কারওর চাই অর্থ তো কারওর স্পিকার পদ! নীতীশ-নাইডুদের প্রত্যাশা রাখতে পারবে তো বিজেপি?

Lok Sabha Election 2024 Results: একটা সময় ছিল, যখন বিজেপির কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, সে সময় এই সব ছোট দলকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি বিজেপি। তবে ২০২৪ লোকসভা ভোটের পরে পরিস্থিতি এমন যে ছোট দলগুলির কথা মেনে না নেওয়া ছাড়া কোনও বি...

লোকসভা ভোটে জিতে গেলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি গেরুয়া শিবির। ফলে সরকার গড়া নিশ্চিত হলেও তার পথে বিছানো কাঁটা। আপাতত সরকার গড়তে বিহারের নীতীশ কুমার আর অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নাইডুকে পাশে না পেলেই নয় মোদির। তবে শুধু জেডিইউ আর টিডিপি-কে পেলেই হবে না। পাশে প্রয়োজন লোক জনশক্তি পার্টি (এলজেপি) ও শিন্ডের শিবসেনাকেও। আর তার জন্য মোটা মাশুল দিতে হবে মোদিশিবিরকে।

ভারতীয় রাজনীতির ময়দানে এমনিতেই নীতীশ কুমারের বদনাম রয়েছে পল্টু কুমার হিসেবে। কখন যে কার সঙ্গে রয়েছে নীতীশ, তা বোঝা বেশ কঠিন। বছর খানেক আগে এনডিএ-র হাত ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন নীতীশ। আর লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আগে ফের পক্ষ বদলান বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। কংগ্রেসকে ছেড়ে ফের হাত ধরলেন গেরুয়া শিবিরের। শক্ত হল এনডিএ জোট। যার জোরেই কার্যত এই লোকসভা ভোটের তরী পার করতে পেরেছে বিজেপি।

প্রায় পাঁচ বছর পরে অন্ধ্রপ্রদেশে ক্ষমতায় ফিরেছে চন্দ্রবাবু নাইডু। মোদির সরকার গড়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই নাইডু জানিয়ে দেন, এনডিএ ছেড়ে ইন্ডিয়া জোটের হাত ধরার কোনও কারণই নেই। মোদির সঙ্গেই রয়েছেন তিনি। এমনকী এনডিএ-র বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে বেছেও নেয় শরিকদলগুলি।

আরও পড়ুন: মোদি বিরোধিতাই পথ! বিরাট সিদ্ধান্ত নিল ‘ইন্ডিয়া’ জোট

এই লোকসভা ভোটে ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩২টি আসন। এনডিএ পেয়েছে ২৯২টি আসন, যার মধ্যে একাই ২৪০টি আসন পেয়েছে বিজেপি। তা সত্ত্বেও শরিকদলগুলির সমর্থন ছাড়া আপাতত নড়ার জায়গায় নেই বিজেপি। নীতীশের আরজেডি পেয়েছে ১২টি আসন, নাইডুর ঝুলিতে রয়েছে ১৬টি আসন, অন্যদিকে এলজেপি সুপ্রিমো চিরাগ পাসওয়ানের কাছে রয়েছে ৫টি আসন, শিন্ডের শিবসেনার কাছে রয়েছে ৭টি আসন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়তে এই সবকটি নম্বরই দরকার মোদি শিবিরের।

এনডিএ-তে সমর্থনের বিনিময়ে সকলেই নিজের পছন্দমতো দাবিদাওয়া জানিয়ে রেখেছেন গেরুয়া শিবিরের কাছে। কেন্দ্রে এনডিএ সরকার প্রতিষ্ঠা হলে নরেন্দ্র মোদিই যে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সে কথা এক বাক্যে বৈঠকে মেনে নিয়েছে সকলে। তবে বাকি মন্ত্রীত্ব ও দফতরের উপরে আলাদা আলাদা দাবিদাওয়া রয়েছে শরিকদলগুলির। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডিইউ সুপ্রিমো নীতীশ কুমার একাধিক দফতরের উপরে নজর দিয়ে বসে রয়েছে। রাজ্যের জন্য বিশেষ প্যাকেজের পাশাপাশি নীতীশ দলের জন্য চেয়েছেন চার পূর্ণমন্ত্রী ও একটি প্রতিমন্ত্রী পদ। কম যান না চন্দ্রবাবুও। তিনটি পূর্ণমন্ত্রী ও দু'টি প্রতিমন্ত্রীর পদ চেয়ে আগেভাগেই কথা সেরে রেখেছেন তিনি। তার সঙ্গে তাঁর চাই স্পিকারের পদ। আর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা তো রইলই।

