আপনার-আমার টাকায় 'মোদি কি গ্যারান্টি' বিজ্ঞাপন! ভোটের প্রচারে কত কোটি খরচ জানেন?
BJP Google Ads Budget: গুগলে বিজেপির বিজ্ঞাপন বাবদ প্রায় ৩৮৭ মিলিয়ন টাকা খরচ করেছে সরকারি সংস্থা, তাও মাত্র চার মাসে।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি নেমেছে ঠিক ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে। প্রতিবারই, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, আব কি বার মোদি সরকার জাতীয় প্রচারের ট্যাগলাইন তারা ব্যবহার করেই থাকে। এবারের নির্বাচনে তাদের ক্যাচলাইন 'মোদি কি গ্যারান্টি'। মেট্রোতে, স্টেশনে, টেলিভিশনে এমনকী মোবাইলের গানের অ্যাপেও গান থামিয়ে বেজে উঠছে এই গ্যারান্টিবাণী। বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের অবস্থা এতই নড়বড়ে যে সেখানে দলগুলি আঞ্চলিক ক্ষেত্রে জোট অবধি বাঁধতে চায়নি পাছে আসন ভাগ হয়ে যায়! সেখানে প্রধানমন্ত্রী মুখের দাবিদার অজস্র। এমতাবস্থায় “মোদি কি গ্যারান্টি” প্রচার করে শাসক দল ভারতীয় ভোটারদের বোঝাতে চেয়েছে, এই দেশে এই মুহূর্তে যদি কারও উপর আস্থা রাখা যায়, তিনি একমাত্র মোদিই। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে বিজেপি এই ট্যাগলাইন দিয়ে গুগলে বিজ্ঞাপন চালু করে।
কিন্তু এই একই সময়ে, অন্য একটি সংস্থা প্রায় একই রকমের প্রচারে লক্ষ লক্ষ টাকা ঢালে। তাদের ক্যাচলাইন ছিল 'মোদি সরকার কি গ্যারান্টি। ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রচারিত এরকমই একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, একজন অভিনেতাকে যিনি স্টার্ট আপ শুরু করতে চলেছেন। আর তাঁর বাবা ছেলের এই কেরিয়ার নির্বাচন নিয়ে খুবই শঙ্কিত। ছেলে বাবাকে এই বলে আশ্বস্ত করছে যে, মোদির গ্যারান্টি আছে। মোদিজি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি ভারতের স্টার্টআপগুলিকে বিশ্বে জায়গা করে দেবেন। কোথাও মোদিজি মেয়েদের উন্নতির গ্যারান্টি দিচ্ছেন, কোথাও কৃষকদের বাঁচাচ্ছেন। এমন বিবিধ বিজ্ঞাপন চলেছে, চলছে।
মজার ঘটনা হচ্ছে, এই বিজ্ঞাপনগুলি কেবল বিজেপির টাকায় চলেনি। ভারতীয় করদাতাদের টাকাতেও চলেছে মোদির বিজ্ঞাপন। ভারত সরকারের বিজ্ঞাপন সংস্থা, সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ কমিউনিকেশন পরিচালিত প্রচারণার অংশ ছিল এই বিজ্ঞাপনগুলি। গত ২২ মার্চ বিরোধী কংগ্রেস ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে যে, সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ কমিউনিকেশন শাসক দলের প্রচারে এই বিজ্ঞাপনগুলি জনসাধারণের তহবিলের অপব্যবহার করে নির্বাচনী নিয়ম লঙ্ঘন করেছে৷
আরও পড়ুন- রামকৃষ্ণ মিশন সত্যিই বিজেপির আজ্ঞাবহ? সাধু বিতর্কে ভোট হারাবেন মমতা?
