সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছেন শুভেন্দু! কর্মসমিতির বৈঠকে ফের স্পষ্ট বিজেপির অন্তর্ঘাত?

Suvendu Adhikari, BJP: শীর্ষনেতৃত্বের উপস্থিতিতেই যেভাবে দলের সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার কথা ঘোষণা করেছেন শুভেন্দু, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে জোরদার চর্চা।

লোকসভা ভোটের ফলাফল তেমন আশাজনক হয়নি এবার বিজেপির। কেন্দ্রেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অনেকটাই পিছনে গেরুয়া শিবির। কোনও মতে শরিক দলের সমর্থন নিয়ে তৃতীয় বার সরকার গড়েছেন মোদি। আর এই ফলাফলের পিছনে রাজ্যভিত্তিক ফল একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। ভোটের ফলাফল সামনে আসার পর থেকেই রাজ্যগুলিতে আত্মবিশ্লেষণ শুরু করেছে বিজেপি। বাংলায় উল্লেখযোগ্য ভাবে মুথ থুবড়ে পড়েছে বিজেপি। এমনকী উপনির্বাচনেও তৃণমূলের সামনে দাঁড়াতে পারেনি গেরুয়া শিবির। ফলে সব মিলিয়ে বঙ্গবিজেপির অবস্থা যে বেশ দুর্বল, তা নতুন করে বলে দিতে হয় না। কিছুদিন আগেই রাজনীতি ছাড়ার কথা শোনা গিয়েছে বঙ্গবিজেপির বরিষ্ঠ নেতা দিলীপ ঘোষের মুখে। যা থেকে দলের অন্তর্সংঘাতের ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে লোকসভা ভোটের পর বাংলায় কর্মসমিতির প্রথম বৈঠক হল বুধবার

আগামী দিনে রাজ্য় বিজেপির নীতি কী হতে চলেছে, সে নিয়েই আলোচনা হয় এই বৈঠকে। বুধবার সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিক হয় এই বৈঠক। এদিনের বৈঠকে শুধু রাজ্যবিজেপির শীর্ষনেতৃত্বই নন, হাজির ছিলেন বিজেরিক কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি ও শীর্ষনেতারাও। রাজ্যবিজেপির সেই কর্মসমিতির বৈঠকে রাজ্যনেতা শুভেন্দু অধিকারী সাফ জানিয়ে দিলেন, বিজেপির সংগঠনের কোনও প্রকার দায়িত্বে নেই তিনি। তিনি শুধু রাজ্যের বিরোধীনেতাই। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর এই বক্তব্য ঘিরে তোলপাড় রাজ্যরাজনীতিতে। অনেকেই মনে করছেন, যেভাবে লোকসভা ভোটে দলের হারের দায় নাম না করেই শুভেন্দুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, সেই জায়গা থেকেই এ হেন বক্তব্য শুভেন্দুর। এ ভাবেই বিপুল পরাজয়ের দায় তিনি এড়াতে চাইছেন বলেও মনে করছে কেউ কেউ।

আরও পড়ুন: ‘বিজেপিতে খারাপ হলেই দায় আমার?’ হঠাৎ কেন অভিমানী বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু?

শীর্ষনেতৃত্বের উপস্থিতিতেই যেভাবে দলের সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার কথা ঘোষণা করেছেন শুভেন্দু, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে জোরদার চর্চা। অনেকে এ-ও মনে করছেন, আসলে পরোক্ষ ভাবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের দিকেই আঙুল তুলতে চেয়েছেন শুভেন্দু। কারণ রাজ্যসভাপতি হিসেবে বঙ্গবিজেপির গোটা দায়িত্বটাই বর্তায় তাঁরই কাঁধে। একই সঙ্গে শুভেন্দু বৈঠকে জানিয়েছেন, বাংলায় গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, আগে গণতন্ত্র ফেরাতে হবে। আমরা রাষ্ট্রপতি শাসন চাই না। পিছনের দরজা দিয়ে নবান্নে ঢুকতে চাই না। আমরা বাংলায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে ভোটে ওদের (তৃণমূলকে) পরাজিত করে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করব। লড়াই করব।’’