ভোটের আগে নীতীশের সঙ্গে বিজেপির যে সমঝোতা হয়েছিল, তাতে এনডিএ ক্ষমতায় এলে নীতীশকে তিনটি পূর্ণমন্ত্রীর পদ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে সেই পরিস্থিতি আর আজকের সময় যে এক নয়, তা ভালোমতোই বোঝেন পোড় খাওয়া রাজনীতিক নীতীশ। ইন্ডিয়া জোটের তরফে উপ-প্রধানমন্ত্রীর অফার তাঁর কাছে এসেছে আগেই। তবে সেই অফার দূরে ঠেলে আপাতত মোদির সঙ্গেই থাকতে চান তিনি। তার বিনিময়ে পাঁচটি পদ আর এমন কী-ই বা বেশি! সূত্রের খবর, মূলত পরিকাঠামো সংক্রান্ত মন্ত্রকগুলির দিকেই বেশি নজর নীতীশের। কী কী রয়েছে সেই তালিকায়? রয়েছে রেল, গ্রামোন্নয়ন ও জলসম্পদের মতো মন্ত্রক। তার সঙ্গে রয়েছে বিহারের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ। না, এখানেই শেষ নয়। ২০২৩ সালে বিহারে নীতীশ আর্থ-সামাজিক সমীক্ষার পরে রাজ্যের প্রায় ৯৫ লক্ষ পিছিয়ে থাকা পরিবারকে দু'লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য করার কথা ঘোষণা করেছেন। আগামী বছর বিহারে নির্বাচন। তাই পাঁচ বছরের ওই প্রকল্পে কেন্দ্র যাতে চলতি অর্থবর্ষে নিজেদের অংশের টাকা বাড়ায়, সেই দাবি জানিয়েছেন নীতীশ। সুত্রের মতে, ইউপিএ-র ধাঁচে ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচি আনারও দাবি জানিয়েছেন তিনি।

এরপর রয়েছেন চন্দ্রবাবু নাইডু। অনেকদিন বাদে অন্ধ্রে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে তেলেগু দেশম পার্টি। রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরেছে তারা। এরপর কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা থাকতে চলেছে তাঁর। যাকে বলে তিনি একাই কিংমেকার। মোদি সরকারের কাছে একগুচ্ছ দাবিদাওয়া রয়েছে তাঁরও। তিনি চাইছেন, তিনটি পূর্ণমন্ত্রী ও দু'টি প্রতিমন্ত্রী পদ। নীতীশের মতোই জলসম্পদ, গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক, তথ্য-সম্প্রোচার মন্ত্রক, কৃষি মন্ত্রক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রকে নিজেদের সাংসদের দেখতে চাইছেন চন্দ্রবাবু। তালিকায় রয়েছে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকও। এ ছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে তেলঙ্গানা হওয়ায় রাজ্যের আর্থিক চাপ সামলাতে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের দাবি করে প্রায় এক দশক ধরে সরব নায়ডু। সূত্রের মতে, এই মুহূর্তে রাজ্যের মাথায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকার দেনা। যা মেটাতে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের দাবি জানিয়েছেন নাইডু।

নীতীশ, নাইডুর পাশাপাশি বিজেপির পরিস্থিতি দেখে চেপে ধরেছে ছোটোখাটো শরিক দলগুলিও। বিহারের চিরাগ পাসোয়ান তথা এলজেপি দাবি করেছে একটি পূর্ণ ও একটি প্রতিমন্ত্রীর পদ। ওই রাজ্যেই একটি আসন পেয়েছে জিতনরাম মাঁঝির হাম। তাঁদেরও দাবি, একটি পূর্ণমন্ত্রীর পদ। মহারাষ্ট্রে সাতটি আসন পাওয়া একনাথ শিন্ডের শিবসেনা চেয়েছে এক জন পূর্ণমন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রীর পদ। অন্যদিকে, মন্ত্রিত্বের দিকে চেয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের আরএলডি দলের জয়ন্ত চৌধরী, আপনা দলের অনুপ্রিয়া পটেল, জেডিএসের এইচ ডি কুমারস্বামীরাও।

একটা সময় ছিল, যখন বিজেপির কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, সে সময় এই সব ছোট দলকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি বিজেপি। তবে ২০২৪ লোকসভা ভোটের পরে পরিস্থিতি এমন যে ছোট দলগুলির কথা মেনে না নেওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প নেই গেরুয়া শিবিরের কাছে। না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর ভয় রয়েছে বিজেপির। এই মুহূর্তে নীতীশ ও নাইডুর মধ্যে কোনও একজন এনডিএ ছাড়লে সরকার গড়তে সমস্যায় পড়বে বিজেপি।

আরও পড়ুন:মোদি ম্যাজিক শেষ! বারাণসীতে কেন এত কম ভোট পেলেন মোদি?

একদিন আগেই সাংবাদিক বৈঠক করে জোট ইন্ডিয়া জানিয়ে দিয়েছে, আপাতত বিজেপি বিরোধিতার পথেই থাকছে তারা। হিসেব বলছে, মেরেকেটে ৪০ জন সাংসদকে নিজেদের দিকে টানতে পারলেই সরকার গড়তে পারে জোট ইন্ডিয়া। মুখে অবশ্য সেই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছে ইন্ডিয়া জোটের সদস্যরা। এদিকে, বৃহস্পতিবার নাইডুর সঙ্গে গিয়ে দেখা করেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন। সূত্রের খবর, তামিননাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশ, এই দুই পড়শি রাজ্যের বিষয়েই কথা হয়েছে তাঁদের মধ্যে। এখন দেখার, গেরুয়া শিবির এনডিএ শরিকদের দাবিদাওয়া ও প্রত্যাশায় উর্ত্তীর্ণ হতে পারে কিনা! প্রশ্ন উঠেছে, যে যে দাবি প্রত্যেকটি শরিকদল করছে, তাতে সকলের দাবি মানা কি আদৌ সম্ভব হবে বিজেপির পক্ষে। সেখানে প্রত্যাশাভঙ্গ হলে ঠিক কী কী বিপদে পড়তে পারে গেরুয়া শিবির? কারণ সরকার গড়া হয়ে গেলেও যে বেঁকে বসতে পারে শরিকদল, এবং তেমনটা হলেও দেশের শাসনভার হারাতে পারে মোদিবাহিনী! সেই সম্ভাবনাও কিন্তু পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছে না ওয়াকিবহাল মহল।

More Articles