আমেরিকার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ, লেবাননে স্থল আক্রমণের প্রস্তুতি নেতানিয়াহু-সেনার

Israel-Hezbollah war: লেবাননে উত্তেজনা বাড়তেই সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্য সতর্কতা জারি করেছে বেইরুটের ভারতীয় দূতাবাস। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেবানন ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ভারতের তরফে।

গাজার সময়েও সংঘর্ষবিরতির প্রশ্নে অনড় ছিল ইজরায়েল। বিশ্বের সবক'টি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দেশের একাধিক দাবির মুখেও নিজেদের অবস্থান থেকে সরতে দেখা যায়নি বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দেশকে। লেবাননের ক্ষেত্রেও একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে রইল নেতানিয়াহু সরকার। হিজবুল্লাহের সঙ্গে সম্প্রতি ফের নতুন করে লড়াইয়ে জড়িয়েছে ইজরায়েল। লেবাননে একের পর এক হামলা অব্যাহত তাদের। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে জানিয়েছেন, গত সোমবার থেকে ইজরায়েলের লাগাতার হামলা অন্তত ৬২০ জনের মৃত্যু হয়েছে লেবাননে। ইজরায়েল লাগাতার সন্ত্রাস ছড়িয়ে চলেছে বলে রাষ্ট্রসঙ্ঘে অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি।

গত বুধবার ফ্রান্সের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। যেখানে আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনের তরফে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির ডাক দেওয়া হয় ইজরায়েল ও হিজবুল্লাহের মধ্যে। নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সদর দফতরের জরুরি বৈঠকে মিকাতি জানিয়েছে, ইজরায়েল তাদের আকাশে যুদ্ধবিমান ও ড্রোন পাঠিয়ে লেবাননের সার্বভৌমত্ব খর্ব করার চেষ্টা করছে। দিন কয়েক আগেই লেবানন, সিরিয়া ও বেইরুটে পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণে অন্তত ৩৭ জনের মৃত্যু হয়। জখম হয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। সেই ঘটনার দায় ইজরায়েলের উপরেই ঠেলেছিল হিজবুল্লাহরা। বাদবাকি দেশগুলির কাছে হিজবুল্লা জঙ্গিগোষ্ঠী হলেও লেবাননে কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় ইরানপুষ্ট হিজবুল্লাহ। সেই হামলার পর থেকেই ইজরায়েলের সঙ্গে নতুন করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। চলে একে অপরের প্রতি লাগাতার আক্রমণ। গত এক বছর ধরেই ইজরায়েলে বিভিন্ন ভাবে হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহরা। গত বছর অক্টোবরে হামাসের আক্রমণের পর ইজরায়েল গাজায় যুদ্ধঘোষণা করতেই নেতানিয়াহুর দেশকে নিশানা করা শুরু করেছিল ইরানের মদতপুষ্ট এই জঙ্গিগোষ্ঠী। 

আরও পড়ুন: ইরানপুষ্ট হাউথিদের সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে কথাবার্তা! তলে তলে কী ফন্দি আঁটছে রাশিয়া?

একদিন আগেই তেল আভিভে মোসাদের সদর দফতরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছিল হিজবুল্লাহরা। সেই হামলার প্রাবাল্য় এতটাই ছিল, ইজরায়েল অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ফাঁকা জায়গাতেও আঘাত করে সেই ক্ষেপণাস্ত্র। অন্তত দুজন ফিলিস্তিনির জখম হওয়ার খবর মেলে সেই হামলায়। এই প্রথম ইজরায়েলের এত গভীরে প্রবেশ করল হিজবুল্লাহের ছোড়া রকেট। যার পাল্টা হামলা ফিরিয়ে দিতে ইতিমধ্যেই লেবাননের স্থল আক্রমণের পরিকল্পনা আঁটছে নেতানিয়াহু সরকার। সূত্রের খবর, ইজরায়েলের সেনাপ্রধান জেনারেল হারজি হালেভি বুধবারই তার সেনাদের স্থল আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছে। ইরানপুষ্ট লেবাননের জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলা করার জন্য শত্রুদেশে প্রবেশের পথ তৈরি করছে ইজরায়েল। সেনার উদ্দেশে ভাষণে হালেভি জানান, হিজবুল্লাহকে সব রকম ভাবে কোণঠাসা করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না তারা।

