মিনিটে ৩ জন করে নাবালিকা বিবাহ এই ভারতেই, সামনে এল যে ভয়ঙ্কর রিপোর্ট
Child marriage in India: রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারত জুড়ে বাল্যবিবাহের মোট ৩,৫৬৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এই দায়ের করা মামলাগুলির মধ্যে শুধুমাত্র ১৮১টি মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হয়েছে।
ভারতে বাল্যবিবাহের প্রবণতা নতুন নয়। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য দুশ্চিন্তা— নানা কারণে ভারতীয় সমাজে এখনও বাল্যবিবাহের মতো প্রথা টিকে রয়েছে। তবে 'ল্যানসেট'-এর একটি প্রতিবেদনে সম্প্রতি জানানো হয়েছে , অনেকেই বলেছেন শিক্ষা বা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উপর বাল্যবিবাহ নির্ভর করে না। তাঁদের মতে, এটি একটি জটিল মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। যখন যে সরকার এসেছে, তারাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে। তা সত্ত্বেও সমীক্ষায় বার বার উঠে এসেছে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ভারতের ত্রুটির কথা। সম্প্রতি ইন্ডিয়া চাইল্ড প্রোটেকশন স্টাডি গ্রুপের 'টুওয়ার্ডস জাস্টিস: এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ' প্রতিবেদনেও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ব্যর্থতার তত্ত্বটি ফের প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ভারতে প্রতি মিনিটে ৩ জন নাবালিকাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। প্রশ্ন উঠছে, ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েও কেন এই ব্যর্থতা?
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারত জুড়ে রেকর্ড হওয়া বাল্যবিবাহের মামলার সংখ্যা ছিল দিনে ৩টি করে। দেখা গিয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বরের বয়স ২১-এর ঊর্দ্ধে। ইন্ডিয়া চাইল্ড প্রোটেকশন স্টাডি গ্রুপের এই প্রতিবেদনটিতে ২০১১ সালের জনগণনা, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো এবং জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫ থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করে লেখা হয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮-২০২২ সালে ৩,৮৬৩টি বাল্যবিবাহ রেকর্ড করা হয়েছিল। কিন্তু জনগণনার হিসেব মতো দেশে প্রতি বছর ১৬ লক্ষ বাল্যবিবাহের তথ্য মিলেছে। জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫ অনুযায়ী, ২০-২৪ বছর বয়সী ২৩.৩% মহিলা ১৮ পেরোনোর আগেই বিয়ে করেন।
আরও পড়ুন: নাবালিকাদের নিয়তি যৌনপল্লি! ভারতের এই বাস্তবতা লজ্জায় ফেলবেই
এই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ভারতে নাবালিকা বিবাহ মামলার নিষ্পত্তি করতে আরও ১৯ বছর সময় লাগবে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারত জুড়ে বাল্যবিবাহের মোট ৩,৫৬৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এই দায়ের করা মামলাগুলির মধ্যে শুধুমাত্র ১৮১টি মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হয়েছে। ফলে এখনও ৯২% মামলাই বিচারাধীন। বর্তমান মামলার নিষ্পত্তির হার হিসেব করে, ইন্ডিয়া চাইল্ড প্রোটেকশন স্টাডি গ্রুপের এই প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে বিচারাধীন বাকি ৯২% মামলা সফলভাবে সমাধানের জন্য আরও ১৯ বছর সময় লাগবে। রিপোর্টে ছত্তিসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, বিহার, পশ্চিমবঙ্গে বেশি মাত্রায় নাবালিকা বিবাহের প্রবণতার কথা লেখা হয়েছে।
২০২২ সালে 'দ্য ইউএনএফপিএ-ইউনিসেফ গ্লোবাল প্রোগ্রাম টু এন্ড চাইল্ড ম্যারেজ' রাষ্ট্রপুঞ্জের নেতৃত্বাধীন যৌথ কর্মসূচির স্টিয়ারিং কমিটির একটি দল ভারতে এসেছিল বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য। সেই কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, বাল্যবিবাহ ২০০৫ সালে ৪৭.৪% ছিল, যা ২০২১ সালে ২৩.৩% হয়েছিল। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বাল্যবিবাহের প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট দফতরের সমীক্ষা বলছে, ঝাড়খণ্ডে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে, বাল্যবিবাহ মুক্ত হওয়ায় নজির গড়েছে অসম। এই রাজ্যের কেস স্টাডি রিপোর্ট বলছে, ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত ৮১% বাল্যবিবাহ হ্রাস পেয়েছে। রিপোর্টে অসমের ২০টি জেলার ১.১৩২টি গ্রামের নিরিখে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই রাজ্যের ২০টি জেলার মধ্যে ১২টি জেলার ৯০% স্থানীয় বাসিন্দা জানাচ্ছেন, এফআইআর এবং বাকি আইনি পদক্ষেপে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন: শুধু নাবালিকা নয়, প্রতিদিন যৌন নিপীড়নের শিকার কত নাবালক, চমকে দেবে এই তথ্য
বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন, ২০০৬ এবং শিশুদের যৌন নিগ্রহ প্রতিরোধ আইন 'পকসো', ২০১২ কঠোরভাবে প্রয়োগ না হওয়ার কারণেইই দেশ জুড়ে আজও বাল্যবিবাহের এত বাড়বাড়ন্ত। রাষ্ট্রপুঞ্জের সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায়, ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূল করার কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, কঠোর আইনি পদক্ষেপ ছাড়া বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। বাল্যবিবাহে নাবালিকা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে। যেই মেয়েদের ১৮ বছরের আগেই জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং তাঁরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছে, তার দায় সমাজের তো বটেই। একই সঙ্গে সরকার ও আইনেরও ব্যর্থতার দিকটাও ফুটে উঠছে তার মাধ্যমে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি ধর্মীয় নেতাদেরও সচেতন করতে হবে। বাল্যবিবাহ যে অপরাধ, তা নিয়ে কঠোর বার্তা দেওয়া প্রয়োজন। এই কাজে যারা মদত দেবে, তাদেরও কঠোর শাস্তি পেতে হবে। নাবালিকা বিবাহ-বিরোধী নীতি জোরালো করার পাশাপাশি এবং প্রশাসনের শূন্য স্থানগুলি অতি দ্রুত পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।