তিক্ততা ভুলে নতুন শুরু, জেলায় জেলায় ঘুরে ঘর গোছাচ্ছেন দিলীপ ঘোষ

Dilip Ghosh: শোনা যাচ্ছে, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিজেপির কর্মীদের সঙ্গে বসে এই লোকসভা ভোটের ফলাফল পর্যালোচনা করেন বিজেপি নেতা। সোমবার সকালে উঠেই বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। প্রথমেই মালদহ শহরের শুভঙ্কর বাঁধে প্রাতঃভ্রমণ সার...

সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে লোকসভার অধিবেশন। দেশে নয়া সরকার গঠনের পর প্রথম লোকসভার বৈঠক। গোটা দেশ থেকে নির্বাচিত সাংসদেরা ছুটেছেন দিল্লিতে। তবে এবার আর দিল্লি যাওয়ার তাড়া নেই বিজেপির বরিষ্ঠ নেতা দিলীপ ঘোষের। গত লোকসভা ভোটে তাঁকে বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্র থেকে দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। যে মেদিনীপুর থেকে দীর্ঘদিন ধরে জিতে আসছেন দিলীপ, সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বিজেপির এই প্রাক্তন রাজ্য সভাপতিকে। স্বাভাবিক ভাবেই এই লোকসভা ভোটে একই সঙ্গে দুটি আসনই হাতছাড়া হয় বিজেপির অঙ্কের ভুলে। এর পরেই প্রশ্ন উঠে যায় বিজেপির সিদ্ধান্ত ঘিরে। নাম না করেই এর নেপথ্যে দলের বিশেষ কারওর হাত রয়েছে বলেও তোপ দেগেছিলেন দিলীপ ঘোষ। এমনকী দলের নির্দেশে প্রয়োজনে নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারেন বলেও জানিয়েছিলেন দিলীপ।

সঙ্ঘের কড়া অনুশাসনে দীক্ষিত দিলীপ যে জমি ছাড়ার পাত্র নন, তা অবশ্য এর আগেও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। দলের মেম্বারশিপ ক্যাম্পেন শুরু হচ্ছে জুলাই মাস থেকে। তা চলবে আরও ৬ মাস। তার আগেই ময়দানে নামলেন দিলীপ। ঘরের মাঠে ব্যাট করতে না পারায় কার্যত এ বছর মুখ থুবড়ে পড়েছে দিলীপ ঘোষের ভোটপূর্ব সমস্ত হিসেবনিকেশ। সারা বছর ধরে মেদিনীপুরের প্রতিটি কেন্দ্র চষে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষমুহূর্তে তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছিল বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে। যেখানে দিলীপ ঘোষের তেমন প্রভাব নেই বললেই চলে। ভোট মিটতেই নিজের হার স্বীকার করে জনসংযোগ বাড়ানোর কাজ শুরু করে দিলেন দিলীপ ঘোষ। রাজ্য বিজেপির নেতাদের কাছে স্পষ্ট খবর নেই, কোথায় দিলীপ। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখতেই দেখা গেল, কার্যত জেলাসফরে বেরিয়ে পড়েছেন বিজেপির এই বরিষ্ঠ নেতা।

আরও পড়ুন: ‘কাঠিবাজী’ই কি কাঁটা জয়ের মুখে! কীসের আভাস দিতে চাইলেন বেসুরো দিলীপ

শনিবার তাঁকে দেখা গিয়েছিল ভাটপাড়ায়। দলীয় কর্মীদের সঙ্গে বহাল তবিয়তে ক্যারাম খেলেছেন দিলীপ। সোমবার দেখা গেল, তিনি মালদহে। শোনা যাচ্ছে, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিজেপির কর্মীদের সঙ্গে বসে এই লোকসভা ভোটের ফলাফল পর্যালোচনা করেন বিজেপি নেতা। সোমবার সকালে উঠেই বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। প্রথমেই মালদহ শহরের শুভঙ্কর বাঁধে প্রাতঃভ্রমণ সারেন দিলীপবাবু। তার পর সেখানেই একটা চায়ের দোকান বেছে নিয়ে বসে পড়েন পুরনো কায়দায়। পুরনো স্টাইলেই মন দেন চায়ে পে চর্চায়। সাংবাদিকরা ঘিরে ধরলেও সেসব কোনও কথাতেই কোনও উত্তর দিতে চাননি দিলীপবাবু। তার পর তিনি চলেছ যান মালদা ইংরেজবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রীন পার্ক মনসা তলা বস্তিতে। সদ্য আইআইটি পরীক্ষায় সফল ছাত্র অভিজিৎ রায়ের বাড়ি পৌঁছে যান বিজেপি নেতা। দেখা করেন মেধাবী যুবকের সঙ্গে। আর্থিক অনটন সামলে বহু কষ্টে বড় হতে হয়েছে অভিজিৎকে। দাদু বিক্রি করতেন কয়লা, বাবা চালাতেন টোটো। সেই সমস্ত বাধা-প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই সাফল্যের মুখ দেখেছেন অভিজিৎ। এদিকে, দিলীপের পুরনো এলাকা খড়্গপুর। কোনও ভাবে অভিজিৎ যদি খড়্গপুর আইআইটি-তে ভর্তি হন, সেক্ষেত্রে ওই ছাত্রের যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তাকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাসও দেন দিলীপ ঘোষ। বাড়িতে বরিষ্ঠ বিজেপি নেতাকে পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি অভিজিতের পরিবার।

