অভাবের সংসারে রবি ঠাকুরের জন্য চাদর আর পার্থ-গৌরী ঘোষের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ

রবি ঠাকুরের চাদর অন্যরকম, তুলে রাখা। তার বাবার হিসেবের খাতায় সে চাদরের দাম লেখা থাকে না।

তাদের বাড়িতে চাদর ছিল খানচারেক, ভালো চাদর ছিল একটাই। সেই চাদরখানা থাকত ছোট আলমারির ওপরের তাকে– থাকত, কিন্তু বিছানায় পাতা হত না। তাদের বাড়িতে বিশেষ কোনও অতিথি এলে সেই সুন্দর উজ্জ্বল হলুদ-সাদা ডোরা চাদরখানি পেতে দেওয়া হবে, এমন কথা বলত মা। সেই বিশেষ অতিথি কে? তাদের বাড়িতে কোনও আত্মীয়স্বজন যে আসতেন না, তা নয়, রাত্রিযাপন যে করতেন না, তা নয়। কিন্তু তাঁরা কেউ মায়ের কাছে বিশেষ অতিথি হয়ে উঠতে পারেননি। তাই সে চাদর কেনার পর থেকেই স্পর্শহারা, অনাহত। জিজ্ঞেস করেছিল সে, কারা এলে পাতা হবে সে চাদর? মা জবাব দিতে পারেনি, কিংবা দিতে চায়নি, অথবা ভেবে উঠতে পারেনি কোনও বিশেষ অতিথির নাম। তবে মনে হত তার, যদি কোনও দিন বড়মাসিরা আসে তাদের বাড়ি, তাহলে পাতা হবে। বড়মাসিরা থাকে কলকাতায়। নিউ মার্কেটের ওপরে বড়মেসোর থাকার জায়গা। সেখানে তারা ছুটি কাটাতে যায়– শীতের, গরমের। শীতের ছুটি কাটিয়ে যখন ফেরে, তখন তার সঙ্গে থাকে কতরকম কিছু– নিউ মার্কেটের সুপারিন্টেনডেন্ট বড়মেসো। বড়দিনে সেজে ওঠে চারপাশ– সেই সাজের বহর দেখেইনি তার পুরুলিয়া।

 

পুরুলিয়া অবশ্য তাকে একদিন রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছিল। শিখিয়েছিল রূপম। তাদের বাড়ির উল্টোদিকে থাকে সে। সকালে আসে তার কাছে। দু'জনে মিলে ট্রাঙ্কে বসে পা-দোলায় আর পাকানো রুটি খায়। সেই রূপমের বাড়ি একদিন গিয়েছিল সে। সেদিন ২৫ বৈশাখ। রূপম সহজ পাঠের রবীন্দ্রনাথের সামনে নমস্কারের ভঙ্গি করে বলে, আজ যে-কোনও একটা লেখা বলে মিষ্টি খেতে হয়। সে খানিকটা বলে ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ’, তারপর রূপমের সঙ্গে গদাই সেনের গরম রসগোল্লা খায়। পুরুলিয়া শহর জানে গদাইয়ের রসগোল্লা কলকাতাও বানাতে পারে না।

 

তবে মিষ্টির থেকে নোনতা খেতেই তার ভালো লাগে বেশি। তাই ২৫ বৈশাখের রসগোল্লা তাকে আরেক ২৫ বৈশাখের লুচি-আলুর দমের দিকে নিয়ে যায়। তখন তাদের বাড়িতে কেনা হয়েছে একটা টেপ-রেকর্ডার। মা পুরুলিয়াকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। তাই টেপ-রেকর্ডার কেনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। ঘিয়ে সাদা সেই টেপ-রেকর্ডারের জন্য ছোট একটা তোয়ালে এনেছিল মা। প্রতি মাসের মাইনে রুমালে বেঁধে বাড়ি নিয়ে আসত বাবা। বাবার মাইনে তখন একটা রুমালের বাঁধনেই যেত ধরে। টেপ-রেকর্ডার ঢাকা দেওয়ার তোয়ালে বাবার রুমালের থেকে বড়, যদিও তা কেনা হয়েছিল রুমাল-বাঁধা টাকার নিত্য খরচের পর যা বেঁচে থাকে, তারই একটা অংশে। চারটে ক্যাসেট ছিল তাদের বাড়ি। একটা হেমন্তের রবীন্দ্রসংগীতের, একটা সব্যসাচীর আবৃত্তির, একটা অনুপ জলোটার ভজনের আর একটা পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষের আবৃত্তির। সেখানেই সে প্রথম শুনেছিল কর্ণ-কুন্তী সংবাদ। তারপর মাঝে মাঝে সে আর তার মা কর্ণ-কুন্তী সংবাদ বলত সঞ্চয়িতা দেখে। মা কুন্তী আর সে কর্ণ। মা যখন কুন্তী হত, তখন বকত না, মারত না। নইলে সন্ধেবেলা লণ্ঠনের কাঁপা আলোয় ইংরেজি অনুবাদের সঙ্গে তার কিছু কানম'লা ছিল নিত্যকর্মপদ্ধতি।

