অলক্ষ্যে মোদিকেই মদত? নিষিদ্ধ জামাত কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কাশ্মীরের নির্বাচনে?
Jamaat in Kashmir Election 2024: জামাত-সমর্থিত প্রার্থীরা কাশ্মীরের ৪৭ টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ১০টিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
গত ২৭ অগাস্ট ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফার মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন। এই দিন তিনজন ব্যক্তি নির্দল প্রার্থী হিসাবে দক্ষিণ কাশ্মীরের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা থেকে নিজেদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। দিতেই পারেন। সমস্ত নির্বাচনেই এমনটা হয়। কিন্তু জম্মু কাশ্মীরের এই নির্বাচনে এই ৩ জন ব্যক্তির মনোনয়ন দাখিল কোনও সামান্য বিষয় নয়। এই তিনজনই নিষিদ্ধ সামাজিক-ধর্মীয় গোষ্ঠী জামাত-ই-ইসলামী জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন এবং বর্তমান সদস্য। আরও বড় বিষয়টি হচ্ছে, মোদি কি তবে জামাতকে ব্যবহার করছেন কাশ্মীরের ভোট পকেটে পুরতে? কেন এমন প্রশ্ন উঠছে?
শেষবার, ১৯৮৭ সালে জামাত একটি আঞ্চলিক দল হিসাবে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এই নির্বাচনের পরপরই ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরে জঙ্গিবাদ হঠাৎ মাথাচাড়া দেয়। পরবর্তীকালে জামাতের অনেক সদস্যই হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তবে ১৯৯৮ সালে সংগঠনটি জঙ্গিগোষ্ঠীর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। এর দুই দশক পরে, কেন্দ্র সরকার ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর জামাতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ঘোষিত নিষিদ্ধ দল হিসেবে জামাত তো প্রার্থী দিতে পারবে না কিন্তু এবার জামাত-সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচনে লড়ছেন। ৩৭ বছর পর কেন একটি নিষিদ্ধ দল কাশ্মীরের নির্বাচনী রাজনীতিতে ফিরছে তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে।
আরও পড়ুন- ৩৭০ ধারা বিলোপের পর প্রথম বিধানসভা ভোটে কী চাইছেন কাশ্মীরের আমজনতা?
সূত্রের খবর, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে জামাতের আলোচনা চলছে, আর সে আলোচনারই অংশ নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও কিছুই নিশ্চিত করা হয়নি। ২০২২ সাল থেকে জামাতের আট সদস্যের প্যানেল কেন্দ্রের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করছে। তাহলে কি এই নির্বাচনে বিজেপি জামাতকে ব্যবহার করে ভোট পেতে চাইছে?
জামাত-সমর্থিত প্রার্থীরা কাশ্মীরের ৪৭ টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ১০টিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জামাত বারামুল্লার সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার রশিদের নিতুন দল আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টির সঙ্গে প্রাক-নির্বাচনী জোটও করে। ফলে ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোট কাটার সম্ভাবনা থাকছেই। আর তাতে লাভ বিজেপির।
জামাত-ই-ইসলামী জম্মু ও কাশ্মীর হচ্ছে জামাত-ই-ইসলামীর একটি শাখা। ১৯৪১ সালে ধর্মতত্ত্ববিদ আবুল আলা মওদুদি লাহোরে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ইসলাম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। দেশভাগের পর জামাত বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই যখন কাশ্মীরের দাবি তোলে তখন ১৯৫৩ সালে স্বাধীন জামাত-ই-ইসলামী জম্মু ও কাশ্মীরের জন্ম হয়।
জামাত ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কাশ্মীরের নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৯০-এর দশকে জঙ্গিবাদের উত্থানের পরপর এর কিছু সদস্য সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দেয়। জামাত পাকিস্তানপন্থী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করে, যদিও তারা কখনই কোনও আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্বীকার করেনি। ১৯৯০-এর শেষ দিকে আবারও হিংসা শুরু হয়। তখন, জামাতের তৎকালীন প্রধান গোলাম মহম্মদ ভাট ঘোষণা করেছিলেন, এই দলটি কাশ্মীর বিষয়ক বিরোধ থেকে নিজেকে দূরে রাখবে। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যের কারণে অবশেষে দুই সদস্য, সৈয়দ আলি শাহ গিলানি এবং মহম্মদ আশরাফ সেহরাইকে বরখাস্ত করা হয়। তারা আবার ২০০৪ সালে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল তেহরিক-ই-হুরিয়াত গঠন করেন।
জামাত ধীরে ধীরে নির্বাচনী রাজনীতি সহ মূলধারার রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে দূরে সরে যায়। পরিবর্তে সংগঠনটি স্কুল এবং দাতব্য সংস্থা চালাতে শুরু করে, দুর্যোগ মোকাবিলায় ত্রাণ বিতরণের মতো সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দেয়। যখন জামাতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তখন সংগঠনটির আনুমানিক ৫,০০০ সদস্য ছিল।
আরও পড়ুন- মোদির লক্ষ্যপূরণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছেন কাশ্মীরের নির্দল নেতারাই
জামাতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য কেন্দ্র দু'টি শর্ত দিয়েছে বলে জানা গেছে। কেন্দ্র চায় বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং আজাদির দাবিকে সমর্থন করা বন্ধ করতে হবে জামাতকে। কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ হওয়ার দাবি করাও বন্ধ করতে হবে জামাতকে। দ্বিতীয় দাবি, জঙ্গিবাদ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে নিজেদের।
জামাতের সংবিধান অনুযায়ী বলা হয়েছে, সংগঠনটি 'সংস্কার ও ধার্মিক বিপ্লবের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে'। তাই সংসদীয় নির্বাচনী রাজনীতিতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামাত। তবে জামায়াতের সবাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। কেন্দ্রের সঙ্গে জামাতের যে আট সদস্যের প্যানেল কথা বলছে, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। এই প্যানেলটি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, কারা এতে কোন ভূমিকায় আছেন এই নিয়ে সকলের কাছে তথ্য নেই। জামাতের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও কথা বলছেন অনেক সদস্য। নির্বাচনী রাজনীতিতে ফিরে না গিয়ে জামাতের কেন্দ্র সরকারের দমন-পীড়ন প্রতিরোধ করা উচিত ছিল বলেও মনে করছেন অনেক সদস্য।
কুলগামের জামাত-সমর্থিত প্রার্থী সাইর আহমদ রেশি অবশ্য বলছেন, এই প্যানেল ১০০% বৈধ। ২০২২ সালে প্রথম তারা এমন একটি প্যানেল গঠনের কথা ভাবেন। প্যানেলটি সংগঠনের তিন প্রাক্তন প্রধানের সঙ্গে পরামর্শ করে গঠন করা হয়েছিল এবং গোপন ব্যালটের মাধ্যমে এর নেতা নির্বাচন করা হয়েছিল। তাহলে, জামাতের সমর্থনে ভোটে লড়া প্রার্থীরা কি বিজেপির হয়ে ভোট কাটাকাটির অঙ্ক কষে নিজেদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরাতে পারবে? বিজেপি কি সন্ত্রাস দমনের নামে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীদের ব্যবহার করে কাশ্মীর শাসন করতে চলেছে এবার? উত্তর দেবেন কাশ্মীরের ভোটাররাই।