তবে এই প্রথম নয়। দিন কয়েক ধরেই বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে এই জনসংযোগের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন দিলীপ। ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছেন মেদিনীপুর, ব্যারাকপুর, মুর্শিদাবাদ সফর। তার পর মালদহ দক্ষিণ এবং মালদহ উত্তর হয়ে সোমবার পৌঁছন রাজ্যসভাপতি সুকান্ত মজুমদারের লোকসভা কেন্দ্র বালুরঘাটে। এদিন সন্ধেয় দিলীপবাবু যাবেন জলপাইগুড়ি এলাকায়। কেন এক জেলা থেকে অন্য জেলায় এমন ঘুরে বেড়াচ্ছেন দিলীপ? দিলীপবাবু অবশ্য বলছেন, নতুন কিছু নয়। অতীতের মতোই বিভিন্ন জেলায় ঘুরছেন তিনি।

অথচ দিলীপের এই একগুচ্ছ সফরকর্মসূচী নিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাজ্যনেতৃত্ব। রাজ্য়বিজেপির কাছে এ সংক্রান্ত কোনও খবরাখবর নেই। এমনকী কবে কোথায় যাচ্ছেন, তা নিয়ে রাজ্যনেতৃত্বকে কোনও কিছুই আগাম জানানো হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই দিলীপের এই জেলাসফর ঘিরে উস্কে উঠেছে জল্পনা। অনেকেই মনে করছে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের থেকে কোনও বিশেষ নির্দেশ পেয়েছেন দিলীপ। এমনকী তাঁর তৎপরতা দেখে অনেকেই মনে করছেন, এ রাজ্যে হারের পর স্তিমিত হয়ে পড়া বিজেপিকে তুলে আনতে বড় কোনও গুরুদায়িত্বও দেওয়া হতে পারে দিলীপ ঘোষকে। তবে কি দিল্লি থেকে তেমনই কোনও বার্তা পেয়েছেন দিলীপ? নানা মহলে শুরু হয়েছে চর্চা।

রাজ্য বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘জয়ীরা এখন মন্ত্রী আর সাংসদ হিসাবে ব্যস্ত। বাকি পরাজিতেরা যখন ঘরে বসে রয়েছেন, তখন লোকসভা নির্বাচনের বিপর্যয়ে মনোবল ভেঙে যাওয়া নেতা-কর্মীদের কাছে দিলীপের যাওয়া প্রশংসনীয়।’’ কেউ কেউ আবার বলছেন, হাত থেকে ফসকে যাওয়া বিজেপি সভাপতির পদ পুনরায় দখল করতেই রাজ্যের দক্ষিণ থেকে উত্তরে ছুটে মরছেন দিলীপ। যদিও দিলীপ ঘোষ এই সমস্ত জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, "নিজের দলের কর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে আবার কারণ লাগে নাকি!" রাজ্য সভাপতি হওয়ার দৌড়ে থাকার জল্পনায় জল ঢেলে তিনি জানান, ‘‘যাঁরা আমার এই সফরে অন্য লক্ষ্য দেখছেন তাঁদের মনে রাখা দরকার, আমি যাঁদের কাছে যাচ্ছি, তাঁরা আমায় রাজ্য সভাপতি বানাতে পারবেন না। সেটা চাইলে দিল্লি গিয়ে বসে থাকতাম। দিলীপ ঘোষ সেই বান্দা নয়।’’

তবে কেন রাজ্যনেতৃত্বকে জানিয়ে এই জেলা সফর সারছেন না বিজেপি নেতা? তার উত্তরে দিলীপ জানান, , ‘‘এতে আবার অনুমতি নেওয়ার কী আছে? ২০১৯ আর ২০২১ সালে নির্বাচনের পরেও গোটা রাজ্যে ঘুরে কর্মীদের খোঁজখবর নিয়েছিলাম। সেটাই করছি। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছি। যাঁদের মনোবল ভেঙে গিয়েছে, তাঁদের নতুন করে লড়াইয়ের কথা বলছি।’’ যেভাবে পরাজয়ের পরেও হাল না ছেড়ে ফের মাঠে নেমেছেন দিলীপ, জনসংযোগ বাড়িয়েছেন, তা এক দিক থেকে শিক্ষনীয় বলেই মনে করছেন দলের অনেকেই।

আরও পড়ুন: বহিরাগতর কাছে শোচনীয় পরাজয়! অধীর আর দিলীপকে হারাল তাঁদের দলই?

ভোটে হারার পর স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভের সুর শোনা গিয়েছিল দিলীপ ঘোষের গলায়। নাম না করলেও তাঁর আকার ইঙ্গিতে ভালোই বোঝা গিয়েছিল, বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বাড়বাড়ন্তকে ভালো চোখে দেখছেন না বরিষ্ঠ বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ। তবু তিনি বাক্যনির্বাচনের ক্ষেত্রে সংযত ভাব দেখানোর চেষ্টা করেছেন যতটা সম্ভব। এর মধ্যেই একদিন সেক্টর ফাইভে বিজেপির সদরদফতরে যান দিলীপবাবু। গত ১৫ জুন যোগ দেন বিজেপির কোর কমিটির বৈঠকেও। আর তার ঠিক পরের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় দিলীপের জেলা সফর। প্রথম দিনেই পৌঁছন নিজের আসন বর্ধমান দুর্গাপুরে। জেলা দফতর ছাড়াও গলসি এবং দুর্গাপুর শহরে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ভোটের পরে ‘আক্রান্ত’ নেতা-কর্মীদের খোঁজ নেন। পরদিন পৌঁছে যান নিজের এলাকা মেদিনীপুরে। সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গা ইতিমধ্যেই ঘুরে ফেলেছেন তিনি। তারপর পৌঁছে গিয়েছেন উত্তরবঙ্গে। তবে কি আগামীতে বঙ্গবিজেপিতে ছাই থেকেই ফের জেগে উঠতে চলেছেন দিলীপ? তারই ইঙ্গিত কি দিচ্ছে এই জেলাসফর। উস্কে উঠেছে জল্পনা।

More Articles