কেন মুসলিমদের সম্পত্তি নিয়ে ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪’ চাইছে মোদি সরকার?
Waqf (Amendment) Bill, 2024: কোনও মুসলিম মানুষ যদি তাঁর ব্যক্তিগত স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণে দান করেন, তাহলে সেটি ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি বলে বিবেচিত হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রের এনডিএ সরকার, দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওয়াকফ সংক্রান্ত একটি সংশোধনী বিল এনেছে। সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী কিরণ রিজিজু সংসদে এই বিলটি পেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। বিরোধীরা সমস্বরে এই
বিলের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছেন, এই ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪’ শুধু সংখ্যালঘু বিরোধীই নয়, এটি সংবিধান বিরোধী। এই বিলের মধ্যে দিয়ে সমাজে আবার বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি। প্রচণ্ড সমালোচনার ফলে সরকার বাধ্য হয়েছে
বিলটিকে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে আলোচনার জন্য পাঠাতে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ অ্যাক্টের বদল আনার জন্য এবং ওয়াকফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার সুবিধার্থেই সরকার এই বিল আনতে চাইছে। প্রায় ৪০টি সংশোধনী এনে কেন্দ্র আসলে ওয়াকফ বোর্ডের উপর সরকারি কর্তৃত্ব বাড়াতে চাইছে বলেই অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা।
এই ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪’ আসলে কী? ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি নিয়ে বহু মানুষের ধারণা নেই কারণ সংখ্যালঘুর যাপন সংখ্যাগরিষ্ঠদের আজও অনেকাংশে অজানা। শাসকদল বিজেপি এবং তাঁদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মদতদাতা আরএসএস এই বিষয়টিরই সুযোগ নেয়। অজ্ঞতার সুযোগে এই ধরনের বিল এনে সমাজে বিভাজনের রাজনীতির নয়া চাল চালে তারা। বিভ্রান্তি ছড়িয়েই হিন্দু ভোট ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস করে। যেহেতু সামনে দুই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন আছে, সেখানেও ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪’-এর প্রভাব ফেলতে চাইছে বিজেপি। ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি তাহলে কী? কোনও মুসলিম মানুষ যদি তাঁর ব্যক্তিগত স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণে দান করেন, তাহলে সেটি ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি বলে বিবেচিত হতে পারে। সেই স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি কোনও ধর্মীয়, দান খয়রাতমূলক বা ব্যক্তিগত কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে। কারা এই সম্পত্তি ভোগ করবেন তা স্পষ্টভাবে বলা না হলেও একটা বিষয় এখানে উল্লিখিত আছে, এই সম্পত্তির সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকাটা জরুরি। অনেক সময়ে এই ধরনের সম্পত্তিকে ‘ওয়াকফ’ ঘোষণা করার জন্য, কোনও লিখিত দলিল থাকতে পারে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে মুখে মুখেও কোনও সম্পত্তিকে ‘ওয়াকফ’ ঘোষণা করা যেতে পারে। দীর্ঘদিন কোনও সম্পত্তি যদি ধর্মীয় বা ওই ধরনের কোনও কাজে ব্যবহৃত হয় তাহলেও সেটিকে ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি বলা যেতে পারে। একবার যদি কোনও সম্পত্তি ‘ওয়াকফ’ ঘোষিত হয়, তাহলে তার চরিত্র আর বদল করা যাবে না।
আরও পড়ুন- স্বাধীনতার পর এই প্রথম! দেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হল না একজন মুসলিম সাংসদেরও
কীভাবে ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি এতদিন রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো? এতকাল অবধি ১৯৯৫ সালের ‘ওয়াকফ অ্যাক্ট’ দ্বারাই এই ধরনের সম্পত্তির
পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ হতো। তবে বিষয়টির একটি ইতিহাসও আছে। ১৯১৩ সাল থেকেই এই ধরনের সম্পত্তি পরিচালনার জন্য একটি আইন আছে। ১৯২৩ সালে ‘মুসলমান ওয়াকফ অ্যাক্ট’ লাগু হয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৫৪ সালে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ‘কেন্দ্রীয় ওয়াকফ অ্যাক্ট’ জারি করেন যা পরবর্তীতে সংশোধিত হয়। মুসলমান সমাজে যাঁরা কোনও সম্পত্তি কোনও ধর্মীয় কাজের জন্য, কবরস্থানের জন্য, হাসপাতাল বা মাদ্রাসা তৈরির জন্য দান করেন, তাঁদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। তাঁদের বলা হয় ‘ওয়াকিফ’। ২০১৩ সালেও দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার এই ‘ওয়াকফ’ বোর্ডকে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলেছিল।
