লজ্জা! কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর পরেও নাবালিকা বিয়ে কেন বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গে?
West Bengal Early Marriage: যে পাঁচটি জেলায় সবচেয়ে বেশি নাবালিকা বিয়ে হয়, সেই পাঁচটির মধ্যে তিনটি জেলা পশ্চিমবঙ্গের ও দু’টি বিহারের।
এই রাজ্য দাবি করে, তা মহিলাদের জন্য অন্যতম নিরাপদ। এই রাজ্য বলে, এখানে স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের নানাভাবে অনুদানমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নতিসাধন হচ্ছে। মেয়েদের সাইকেল দেওয়া, মেয়েদের এককালীন অনুদান দেওয়া এসব আসলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহিলাদরদি প্রকল্প। এ কথাও অনস্বীকার্য যে মহিলাদের ভোট মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতায় থাকার বিরাট ইন্ধন। আবার এই কথাও ঠিক ও প্রমাণিত যে, এই বাংলা মেয়েদের নিরাপত্তা ও অধিকার-উন্নয়নের প্রশ্নে অন্ধকারের দিকেই পিছিয়ে চলেছে ক্রমশ। এই বাংলাতে ক্রমেই বাড়ছে নাবালিকা বিবাহ! ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে, আজও ১৮ বছরের ঢের নীচে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কিশোরীদের।
সম্প্রতি দেশের সব জেলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, নাবালিকা বিবাহের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের হাল অতি করুণ! যে পাঁচটি জেলায় সবচেয়ে বেশি নাবালিকা বিয়ে হয়, সেই পাঁচটির মধ্যে তিনটি জেলা পশ্চিমবঙ্গের ও দু’টি বিহারের। এই বাংলায় মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর নাবালিকার বিয়ের ক্ষেত্রে লজ্জাজনকভাবে এগিয়ে। এই তিন জেলায় ৬২ থেকে ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স হওয়ারর আগেই। ২০১৯-২০২১-এর জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্যও বলেছিল, এই রাজ্যে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৪১% মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এই হার জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ।
আরও পড়ুন- শুধু নাবালিকা নয়, প্রতিদিন যৌন নিপীড়নের শিকার কত নাবালক, চমকে দেবে এই তথ্য
২০১৫-২০১৬ থেকে ২০১৯-২০২০, এই পাঁচ বছরের সময়পর্বে দেখা গেছে, রাজ্যের ১০টি জেলায় বাল্যবিবাহ বেড়েছে। আরও মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে নাবালিকাদের গর্ভধারণের হারে বৃদ্ধি। বাংলার ৭টি জেলায় ১৫ থেকে ১৯ বছরের মেয়েদের গর্ভধারণের হার বেড়েছে। দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় যে এই সঙ্কট ক্রমেই বাড়ছে। অথচ রাজ্যের গড়, বা জাতীয় গড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় সেই জেলার নিজস্ব অবস্থাটি। গবেষক-সমীক্ষকরা ভারতের ৭০৭টি জেলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেছেন। দেখা গিয়েছে, দেশের ১৩টি জেলায় ৬০ শতাংশের বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই। এগুলির মধ্যে ৯টি জেলা বিহারের, আর পশ্চিমবঙ্গে আছে ৩টি। দেশের মোট ৮৬টি জেলায় নাবালিকা বিবাহের হার ৪৯ শতাংশের বেশি।
মনে রাখতে হবে, ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার নাবালিকা বিবাহ রুখতে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেছে। কন্যাশ্রী প্রকল্পে ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৮,০০০ কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। বছরে ১,৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে ২০১৮ সালে ‘রূপশ্রী’ প্রকল্প শুরু হয়েছিল। তাহলে এত কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথীর পরেও বাংলার কিশোরীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারীকল্যাণ মূলক এই প্রকল্প যে নাবালিকা বিবাহ এবং অকালমাতৃত্ব কমাতে পারেনি তা অত্যন্ত স্পষ্ট। অস্বস্তির বিষয় হচ্ছে, প্রবল পুরুষতান্ত্রিক রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও, নাবালিকা বিবাহ কমানোর জন্য সরকার কোনও বিশেষ উদ্যোগ না নিলেও, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে কিন্তু নাবালিকা বিবাহের হার দ্রুত কমেছে। যদিও এর কারণ সুনিশ্চিত করে বলছেন না গবেষকরা।
পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে কি দারিদ্র বাড়ছে তবে? যে কারণেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে পরিবারের পেট কমানোর তাড়া এত? আগের একটি সমীক্ষার বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছিল, পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, কলকাতার মতো অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ জেলাগুলিতেও বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে। অন্যদিকে পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুরের মতো আর্থিকভাবে পিছয়ে থাকা জেলাতে কিন্তু নাবালিকা বিয়ের হার কমেছে। তাই অর্থনৈতিক অবস্থাই এর একমাত্র কারণ নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন- ১০০-তে শূন্য! প্রকৃতি সংরক্ষণ সূচকে কেন এমন লজ্জাজনক অবস্থা ভারতের?
তবে একটি বিষয় স্বীকার করতেই হয়, বিগত বেশ কয়েক বছরে নতুন করে পিতৃতান্ত্রিকতার শেকলে বাঁধা পড়ছে সাধারণ পরিবারগুলি। পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলি মানসিকভাবে আরও পিছ্যে যাচ্ছে, আর তথাকথিত এগিয়ে থাকা পরিবারেও নতুন করে জাঁকিয়ে বসছে পিতৃতন্ত্র। মেয়েদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হচ্ছে না, স্বাধীনতায় ছেদ পড়ছে। মেয়েদের প্রেম ও বিয়ের স্বাধীনতাও সম্পূর্ণ নিজের হাতে নেই। ফলে পছন্দের মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে অনেকেই বয়স হওয়ার আগেই পালিয়ে বিয়ে করছে। না পালালে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্যের সঙ্গে।
আর এই সবের ঊর্ধ্বে রয়েছে শিক্ষা ও চাকরির অভাব। শিক্ষার ভিত্তি নড়বড়ে, সরকারি স্কুলগুলির দায়সারা শিক্ষায় একজন পড়ুয়া বিশেষ করে ছাত্রীর মানসিক দৃঢ়তা তৈরিই হচ্ছে না যাতে সে নিজের মতো জীবন বাঁচার স্বপ্ন দেখবে। চাকরি, নিজের টাকা নিজে রোজগারের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়াতে বিয়েকেই নিজের ভবিতব্য মেনে শেষ হয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ সজীবন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুটের আধিক্য, আর তাতে মেয়েদের সংখ্যা বৃদ্ধি দেখলেই বোঝা যায়, প্রকল্প বা ভাতার আড়ালে অন্ধকারই বেড়েছে কেবল। পশ্চিমবাংলা ক্রমেই হাঁটছে পিছনের দিকে।