এখানেই থামেননি শুভেন্দু। লোকসভা ভোটে জয় আনতে তিনি যে চেষ্টার ত্রুটি করেননি, স্পষ্ট করে দিয়েছেন সে কথাও। শুভেন্দু জানান, "অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে দু'কোটির উপরে ভোট পেয়েছে। অত্যাচার করে শুইয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে আস্তে আস্তে লড়াই করে ঘুরে দাড়িয়েছি। বেশ কিছু আসন যে হারব তা আমরা-আপনারা কেউ বিশ্বাস করিনি। আমি সংগঠনের দায়িত্বে নেই, তাই এমন কোনও বক্তব্য সংবাদমাধ্যমের কাছে বলি না, যাতে কর্মীরা কষ্ট পান। আমি সব ছেড়ে দিয়ে এসেছি। অমিত শাহজি বাড়িতে সময় দিয়েছে। ২৬ সালেও আমাকেও ভোট দিতে দেবে না। ভাঙড়ে দু'টো হিন্দু এলাকার মানুষকে ভোট দিতে দেননি শওকত মোল্লা। আমি চাই, বাংলায় গণতন্ত্র ফিরুক। প্রয়োজনে উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করে এখানে ভোট করাতে হবে। গতকাল তো রাজ্যপালের কাছে ১০০ জন ভোটার নিয়ে গেছি। কাল রাষ্ট্রপতিকে মেল করেছি,সময় দিন।" শুভেন্দুর সাফ কথা, "যে আমাদের সঙ্গে, আমরা তাঁদের সঙ্গে।"

বাংলাতে লোকসভা ভোটে উল্লেখযোগ্য ভাবে আসন কমেছে বিজেপির। ১৮ থেকে কমে ১২-এ এসে ঠেকেছে বাংলায় বিজেপির প্রাপ্ত আসন। ভোটের সেই ফলপ্রকাশের পরে বেশ কিছু দিন প্রকাশ্যেই আসেননি শুভেন্দু। পরে নানা বিষয়ে শাসকদলকে আক্রমণ করলেও তাঁকে আর আগের ভূমিকায় দেখা যায়নি বলে মনে করছেন বিজেপির একটি অংশ। যখনই মুখ খুলেছেন, তখনই প্রকাশ্যে এসে পড়েছে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ক্ষোভ। বুধবার বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠকেও সে কথা শোনা গেল শুভেন্দুর মুখে। একই সঙ্গে চার বিধানসভার উপনির্বাচন নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। ভোটের সময় কোথায় কোথায় গিয়ে তিনি প্রচার করেছেন, তা-ও উল্লেখ করেন শুভেন্দু। সবিস্তারে না-বললেও তাঁর কথা থেকে স্পষ্ট যে, দল বা সংগঠনের তরফে তাঁকে যেমন প্রচারসূচি দেওয়া হয়েছিল, তিনি তা মেনেই প্রচার করেছিলেন। বিরোধী দলনেতা হিসেবে তিনি তাঁর ‘কর্তব্য’ পালন করেছেন। কারণ, শুভেন্দু অতীতেও বলেছেন, ‘‘সংগঠনের নির্দেশই সব। সংগঠন আমাকে যা বলবে আমি তা-ই করব।’’ কার্যত পরিষ্কার করে না বললেও আকারে ইঙ্গিতে সুকান্তের দিকেই বিপুল হারের দায় ঠেলতে চেয়েছেন বিরোধী দলনেতা, অন্তত তেমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।

