্রাচ্য – এই ছিল বাণিজ্যের পথ।
ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সিল্ক, মশলা, সুগন্ধি, চা ইত্যাদির সঙ্গে প্রাচীন বিরিয়ানির পদটিও ভারত থেকে মধ্য প্রাচ্যে পাড়ি দিয়েছিল। কারণ, খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩২৯-তে সেনাবাহিনী নিয়ে আলেকজান্ডার ওই সগডিয়ানা এলাকাতেই ছিলেন। উল্লেখ আছে, সেখানেই তিনি বিশেষ একটি পদের সন্ধান পান। সমরখন্দের রাস্তায় পান সেই বিশেষ পদ, যার নাম ‘পিলাফ’। ভাত আর মাংস একসঙ্গে নিয়ে রান্না করা একটি সুস্বাদু খাবার। আলেকজান্ডারের এতটাই পছন্দ হয় যে, তিনি নিজের সঙ্গে সেই রেসিপি নিয়ে আসেন ইউরোপে। এই প্রথম পিলাফ পদটি ইউরোপের মাটি ছুঁল।
আরও পড়ুন : একা ‘দাদা-বৌদি’-ই বদলে দিয়েছে সোদপুরের ছবি! নামজাদা রেস্তোরাঁর ঠিকানা এখন মফসসল
পারস্যে আবার এই পদের নাম ছিল ‘পেলাভ’। একবার নামগুলো খেয়াল করুন। পুরুক্কাল থেকে পুলাকা, পিলাফ, পেলাভ, পলান্ন, পোলাও… একটা দীর্ঘ ইতিহাসের রূপরেখা কি দেখা যাচ্ছে। ভাত আর মাংসের এই পদই কি আবহমান কাল ধরে চলে আসছে ভারতে? তারই মুঘলীয় সংস্করণ ছিল বিরিয়ানি? ইঙ্গিত তো সেদিকেই যাচ্ছে। তবে একটাই আফসোস, আলেকজান্ডারের সেই রেসিপি এই মুহূর্তে ইতিহাসের গভীর কুয়োর মধ্যে নিমজ্জিত। এখনও সন্ধান জারি রয়েছে। যদি সামনে আসে, তাহলে বিরিয়ানির ইতিহাস পিছিয়ে যাবে আরও হাজার বছর।