বলিরেখা আর স্মৃতিতে মুড়ে কেমন আছেন কলকাতার বৃদ্ধ অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা?
Anglo Indian Culture: বেশিরভাগ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের থেকেই আমি শুনেছি তাঁদের জীবনের প্রিয় সময় তাঁদের স্কুললাইফ! বেশিরভাগই থেকেছেন বোর্ডিং স্কুলে।
বার্ধক্য। বয়স, সময় না জীবনের থমকে যাওয়া? বুড়ো হওয়া আসলে কী? চামড়ার ভাঁজ, ঝুলিতে জমা গল্প, শেষ না হওয়া কথা না কি এক অবসরময় একাকিত্ব?
প্রথমে শুনব, বছর ৮১-র অ্যানের কথা।
নানা গল্প ও অভিযোগের মাঝে যা জানা গেল, অ্যান চিন্তিত কলকাতায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে। তাঁর আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই অভিবাসিত অস্ট্রেলিয়ায়। নতুন প্রজন্মের কেউই আর কাছে নেই। কাজের সূত্রে কেউ কেউ বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ বা মুম্বইতে বাসরত। আর কমে গেছে ‘পিওর অ্যাংলো’। পিওর অ্যাংলো অর্থাৎ যাদের বাবা-মা দু’জনেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষ। “...এখন অ্যাংলোরা বিয়ে করে ফেলছে বাঙালি, পাঞ্জাবি এবং গুজরাতিদের”।
ফোন করে প্রথমেই জানতে চাই তাঁর শরীরের কথা। শহরে তিনি একা।
-অ্যান আন্টি, কেমন আছ?
-যেমন তোমরা রেখেছ।
-আচ্ছা, আজ একটা প্রশ্ন করি তোমাকে। তুমি কি বুড়ি হয়ে গেছ?
- No! I am ever green- লজ্জা পেয়ে বললেন। অ্যানের মুখরতা ও স্পষ্টতা বরাবর মুগ্ধ করে কিন্তু তাঁকে লজ্জা পেতে শোনা এই প্রথম।
-কোনটা তোমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময়?
ভাবলাম ফোনটা কেটে গেল বুঝি। ধীরে সুস্থে বললেন- দাঁড়াও! আমি চিন্তা করছি...
বললেন, “আমার স্কুল”। বেশিরভাগ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের থেকেই আমি শুনেছি তাঁদের জীবনের প্রিয় সময় তাঁদের স্কুললাইফ! বেশিরভাগই থেকেছেন বোর্ডিং স্কুলে। আরও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পড়ুয়া আর শিক্ষকদের সঙ্গে। পুরনো কলকাতার সঙ্গে এখনকার তফাৎ জিজ্ঞাসা করায় বারাসতের প্রবীণ ইংরেজির শিক্ষক মিঃ স্মিথ বলেছিলেন,
“...আমাদের স্কুলে পড়াকালীন বেশিরভাগ শিক্ষকই ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তখন ব্রিটিশ পিরিয়ড সবে শেষ হয়েছে। মনে আছে মিঃ হোমসের কথা। তাঁরা ছিলেন ঝকঝকে স্মার্ট, সময়ানুবর্তী, গলগল করে ইংরেজি বলে যেতেন। কিন্তু এখন মিশনারি স্কুলগুলিতেও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শিক্ষক বেশি থাকে না। সেই সেন্স অব ডিসিপ্লিন এখন আর কোথায়?”
আরও পড়ুন- ডার্ক লিপস্টিক, ছোট স্কার্ট! অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে মানেই যৌন উন্মাদনা?
অ্যান বলছিলেন, “জানো, আমি যখন থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরতাম তখন বাঙালি মেয়েরা কেউ এইসব পরত না।" তাঁরও প্রিয় স্কুলজীবনের কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘নাইটিঙ্গেল হাউস’ আর লাল স্কার্টের গল্প। “...মা ড্রেস সেলাই করে দিতেন। মায়ের পিঙ্ক ফ্রকের সঙ্গে পিঙ্ক জুতো ছিল। আমাদের বোর্ডিংয়ের ‘রাতের স্যুপ’ আর পুডিংটা খুব ভালো ছিল। আমাদের এক টিচারের হাতে অনেকগুলি কালো তিল ছিল। আমরা তাকে কী বলে খ্যাপাতাম বল তো? বলতাম রাতের স্যুপের সব ব্ল্যাক পেপারগুলি ওঁর হাতে উঠে এসেছে।” বললেন তাঁর দিদির বিয়ের কথা। “...দিদির বিয়েতে এক ফ্রেঞ্চম্যান পিয়ানো বাজিয়েছিল। আমাদের বাঙালি প্রতিবেশীরা শুনতে এসেছিল পিয়ানো। মেন্যুতে পুডিং ওদের ভালো লেগেছিল। বাঙালি বাড়িতে তখন পুডিং বানানোর অত চল ছিল না।”
প্রশ্ন করি, তোমার শহর কি পাল্টাচ্ছে?
