রাম রথযাত্রাই আজকের বিজেপির ভিত্তি! হিন্দুত্বের নামে যেভাবে ভোট বাঁটোয়ারা করেন আদবানি
Lal Krishna Advani Ram Rath Yatra: তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আদবানীর রথ আটকে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেন লালু প্রসাদ যাদব।
২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে অযোধ্যার রাম মন্দিরে। আজ থেকে ৩৪ বছর আগে হিমাচল প্রদেশের পালামপুরে বিজেপি যে স্বপ্ন দেখেছিল, ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে সেই 'স্বপ্ন' পূরণ হলো নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে। বলাই বাহুল্য, রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, বিজেপির এবছরের লোকসভা নির্বাচনে জয়ের রাস্তাও প্রায় পরিষ্কার হলো। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই মন্দিরই ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম বড় হাতিয়ার। বিগত কয়েক বছরে, ভারতে বিজেপির নবউত্থানের পিছনে এই মন্দিরের একটা বড় হাত রয়েছে। তবে, মোদি কিংবা বাজপেয়ী নন, বরং এই উত্থানের আসল কারিগর ছিলেন অন্য এক ব্যক্তিত্ব। তিনি লাল কৃষ্ণ আদবানি। এই আদবানিই ছিলেন তৎকালীন বিজেপির অধ্যক্ষ যখন রাম মন্দির আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ভারতে। ১৯৯০ সালের সেই আন্দোলনের মাধ্যমে উত্থান হয়েছিল বিজেপির। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকারের পতন ঘটলেও, সেই আন্দোলনের মাধ্যমে প্রচারের আলোয় আসতে পেরেছিল আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি।
আরএসএস থেকে বিজেপি
জন্মসূত্রে বর্তমান পাকিস্তানের করাচির মানুষ হলেও, প্রথম থেকেই হিন্দুত্বের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল লাল কৃষ্ণ আদবানির। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সিন্ধু প্রদেশ থেকে তিনি চলে আসেন দিল্লিতে। ১৯৫৭ সালের প্রথমদিকে যখন জনসংঘ তৈরি হচ্ছে, সেই সময় অটল বিহারী বাজপেয়ীর হাত ধরে মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দেন আদবানি। ১৯৫৮ সালে জনসংঘের দিল্লির সম্পাদক হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তিনি। তবে, শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ হিসেবেই নয়, সাংবাদিক হিসেবেও তাঁর একটা পরিচিতি ছিল। ডানপন্থী সংবাদপত্রগুলিতে তাঁর লেখা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল ১৯৬০ পরবর্তী ভারতে। আর এই বিতর্কের কারণেই সাংবাদিক পেশায় বেশিদিন থাকতে পারেননি তিনি। ১৯৬৭ সালে সাংবাদিক জীবন থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ণ সময়ের রাজনীতি শুরু করেন আদবানি। ১৯৭০ সালে ইন্দ্র কুমার গুজরালের মেয়াদ শেষের পরে তাঁর আসনেই রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন লাল কৃষ্ণ আদবানি। আর তখন থেকেই তাঁর জীবনে শুরু হয় জাতীয় রাজনীতির অধ্যায়।
রাম রথযাত্রা ও বিজেপির উত্থান
১৯৮০ সালে জনতা পার্টি ভেঙে গিয়ে তৈরি হয়েছিল আজকের বিজেপি। সেই সময় বিজেপির ক্ষমতা একেবারেই নগণ্য ছিল সারা ভারতে। প্রথম জাতীয় সম্মেলনে অটল বিহারী ঘোষণা করেছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভারতীয় জনসংঘের আদর্শ এবং জয় প্রকাশ নারায়ণের হিন্দুত্বের শিক্ষাকে এক সূত্রে বাঁধতেই তৈরি হয়েছে বিজেপি। গান্ধিবাদী সমাজতন্ত্রকে সেই সময় দলের মূল আদর্শ হিসেবে বেছে নেওয়া হলেও, পরবর্তীতে এই আদর্শ পরিবর্তন হয়। প্রথমদিকে বাজপেয়ী একটা মধ্যপথ বেছে নিয়েছিলেন, কারণ সেই সময় পূর্ববর্তী জনতা পার্টির সমর্থকদের ধরে রাখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পরে এই সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হয় বিজেপি। যেহেতু বিজেপিও সেই সময় এই গান্ধিবাদী সমাজতন্ত্রকে পাথেয় করেই এগোতে শুরু করেছিল, তাই কংগ্রেসের সঙ্গে কোনওভাবেই এঁটে উঠতে পারেনি সেই দল। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে যায় বিজেপি। সেই সময় ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পরে, সেই সহানুভূতির তরঙ্গে পা দিয়ে ৪০০ টিরও বেশি আসনে জয়লাভ করেছিল কংগ্রেস। অন্যদিকে বিজেপি জিতেছিল মাত্র দু'টি আসনে।
সেই সময় থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, এই আদর্শে চললে বিজেপি কোনওভাবেই ভারতের ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাই পরিবর্তনের প্রয়োজন। এই ব্যর্থতার পরেই, ভারতীয় জনতা পার্টিতে নতুন যুগের সূচনা হয়। বাজপেয়ী অধ্যক্ষের পর থেকে ইস্তফা দেন এবং সেই জায়গায় আসেন লাল কৃষ্ণ আদবানি। সূচনা হয় বিজেপির আদবানি যুগের।
আরও পড়ুন- মোদির রামমন্দির উদ্বোধনে কেন ব্রাত্য লালকৃষ্ণ আদবানিরা?
রাম জন্মভূমি আন্দোলন ও বিজেপির ভূমিকা
ইন্দিরা গান্ধি ক্ষমতায় থাকাকালীন বিজেপি বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি জাতীয় রাজনীতিতে। ১৯৮৪ সালে ব্যাপক ব্যবধানে কংগ্রেসের জয়ের পর কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল বিজেপি। সেই সময় বিজেপির মধ্যেই বিতর্ক তৈরি হয়েছিল বাজপেয়ীর নেতৃত্ব নিয়ে। তবে মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই ব্যাপারটা একেবারে পাল্টে যায়। ১৯৮৯ সালে শ্রীলঙ্কা ও বোফোর্স কেলেঙ্কারিতে রাজীব গান্ধির নাম জড়িয়ে যাওয়ার পরেই, কংগ্রেসের হাত থেকে ক্ষমতা ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। বিপদ বুঝে মুসলিম ভোটকে একত্রিত করার জন্য রাজীব গান্ধি, বাবরি মসজিদের দরজা নমাজের জন্য খুলে দেওয়ার ঘোষণা করেন। আর সেটাই হয়ে ওঠে তাঁর সবথেকে বড় ভুল সিদ্ধান্ত। তিনি চেয়েছিলেন মুসলিম ভোটকে একত্রিত করতে কিন্তু পরিবর্তে রাম মন্দির আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে ফেলেন রাজীব। রাজীবের এই সিদ্ধান্তের পরেই, ভারতীয় জনতা পার্টি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে রাম জন্মভূমি আন্দোলনে। সেই সময় ভারতের হিন্দু ভোটকে একত্রিত করার এটাই ছিল সবথেকে ভালো উপায়। ৯ নভেম্বর ১৯৮৯ সালে হিমাচল প্রদেশের পালামপুরে রাম জন্মভূমির শিলান্যাস করে বিজেপি ও আরএসএস। আর এই শিলান্যাসের উপর ভর করে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে দারুণ সাফল্য পায় বিজেপি। ১৯৮৪ সালে নির্বাচনে যেখানে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র দু'টি আসন, সেখানে ১৯৮৯ সালে নির্বাচনে বিজেপির ঝুলিতে আসে ৮৬টি আসন। রাজীব গান্ধির হাত থেকে চলে যায় ভারতের ক্ষমতা এবং নবগঠিত ন্যাশনাল ফ্রন্ট গঠন করে সরকার। এই সরকারের আমলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। তবে, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের কার্যকাল খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না কোনওদিনই। ভারতের ক্ষমতায় এসেই একাধিক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। ভিপি সিংয়ের সরকারের আমলে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিগুলিকে সংরক্ষণের জন্য বাস্তবায়িত হয় মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলি। আর এটাই, বিজেপির জন্য হয়ে ওঠে চ্যালেঞ্জ।