বুধবারই রাষ্ট্রসঙ্ঘের বৈঠকে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো দেশগুলি। যদিও যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আদৌ কোনও ভ্রূক্ষেপ করছে না ইজরায়েল। কার্যত নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির প্রশ্নই নেই। বৃহস্পতিবারও লেবাননে হামলা অব্যাহত রেখেছে নেতানিয়াহুর দেশ। বুধবারই ৬২০ ছাড়িয়েছিল লেবাননে মৃতের সংখ্য়া। বৃহস্পতিবার ইজরায়েলের ছোড়া বোমায় অন্তত আরো ৭২ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। ইজরায়েলের ব্যাপক আক্রমণের মুখে প্রায় ৫ হাজার লেবাননবাসী ইতিমধ্যেই বাস্তুচ্যুত। তবে লেবাননে যুদ্ধের ফলে যে গাজায় খানিকটা শান্তি ফিরেছে, তেমনটাও কিন্তু নয়। প্রায় এক বছর ধরে সেখানে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। বৃহস্পতিবারও ইজরায়েলের হামলায় অন্তত ১৫ জন ফিলিস্তিনির প্রাণ গিয়েছে সেখানে। নিহতের সংখ্য়া ছাড়িয়ে গিয়েছে ৪১ হাজার।

ঠিক যেভাবে হামাসকে শেষ করার লক্ষ্যে অটল ছিল ইজরায়েল, একই ভাবে হিজবুল্লাহকে নিয়েও একই রকম একরোখা নেতানিয়াহু সরকার। বুধবার রাষ্ট্রসঙ্ঘে ওঠা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, হিজবুল্লাহকে চূর্ণ করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। নেতানিয়াহুর দাবি, আমেরিকা ও তার মিত্র দেশেদের প্রস্তাবিত এই যুদ্ধবিরতি হিজবুল্লাহকে পুনর্সংগঠিত করার সুযোগ ও সময় পাবে। যা কোনও ভাবেই চায় না ইজরায়েল। যতদূর জানা গিয়েছে, বেকা উপত্যকা এবং দক্ষিণ লেবাননের অন্তত পঁচাত্তরটি হিজবুল্লাহের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে ইতিমধ্যেই, বিশেষত নিশানা করা হচ্ছে হিজবুল্লাহদের অস্ত্র ভাণ্ডারগুলিকে। রেডি-টু ফায়ার লঞ্চার ব্যবহার করা হয়েছে এই সব হামলায়। গাজার ক্ষেত্রে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আগ্রাসী রূপে দেখা গিয়েছিল, সেই বাইডেনকেই ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর এই সংঘাত নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। তিনি বারবার বলছেন, এই লড়াইয়ের একটি "সর্বস্ব যুদ্ধে" পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং কাতার-সহ বহু দেশই এই সংঘর্ষবিরতির দাবিতে একমত হয়েছে। যে কোনও যুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সেই সব এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষের। গাজার ক্ষেত্রেও হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে উলুখাগড়ার মতো মরতে দেখেছে বিশ্ব। লেবাননও ব্যতিক্রম নয়। লেবাননের বাসিন্দা সৌমায়া মুসাভি। বাড়ির বাইরে বসেছিলেন আত্মীয়দের সঙ্গে। হঠাখ করেই যুদ্ধবিমানগুলি থেকে একের পর এক বোমা পড়তে শুরু করে। এই হামলায় বাবা ও দুই ভাইকে হারিয়েছেন তিনি। নিজে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায়। আর এমনই পরিস্থিতি এখন লেবাননের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে।

আরও পড়ুন: মোসাদের দফতরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হিজবুল্লাহের, যে ভয়ঙ্কর পরিণতির আশঙ্কায় কাঁপছে বিশ্ব

এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ বেড়েছে নয়াদিল্লিরও। লেবাননে উত্তেজনা বাড়তেই সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্য সতর্কতা জারি করেছে বেইরুটের ভারতীয় দূতাবাস। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেবানন ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ভারতের তরফে। একই সঙ্হে লেবাননে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও কড়া বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। একদিন আগেই একই রকম সতর্কতা জারি করেছিল রাশিয়াও।

ইতিমধ্যেই লেবাননে ক্রসিং হিসেবে কাজ করা সিরিয়ামুখী একটি ছোট সেতুতে আঘাত করেছে ইজরায়েলি বোমা। লেবাননের পরিস্থিতিত নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতারেস। বুধবার নিরাপত্তা পরিষদে অস্ত্রের উপর দেশের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি নিয়ে মুখ খোলেন। লেবাননকে আরেকটি গাজায় পরিণত করার চেষ্টা চলছে বলেও ক্ষোভ জানান তিনি। বাকি সমস্ত দেশের অনুরোধ পাশে সরিয়ে যেভাবে নিজের দেশের সেনাকে পুরোদমে লেবানন হামলার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, তাতে সঙ্কট আরও বেড়েছে। শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে এই সংঘাত, তা নিয়ে ভয়ানক এক উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বিশ্ব জুড়েই।

More Articles