বর্তমানে যে আইন রয়েছে, তাতে ওয়াকফের দখল করা জমি বা সম্পত্তিতে কোনওভাবেই পর্যালোচনা করার সুযোগ নেই। কারও আপত্তি সত্ত্বেও জমি বা সম্পত্তি দখল করতে পারে ওয়াকফ বোর্ড। তাতে হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে না সরকারের। সেই ব্যবস্থাই পাল্টাতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদিরা। সামনাসামনি বলা হচ্ছে ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি ডিজিটাইজেশন হবে কিন্তু আসলে ওই সম্পত্তিগুলোর মালিকানা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি। সেইজন্যই বিল আনার প্রশ্নে ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তাতে মূলত ওয়াকফ বোর্ডের হাতে যে কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসাবে ঘোষণা করার যে একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে তাতে রাশ টানার কথাই বলা হয়েছে। যে ৪০টি সংশোধনী আনা হচ্ছে, তাতে আগামী দিনে কোনও সম্পত্তি নিজেদের বলে ওয়াকফ বোর্ড দাবি করলে, তার বাধ্যতামূলক পর্যালোচনা করে দেখবে সরকার। সম্পত্তি ঘিরে মালিক ও ওয়াকফ বোর্ডের মধ্যে বাদানুবাদ চললে সেই সম্পত্তির মালিকানা আদতে কার, তা খতিয়ে দেখার আইনি ক্ষমতাও সরকারের নিজেদের হাতে রাখতে চাইছে।
বিরোধীরা নিজেদের মতো করে বিরোধিতা করছে। যে জোরের সঙ্গে মুসলিম সংগঠনগুলো এই ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪’ এবং তার ফলাফল নিয়ে সরব হয়েছে, ততটা সরব সমস্ত রাজনৈতিক দল হতে পারেনি। সংশোধনীতে অ-মুসলিম ব্যক্তিদের রাখা নিয়ে কথা উঠলেও এই ধরনের বিলকে রুখতে যে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রয়োজন, তা কতটা বিরোধী দলগুলো করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিজেপি বিরোধী বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের কিঞ্চিৎ হিন্দু ভোটও আছে। সেই ভোট ব্যাঙ্কে যদি ফাটল ধরার ভয়েই সর্বান্তকরণে এই বিলের বিরোধিতা করতে পারছে না বিরোধীরা। অল ইন্ডিয়া মিমের পক্ষ থেকে সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ করেছেন। এই ‘ওয়াকফ সংশোধনী ২০২৪’ বিলের ১১ নম্বর চ্যাপ্টারে বলা হয়েছে, সরকার এর আগে অন্তত ৬টি রাজ্যের ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি ইতিমধ্যেই নিজেদের দখলে নিয়েছে। শুধুমাত্র দিল্লিতেই অন্তত ২০০টি এইরকম সম্পত্তি ইতিমধ্যেই দখলে নেওয়া হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন- ইউএপিএ অস্ত্রে রাষ্ট্রের হাতে খুন হয়েছেন জি এন সাইবাবা
দিল্লিতে বিজেপি বিরোধী আম আদমি পার্টির সরকার থাকা সত্ত্বেও এর বিরোধিতা করা হয়নি। নরেন্দ্র মোদির সরকার ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তির ব্যবহারকারীর অধিকার সরিয়ে দিয়ে সেই সম্পত্তি নিয়ে যাতে পুনর্বিবেচনা করা যায় সেই সংক্রান্ত আইনই আনতে চাইছে। এই ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তিগুলো তো সরকারি জমি নয়। এই জমি বা সম্পত্তি তো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কোনও মুসলিম মানুষ স্বেচ্ছায় সম্পত্তি দান করছেন। এই সম্পত্তির ওপর তো সরকারের অধিকার থাকার কথা নয়! তাহলে ডিজিটাইজেশনের নামে এই সম্পত্তিগুলি কেন দখল করতে চাইছে সরকার? অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের অন্যতম সদস্য সাইফুল্লা বলেছেন, যদি এটাই করতে হয়, তাহলে মন্দির সংক্রান্ত বিষয়েও কথা বলতে হয়। বেশ কিছু রাজ্যে বহু জমি তো মন্দির কমিটিই দেখে, তাহলে ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি নিয়ে এত আপত্তি কেন? কাশী বিশ্বনাথ মন্দির অ্যাক্ট ১৯৮৩-তে বলা আছে, শুধু হিন্দুরাই ওই মন্দির কমিটির সদস্য হতে পারবেন। তাহলে ‘ওয়াকফ অ্যাক্ট’ এবং সেই সংক্রান্ত নিয়মে অসুবিধা কোথায়? কেন ‘ওয়াকফ’ কমিটিতে অমুসলিম ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে?
আগামীতে এই বিষয়ে যে আরও জলঘোলা হবে তা বলাই বাহুল্য। তবে সরকার ইচ্ছে করলেই, সাচার কমিটির প্রস্তাব কাজে লাগাতে পারে। ওই প্রস্তাবনাতে ‘ওয়াকফ অ্যাক্ট’-কে একটু সম্প্রসারিত করে কমিটিতে মহিলাদের অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং আরও বেশ কিছু বিশিষ্ট মানুষদের কমিটির সদস্য করার কথা বলা হয়েছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা না করে সাচার কমিটির প্রস্তাবনা বিবেচনার কথা বলতে পারে। না হলে বিষয়টি তৃণমূলের বনাম বিজেপি সাংসদের ঝগড়া এবং খেউড়েই পরিণত হবে, মুসলিমদের কোনও উন্নতি হবে না। বৃহত্তর সমাজও হিন্দু মুসলমানের বিভেদের রাজনীতি নিয়েই মেতে থাকবে।