বিজেপির মূল লক্ষ্য ছিল, ভারতের হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং এই সংরক্ষণ বিল নিয়ে এসে বিজেপির লক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। ১৯৯০ সালের ৭ অগাস্ট মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়। ঠিক তার কিছুদিন পরেই ২৬ অগাস্ট আরএসএস একটা সভা করে অযোধ্যায় মন্দির আন্দোলন নিয়ে। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের উপরে চাপ দেওয়া হয় যাতে তিনি, আরএসএস-এর এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। সেই বৈঠকেই উপস্থিত ছিলেন আদবানি। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং এই আন্দোলনকে সমর্থন করেননি। আদবানি বুঝে যান, এই আন্দোলন শুধুমাত্র তাদের আন্দোলন; ফলে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের থেকে আশা না করাই ভালো। সেই বৈঠকের পরেই আদবানি ঘোষণা করেন, আরএসএস নিজেই এই রাম জন্মভূমি আন্দোলন শুরু করবে। যেমন ভাবনা ঠিক তেমনই কাজ, এই বিতর্কিত বৈঠকের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, বিশাল রাম মন্দিরের জন্য সমর্থন জোগাড় করতে সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত বিরাট রথযাত্রার ঘোষণা করেন লাল কৃষ্ণ আদবানি।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি রাম মন্দির আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসে। ১৯৮০-র সময় থেকেই রাম জন্মভূমি আন্দোলন ধীরে ধীরে গতি পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু অটল বিহারী বাজপেয়ীর আমলে বিজেপি খোলাখুলিভাবে এই আন্দোলনে ঢুকে পড়েনি। তবে, আদবানি বুঝতে পেরেছিলেন, যদি কোনওভাবে রাম মন্দির আন্দোলনকে বড় ইস্যু করা যায়, তাহলে ভারতের হিন্দু ভোটকে একত্রিত করা যেতে পারে।
আদবানির এই আন্দোলনে তাঁর অন্যতম সহায়ক ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই সময় তিনি ছিলেন গুজরাত বিজেপির সাধারণ সম্পাদক। সেই সময় মোদি ততটা জনপ্রিয় নন। ভারতীয় রাজনীতিতেও মোদি তেমন বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠেননি। তাই বলাই যায়, রাম জন্মভূমি আন্দোলন বিজেপির জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল মোদির উত্থানের জন্যও।
ভাগলপুর দাঙ্গা
রাম জন্মভূমি আন্দোলন গতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা রামশিলা মিছিল করতে শুরু করেন। এই মিছিলের উদ্দেশ্য ছিল রাম মন্দির তৈরির জন্য ইট জোগাড় করা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই মিছিল করা হয়। ১৯৮৯ সালের অগাস্ট মাসে এই মিছিল শুরু হয় বিহারের ভাগলপুরে। সেই সময় ভাগলপুরে দু'টি উৎসব একসঙ্গে চলছিল। হিন্দুদের বিশেরি পুজো ও মুসলিমদের মহরম। গুজব রটে যায়, ২০০ জন হিন্দু কলেজ ছাত্রদের নাকি হত্যা করেছে মুসলিমরা এবং ভাগলপুরের পার্বতী এলাকায় একটি পাতকুয়োর মধ্যে তাদের দেহ ফেলে দেওয়া হয়েছে। পরে যদিও জাভেদ ইকবাল নামের এক ব্যক্তি এই ঘটনার ছবিসহ বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, সেখানে ১২টি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, ২০০টি না, এবং তার মধ্যে একজন ছিলেন জাভেদের নিকট আত্মীয়। কিন্তু এই গুজব মহরমের সময় গোটা ভাগলপুরে একেবারে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দু'টি গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায় ভাগলপুর।