“হ্যাঁ। কলকাতার সংস্কৃতি তো খুবই অন্যরকম এখন।”
অ্যান বরাবরই মনে করেন, ব্রিটিশরা চলে গিয়ে শেষ হয়েছে কলকাতার ডিসিপ্লিন। বেশি পছন্দ করেন না বাঙালিদের। সেদিন হঠাৎ বললেন, “জানো, আমাদের সময়ে পোলিসরা খুব কড়া আর ডিসিপ্লিনড ছিল। এত অন্যায় হতো না চারিদিকে। ইন্দিরা গান্ধির সময়ে, মানে কংগ্রেসের সময়কার কথা বলছি।”
আরও পড়ুন- ভেলানকান্নি মাতা ও বড়দিনের প্রসাদি
অ্যান কথায় কথায় বলেন, তাঁর মনে পড়ে ‘ভালো খাওয়া-দাওয়া’-র কথা।
‘ভালো খাবার’ বলতে কী? তাঁকে জিজ্ঞাসা করি।
“ডিফরেন্ট কাইন্ড অব মিট, কেক। আগে জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। এখন বিশেষ করে, বেড়ে গেছে মাংসের দাম। তাই বেশি রান্না হয় না। এখন খালি ‘পরিজ’ খাই, নানা রকমের পরিজ।” অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার জন্য ‘মিক্সড ম্যারেজ’-কেই দায়ী করেছেন অ্যান। অন্যরা নাকি বোঝে না অ্যাংলো সংস্কৃতির গুরুত্ব। আরেকজনও নানা কথার মধ্যে বললেন খাওয়ার কথা।
“ডিসেম্বরে আমি অলওয়েজ আমার পুরনো বাড়িতে যেতাম। আমদের সব অ্যাংলো ভাইবোনেরা আসত। তখন ক্রিসমাসে কলকাতায় খুব শিশির পড়ত। ক্রিসমাসের আগে রাত জেগে গান, বারবিকিউ হতো। আর থাকত হাতে বানানো ওয়াইন। আমাদের মিষ্টি, রোজ কুকি, কুলকুল আর কেক। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা আর সেটা পারেনি। কাজের সূত্রে কেউই এখন এক জায়গায় থাকে না। হারিয়ে গেছে কলকাতার শিশির আর আর তার সঙ্গে বাড়িতে বানানো ওয়াইনের ওম।”
আচ্ছা, ‘ভালো খাওয়া’ কি শুধুই খাবার? নাকি অভ্যাস-আপ্যায়ন, স্বজাতির সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার আড্ডা। একসঙ্গে জড়ো হওয়া তো পরিবারতন্ত্রেরই একটি অংশ। বার্ধক্যের আগে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের যা অসহায়তায় ফেলে তা হলো এই পরিবারহীনতার বোধ।
কথা হচ্ছিল বো ব্যারাকের দু’জন বৃদ্ধ অ্যাডাম আর ফ্রাঙ্কের সঙ্গে। সেদিন আবার একজনের জন্মদিন।
“Oh! I am 85 years young boy today.”
জন্মদিনে সবথেকে বেশি কী মিস করেন?
“পিকনিক। বাট নাও মাই লেগস আর সো আনফিট ফর পিকনিক। আমার জন্মদিনে আমি বন্ধুদের নিয়ে পিকনিকে যেতামই। খরগোশ শিকার করতাম, গান গাইতাম। এখন আমাদের অনেক বন্ধুরাই তো বাইরে চলে গেছে। মোস্টলি মেলবোর্ন। তবে বাইরে যারা গেছেন, আমার মনে হয়, অল আর লিভিং ইন রেমিনিসেন্স। কলকাতাকে ভোলা অত সহজ নয়। সে কলকাতা আমাদের সঙ্গে ভালো-খারাপ যাই করে থাকুক না কেন!”