তবে শুভেন্দু যা-ই বলুক না কেন, দল ও সংগঠনের প্রতি আস্থার কথাই উঠে এসেছে সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায়। তিনি এ দিন কর্মসমিতির বৈঠকে জানান সে বক্তব্যই। তাঁর কথায়,"বিজেপি হেরে গেলেও হারিয়ে যায়নি। আমি সকল প্রাক্তন সভাপতিকে স্মরন করছি। আমাদের সবাইকে একত্রিত করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিজেপি এক আছে। বিজেপিতে একটাই স্রোত। বিজেপি গঙ্গার মতো। লক্ষ্য নবান্নের ওপরে গৈরিক পতাকা তুলে ধরা। ২৬-এর বিধানসভা ভোটকে সামনে রেখে এগাতে হবে। ২০২১ এর থেকে ভোট বেড়েছে। ৪০ শতাংশ দেওয়া মানুষের ভোটকে সম্মান জানাতে রাস্তায় নামতে হবে।" একই সঙ্গে তৃণমূলের জনদরদী প্রকল্পগুলিকেও এ দিন বৈঠক থেকে কটাক্ষ করেন সুকান্ত। তাঁর কথায়, "মা হয়তো ১০০০ টাকা পাচ্ছে, কিন্তু ছেলেকে পরিযায়ী শ্রমিক হতে হচ্ছে। ১০০০ টাকা দিচ্ছে বিদ্যুতের বিলের মারফত তা চলে যাচ্ছে।"

আরও পড়ুন: ‘কাঠিবাজী’ই কি কাঁটা জয়ের মুখে! কীসের আভাস দিতে চাইলেন বেসুরো দিলীপ

একই সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে লোকসভা ভোটের ফলাফলকে কেন্দ্র করে বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে রাজ্যনেতৃত্বের, সেই ব্যবধান কমানোরও চেষ্টা করলেন সুকান্ত এদিন। সে কারণেই সম্ভবত প্রাক্তন সভাপতিকে স্মরণের কথা শোনা গেল তাঁর বক্তব্য। প্রসঙ্গত, ভোটে হারের পর নাম না করেই শুভেন্দুকেই নিশানা করতে চেয়েছিলেন দিলীপ ঘোষ, এমনটা অনেকেই মনে করেন দলের অন্দরে ও বাইরেও। এই সময়েই কৌশলে সংগঠন থেকে নিজেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইলেন শুভেন্দু। তা-ও এমন একটি মঞ্চ থেকে, যেখানে রাজ্যের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এবং কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রতিনিধিরা রয়েছেন। রয়েছেন রাজ্য সভাপতি সুকান্তও। বিজেপি সূত্রের খবর, বুধবারের কর্মসমিতির বৈঠকের আগে তার পরিকল্পনা নিয়ে মঙ্গলবার বিজেপির সল্টলেকের দফতরে যে বৈঠক ডাকা হয়েছিল, সেখানেও হাজিরা এড়ান শুভেন্দু। তবে এ কথাও অস্বীকার করার জায়গা নেই, কোনওদিনই দলের সাংগঠনিক বৈঠকে সে ভাবে উপস্থিত থাকেননি শুভেন্দু। তিনি বিরোধী দলনেতা,‘সাংগঠনিক’ নেতা নন। সেই কারণ দর্শিয়েই সেই জায়গাটা এড়িয়ে গিয়েছেন বারবার। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এ ক্ষেত্রে বিজেপির যা নিয়ম, তা-ই বলেছেন শুভেন্দু। কারণ, বিজেপিতে সংগঠন এবং পরিষদীয় দল আলাদা। তবে এ কথাও অস্বীকার করার জায়গা নেই যে বিরোধী দলনেতাও আদতে সংগঠনের বাইরেও নন।

প্রশ্ন উঠছে, এদিনের বৈঠকে শুভেন্দুর দূরত্ব বাড়ানো কি আদতে বিজেপি নেতৃত্বকে সাহায্য করবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে। তাঁর বক্তব্যে কি এবার বিপদে পড়তে চলেছেন দলের সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। দিলীপ ঘোষের জন্যই বা কী পরিকল্পনা করছে দলের শীর্ষনেতৃত্ব? নজর থাকবে বিজেপির পরবর্তী সিদ্ধান্তের দিকেই।

More Articles