আল জাজিরা তাদের একটি প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, সরকারের এই কমিউনিকেশন এজেন্সি গুগলে বিজেপির বিজ্ঞাপন বাবদ প্রায় ৩৮৭ মিলিয়ন টাকা খরচ করেছে, তাও মাত্র চার মাসে। ভারতের জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে করা হয় ১৫ মার্চ। সেই থেকে, সরকারি সংস্থাগুলিকে কোনও বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এই ১১৩ দিনে, Google-এ রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে সিবিসি ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ করে। বিজেপি খরচ করেছে ৩১৪ মিলিয়ন টাকা। এই সময়ের মধ্যে CBC খরচ 275 মিলিয়ন রুপি ($3.3m) থেকে 41 শতাংশ বেশি যা কংগ্রেস গত ছয় বছরে, ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত যা ব্যয় করেছে গুগল বিজ্ঞাপনে, সিবিসি তার চেয়ে ৪১% বেশি টাকা মাত্র ৪ মাসে খরচা করেছে।
বিরোধী দলগুলি দীর্ঘদিন ধরেই বলছে মোদি সরকার বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে নিরপেক্ষ থাকতে দেয়নি। বিজেপির প্রয়োজনে সরকারি সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে।
গত মার্চের শুরুতেই, বিরোধী নেতা লালু প্রসাদ যাদব মোদিকে পরিবার না থাকার জন্য উপহাস করেন। বলেন, কম বয়সেই স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যান মোদি, সন্তানও নেই তাঁদের কোনও। এই বক্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি নেতারা তাদের নামের পাশে 'মোদি কা পরিবার' লিখে সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল পাল্টে নেন। 'মোদি কি গ্যারান্টি'-র মতোই সিবিসি ইউটিউব এবং গুগল বিজ্ঞাপনে 'মোদি কা পরিবার'-ও প্রচার করেছে৷ এই বিজ্ঞাপনগুলি সংস্থার আজ পর্যন্ত প্রচারিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনগুলির মধ্যে অন্যতম।
৯ মার্চ প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনে মোদিকে ভারতীয় সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সঙ্গে দীপাবলি উদযাপন করতে দেখা যায়। শহিদ সৈনিকের পরিবারের সদস্যরা, যারা তাদের ছেলে, স্বামী এবং বাবাকে হারিয়েছেন, তারা বলছেন মোদি সৈন্যদের সঙ্গে দীপাবলি উদযাপন করেন কারণ তিনি তাদের পরিবারের অংশ। তারা বলেন, “আমরা সবাই মোদির পরিবার”। টানা পাঁচ দিন প্রায় ৬ থেকে ৭ মিলিয়ন মানুষের কাছে এই বিজ্ঞাপন পৌঁছনোর জন্য সরকারি সংস্থা প্রায় ৫৫০ হাজার টাকা খরচ করেছিল। নির্বাচন কমিশনের কাছে দায়ের করা অভিযোগে, কংগ্রেস মোদি সরকারের বিরুদ্ধে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর রাজনীতিকরণের অভিযোগও করেছে।
এপ্রিলে, সাত দফার নির্বাচন শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে বিজেপি তাদের ইস্তেহার প্রকাশ করে। সেখানে 'মোদি কি গ্যারান্টি' স্লোগানই ব্যবহৃত হয়। প্রাক্তন নির্বাচনী কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতায় থাকা দলগুলি যুগে যুগেই নিজেদের প্রচারের জন্য মানুষের টাকায় চলা সরকারি সংস্থাকেই ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। ১৯৭৫ সালের জুনে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে তাঁর প্রচারের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনা ব্যবহারের জন্য একটি আদালত দোষী সাব্যস্ত করে।
আরও পড়ুন- মোদির হাতেই ভারতের রাশ নাকি ক্ষমতায় এবার অন্য কেউ! কী বলছে প্রশান্ত কিশোরের অঙ্কের খাতা?
২০১৫ সালে, সুপ্রিম কোর্ট একটি নির্দেশিকা জারি করে যে, সরকারি বিজ্ঞাপনগুলি রাজনৈতিক স্বার্থে প্রচার করা উচিত নয়। কিন্তু প্রায় ১০ বছর পেরোতে চলল, নির্দেশিকাকে কাঁচকলা দেখানো অব্যাহতই আছে। ২০২৩ সালের মে মাসে, ভারতের ২০২৪ সালের নির্বাচন শুরু হওয়ার প্রায় এক বছর আগে, মোদি সরকারের একটি কার্যনির্বাহী আদেশ সিবিসি-র বাজেট ২৭৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২ বিলিয়ন টাকা থেকে প্রায় ৭.৫ বিলিয়ন টাকা করা হয়।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে, ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক গুগল বিজ্ঞাপনগুলিতে মোট খরচ ছিল ১১.৭৭ মিলিয়ন টাকা। যার মধ্যে ৯৯ শতাংশেরও বেশি বিজেপি খরচ করেছিল। এবারের নির্বাচনের আগে, ওই একই সময়ে, অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে, মোট রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ১.৩ বিলিয়ন টাকা। ২০১৯ সালের খরচের ১০০ গুণেরও বেশি!
২০২৩ গুগল নিউজ ইনিশিয়েটিভ এবং কান্তার সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৩ শতাংশ ভারতীয় YouTube-এর মাধ্যমে খবর দেখেন। প্রায় ৮০ শতাংশ ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যারা ভোট দেওয়ার যোগ্য, তারা YouTube দেখে প্রচুর বেশি। গুগলে সিবিসি-র বিজ্ঞাপনের ৯০ শতাংশের বেশি খরচ হয়েছে ভিডিওতে। এই বিপুল খরচের লাভের গুড় সবটাই বিজেপি নিজস্ব হাঁড়িতেই ভরেছে। যত টাকা ঢালা যাবে, তত বেশি প্রচার, যত প্রচার তত ভোট। মোবাইল বা ইন্টারনেট অবাধ দেশে, তাই ভুয়ো ভিডিও, মিথ্যা প্রোপাগান্ডার জয় ভারতবর্ষে। মোদির গ্যারান্টি যে যসলে কোটি কোটি টাকার খেল, সে বিচার ভারতবর্ষ করে না।