 

আরও পড়ুন: সাহিত্যে বারবার মেয়েদের জিতিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ

 

পুরুলিয়ার রাসমেলা থেকে সেবার কিনেছিল সে রবীন্দ্রনাথের একটা মূর্তি। মা খুশি হয়ে দিয়েছিল কিনে। মায়ের ইচ্ছে ছিল খুব শান্তিনিকেতনে পড়ার। সে ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি। কী করে হবে? দাদু মারা গিয়েছিল, দিদিমা মায়েদের পাঁচ বোনকে নিয়ে বিধবা হয়েছিল। পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মায়ের বড়মামা। সে দায়িত্বের ওপর তো আর ভার চাপানো যায় না– তাই মায়ের শান্তিনিকেতনের ইচ্ছের কথা দিদিমা কোনওদিন তার বড়োভাইকে বলেনি। মায়ের মামাতো বোন অবশ্য শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিল– সে পড়া শেষ হয়নি। মা তাই খালি ভাবত, যদি সুযোগ পেত তাহলে শান্তিনিকেতনে ঠিক ভালো কিছু করত। সে ভালোর কথা ভাবতে ভাবতে গ্র্যাজুয়েট মায়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বাবার সঙ্গে, বাবার ছিল হিসেবের খাতা আর ক্রিকেটের ধারাবিবরণী, ফুটবলেরও। পুরুলিয়ার দিন-রাতে মার্ফি রেডিও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাবা ঢুকে যেত না-যেতে পারা খেলার মাঠে। রেডিওর ভেতর খুলে যেত ময়দান আর ইডেনের রাস্তা।

 

রাসমেলার রবীন্দ্রনাথ যে মায়ের সেই না-যেতে পারা শান্তিনিকেতন, তা সে বুঝতে পারল পরের বৈশাখে। যখন সে বলল রূপমের বাড়ি না গিয়ে নিজের বাড়িতেই রবিঠাকুরের প্রসাদ খেতে চায়, তখন মা খুশি হল খুব। তারপর যা হল, সে এক আশ্চর্য রূপকথা। সে দেখল সেই যে হলুদ-সাদা চাদর, যা স্পর্শহীন অনাহত, তা বের করে আনছে মা। তারপর যত্ন করে বিছিয়ে দিচ্ছে টেবিলের ওপর। সেই চাদরের ওপর বসছেন রবীন্দ্রনাথ। আর চাদর বড় বলে টেবিলের তলা অবধি ঢেকে তৈরি হচ্ছে একটা চমৎকার তাঁবুর মতো ঘর। সে মনের আনন্দে ঢুকে পড়ল সেই চাদরঢাকা টেবিলের তলার ঘরে। হাতে তার সঞ্চয়িতা। আর সে পড়ে পড়ে নিজের ইচ্ছেমতো রবীন্দ্রনাথের মূর্তিকে শোনাতে লাগল রবি ঠাকুরের কবিতা।

 

আর মা? মা চলল রান্নাঘরে। রবি ঠাকুর এসেছেন। খেতে দিতে হবে না! লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। লুচিগুলো নিটোল ফুলকো-ফুলকো। মা উনুন-তাতে রবি ঠাকুরের জন্য লুচি ভাজতে বসল। মায়ের মুখে সেই বৈশাখে মুক্তোর মতো ফুটে উঠল বিন্দু বিন্দু ঘাম।

 

তারা যখন কলকাতা যেত, তখন মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে থাকত একখানা চাদরের মোট, যা কিছু ধরত না সুটকেসে, তা বেঁধে নেওয়া হত চাদরের মোটে। সেই মোট বাবা তুলত ট্রেনে। ট্রেনের ফাঁক-ফাঁক কাঠের বেঞ্চি। তার তলায় বসে মোটের কলকাতা যাত্রা। পুরুলিয়া থেকে কলকাতার পথে প্রথম প্রথম স্টেশনগুলোতে বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম নেই। তবে ঘণ্টা বাজানোর লোক আছে। ঘণ্টা বাজলে তবে হেলতে-দুলতে ট্রেন চলে, আর দোলে চাদরের মোট।

 

দেখতে দেখতে তার মনে হত, যাকে তারা প্রতিদিনের কাজে লাগায়, বেঁধে-ছেঁদে মাল বওয়ার কাজে ব্যবহার করে, তা দরকারি, কিন্তু সে চাদর রবি ঠাকুরের নয়। রবি ঠাকুরের চাদর অন্যরকম, তুলে রাখা। তার বাবার হিসেবের খাতায় সে চাদরের দাম লেখা থাকে না। মা রবি ঠাকুরের চাদর কিনেছিল মায়েরই জমানো হাত খরচের টাকায়– সে টাকাও বাবার রুমালের, কিন্তু তা দিয়ে ঠিক কী কেনা হবে, তা নির্দিষ্ট ছিল না।

 

তবে মা বুঝেছিল, তাদের একটা চাদর লাগবে‌।

 

অভাবের সংসারে লাগবে কর্ণ-কুন্তী সংবাদ, আর লাগবে রবি ঠাকুরের চাদর।

More Articles