এই পরিস্থিতিতে যখন এই রামশিলা মিছিল ভাগলপুরের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল তাতারপুর এলাকায় পৌঁছায়, তখন সেই মিছিলে বোমাবাজি চালায় মুসলিমরা এবং ইট বর্ষণও করা হয়। তবে, এখানে বেশ কিছু বিতর্ক রয়েছে। তাতারপুর এলাকা কিন্তু কখনই এই মিছিলের যাত্রাপথে ছিল না। তবে, পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে এ ব্যাপারে পরে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, এই মিছিলে কিছু বিতর্কিত স্লোগান দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল, “বাচ্চা বাচ্চা রাম কা, বাকি সব হারাম কা”। তৃতীয়ত, এই মিছিলের উপরে বোমাবাজি হলেও কেউই মারা যাননি এবং এই বিষয়টা নিয়েও বেশ বিতর্ক হয়।
বিতর্ক যতই থাকুক না কেন, এই মিছিলের পরেই শুরু হয় ভাগলপুর দাঙ্গা। ২৪ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ভাগলপুরের বিভিন্ন গ্রামে মুসলিমদের উপরে হত্যালীলা চালানো হয়। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও সেই সময় প্রশ্ন ওঠে। ভাগলপুরের চান্দেরি গ্রামে এক রাতের মধ্যে ৭০ জন মুসলিমকে হত্যা করা হয়। পার্বতী ও টিমোনি গ্রামে বহু মুসলিম পরিবার এই হত্যার থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাদের বাড়িঘর লুটপাট করা হয়, অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয়। আর যারা সেখানে থেকে যান তাদেরকে বাড়ির মধ্যেই হত্যা করা হয়। শিশু এবং বৃদ্ধদেরকেও সেদিন রেয়াত করেনি উন্মত্ত জনতা। সেই জেলার একটি ফুলকপির ক্ষেতে এক রাতে ১০০ জনকে কবর দেওয়া হয়। এরপর প্রায় ৩ দিন ধরে বিহারে চলে এই হত্যাকাণ্ড। ভাগলপুরের ১৯৫টি গ্রামে এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। নভেম্বরেও বিহারের ভাগলপুরের আশেপাশের কিছু গ্রামে এই দাঙ্গা মাথাচাড়া দিয়েছিল। এই দাঙ্গায় প্রায় ১০০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যার মধ্যে ৮০০ এর বেশি ছিলেন মুসলিম।
আরও পড়ুন- নিশানায় হিন্দুভোট! কেন রামমন্দিরে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম মোদির?
থামল আদবানির রথ, লালুর অসাধ্যসাধন
১৯৮৯ সালে আদবানি যখন রথযাত্রা শুরু করেছিলেন, তখন বিহার সবে সবে ১৯৮৯ সালের ভাগলপুর দাঙ্গার পর স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। কংগ্রেসের প্রতি হতাশ হয়ে এবং বিজেপির রাম মন্দির আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান উত্থানের ভয়ে বিহারের মুসলিম ভোটাররা সেই সময় লালুর দলের উপরে ভরসা রেখেছিলেন। সেই সময় লালুর হাতে ছিল বিশাল বড় মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক। সেই ভোটব্যাঙ্ক কখনই হাতছাড়া করতেন না তিনি। মুসলিম এবং যাদব ভোট ব্যাঙ্ক এখনও আরজেডির অন্যতম অস্ত্র। সেই সময় লালু প্রসাদ যাদব ছিলেন জনতা দলের প্রধান। কেন্দ্রে সেই সময় ক্ষমতায় রয়েছে জনতা দল। ন্যাশনাল ফ্রন্টের একটা অন্যতম অংশ তারা।
লালু প্রসাদ যাদবকে পছন্দ না করলেও, সেই সময় বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের হাতে আর রাস্তা ছিল না। তাই কার্যত বাধ্য হয়েই, লালুর দলের সঙ্গে তাঁকে জোট করতে হয়েছিল। অন্যদিকে, যেহেতু এই ন্যাশনাল ফ্রন্টে বিজেপির একটা বিশাল বড় ভূমিকা রয়েছে, তাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের উপরে চাপ দিয়েছিল বিজেপি। দু'দিক থেকে সমস্যায় পড়ে যান ভিপি সিং। বিজেপি রথযাত্রা করবেই। আর, বিহারে যদি লালু সেই রথযাত্রাকে সমর্থন করেন, তাহলে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক পুরোপুরিভাবে সরে যাবে লালুর হাত থেকে।
উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব আদবানিকে হুঁশিয়ারি দেন, যদি তিনি উত্তরপ্রদেশে প্রবেশ করেন, তাহলে মুলায়ম সিং সরকার বিজেপির এই রথযাত্রাকে চ্যালেঞ্জ করবে। নিজের চ্যালেঞ্জ পূর্ণ করার জন্য ১৯৯০ সালের অক্টোবরে, যাদব সরকার অযোধ্যার দিকে রওনা হওয়া করসেবকদের উদ্দেশ্যে গুলি চালায় এবং তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটে। এই একই পথের পথিক হন লালু কারণ সেই সময় বিহারের ১৭ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার ভোট তাঁর প্রয়োজন।
লালুর প্রথম নিশানা ছিল আদবানিকে বিহারে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করা। সেই মতো তিনি ধানবাদে আদবানিকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করেন কিন্তু সেই জায়গায় সেই সময়ে বিজেপি এবং আরএসএসের বিশাল প্রভাব রয়েছে। সেই কারণে লালুর পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়। অন্যদিকে, সেই সময় বিহারের অন্তর্গত ধানবাদের জেলাশাসক ছিলেন আফজাল আমানুল্লাহ, বাহুবলী মুসলিম নেতা সৈয়দ শাহাবুদ্দিনের জামাই। তিনি যদি আদবানিকে গ্রেফতার করেন, তাহলে আবারও দাঙ্গার পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সেই কারণে এই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
আদবানির রথ পৌঁছে যায় গয়া ও পটনায়। সেখানে বিজেপির ক্ষমতা অনেকটাই বেশি ছিল। সেই কারণে এই দু'টি জেলায় বিজেপির কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু এরপরেই আসল সমস্যা শুরু হয় বিজেপির এই রথ যাত্রায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আদবানির রথ আটকে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেন লালু প্রসাদ যাদব। আদবানির রথ উত্তর বিহারের দিক যাওয়ার পথে তাঁকে প্রথম বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। বিহারের দুমকা জেলায় আরজেডি সমর্থকরা এই রথ যাত্রার সামনে রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তাদেরকে বলপূর্বক সরিয়েই সমস্তিপুরের দিকে এগিয়ে যায় বিজেপির রথযাত্রা। আর সেখানে পৌঁছতেই রাত্রে কোনও নির্দেশ ছাড়াই সমস্তিপুরের জেলাশাসক গ্রেপ্তার করেন লাল কৃষ্ণ আদবানিকে। অযোধ্যা পৌঁছনোর আগেই আটকে দেওয়া হয় বিজেপির এই রামরথ।
এই রথযাত্রা বন্ধ হওয়া এবং লাল কৃষ্ণ আদবানির গ্রেফতারির পরেই ন্যাশনাল ফ্রন্ট সরকারের উপর থেকে সমর্থন সরিয়ে নেয় বিজেপি। তৎক্ষণাৎ পতন হয় বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকারের। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভারতের প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠে বিজেপি। এরপরই ঘটে সেই বিতর্কিত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে করসেবকদের একটা বিশাল দল ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে, যার পরে সারা ভারতেই দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর মধ্যে অন্যতম ১৯৯৩ সালের বম্বে বম্বিংস। ২৮ বছর বাদে প্রমাণের অভাবে লাল কৃষ্ণ আদবানি এবং ৩১ জনকে বেকসুর খালাস করে সুপ্রিমকোর্ট।
একটি সাক্ষাৎকারে লাল কৃষ্ণ আদবানি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন,
“বিজেপির জন্য, রামজন্মভূমি আন্দোলনে অংশগ্রহণ শুধুমাত্র ধর্মের জন্য করা হয়নি। আমরা তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের দ্বিচারিতা দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টা নিয়ে রাজনীতি করতে শুরু করেছিল কংগ্রেস। এই দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা রাজনীতির বিরোধিতার লক্ষেই ছিল আমাদের এই আন্দোলন।”