“আসলে অ্যাংলো পরিবারগুলি সব ভেঙে যাচ্ছে। সংখ্যা কমে যাচ্ছে আমাদের। এরপর হয়তো কলকাতা শহরে আর কেউ জানবেই না অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের কথা। আমি তো বরাবরই একলা, আর আমার এই বন্ধুকে দেখো, দশ বছর আগে ছেড়ে চলে গেল ওর বউ আর একমাত্র ছেলে এখন কানাডায়।”
এইজন্যই ‘কমিউনিটি ক্রিসমাস’ এত হইহই করে পালন করা হয় বো-ব্যারাকে। উইফিলিং আর রোজ কুকির গন্ধে ক'দিনের জন্য উষ্ণ হয়ে ওঠে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লিভিং। বলছিলেন বো-ব্যারাকের পুরনো হয়ে যাওয়ার কথা। সংস্কারের অভাব।
“তবে, আমরা দুই বন্ধু তো দিব্যি রইলাম এখানে। আমরা হলাম স্কুলের বন্ধু।”
দু'জনেই সেন্ট থমাস বয়েজ স্কুল, খিদিরপুরের ছাত্র। স্কুলের নামটা বেশ গর্ব করেই বলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা। সেসময়ের বাংলামাধ্যম নেবারহুডে হয়তো এই মিশিনারি স্কুলই এক শ্লাঘার কারণ ছিল তাঁদের।
আরও পড়ুন- কয়লা শহর, রেল আর চার্চ! কেমন আছেন আসানসোলের আধা-ফিরিঙ্গিরা?
“আমিই আমার বান্ধবীদের প্রথম দেখিয়েছি ইংরেজি সিনেমা। কলেজের সময়, বাঙালি-হিন্দু মেয়েদের আমাদের সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে থাকত নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু ওরাই আমার সঙ্গে বেশি মিশত। কেন জানো?” বলে মুচকি হাসেন শেরিল, “কারণ আমার কাছে ইংরেজি সিনেমার খবর থাকত।”
গ্রেস, আমার আরেক প্রিয় আন্টি। রিপন স্ট্রিটের লাল বাড়িতে মলিন সূর্যাস্তের ভাঙাচোরা রং তখন ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চোয়াল ওঠা গালে। কথা শুনতে পান না বলে চিৎকার করতে হয়।
মাঝেমাঝে সামাজিক ও মানসিক ইনসিকিওরিটি অনুভব করেন কিনা জিজ্ঞাসা করায় গ্রেস বলেছিলেন, “নো! আই ডোন্ট ফিল ইনসিকিওর বাট আই ফিল লোনলি। মাঝে মাঝে কেউ আমার পাশে বসে আমার কথা শুনলে ভালো হতো। আমি জন্মেছি চট্টগ্রামে। ছোটবোন এখন মেলবোর্নে। আমার ছেলে এই শহরেই থাকে কিন্তু আলাদা। আমার ছেলে অ-খ্রিস্টিয় মেয়েকে বিয়ে করেছে। সে বলেছে, আমাকে দেখবে না। দেখো, আমি তো বরাবরই একা থাকতাম। আমার বর ছিলেন একজন আইরিশম্যান। তিনি আমার সঙ্গে সাড়ে চার বছর সহবাস করে দেশে ফিরে যান। বুড়ো হওয়ার পরও যখন আমার ছেলে কাজ করতে যেত আমি একাই থাকতাম কিন্তু ওর হিন্দু বউ আমার সঙ্গে থাকতে চাইল না। মোস্টলি, বিকজ অফ মাই কিচেন। আমরা একে অন্যর ভাষা বুঝতাম না, তা নয়। নাও আই ওয়েট ফর হিস কল। ও যদি ফোন করে বলে, ‘মম, তুমি ভালো আছ?’ আই ফিল বেটার।”
মেলবোর্নে থাকা বেশিরভাগ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানই কিন্তু মনে করেন কলকাতার কথা। কলকাতার কথা কেন ভুলতে পারেন না তাঁরা? “বিকজ অব ইটস বায অ্যান্ড ভাইব্রেন্ট নেচার। অস্ট্রেলিয়া বড় ফাঁকা-ফাঁকা। আই মিস দ্য নয়েজ। এসব দেশ কাজ করার জন্য। ঘর করার জন্য নয়,”– কথা হয়েছিল গ্রেসের বোন অ্যানার সঙ্গে। “…I think globalization has affected us the most.” 'আমাদের' বলতে তিনি বোঝাচ্ছিলেন সংখ্যালঘু সংস্কৃতির কথা।
এই চিন্তা আমি দেখেছি অনেক প্রবীণ অ্যাংলোদের মধ্যেই। জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা চিন্তিত স্বজাতির ফুরিয়ে যাওয়া নিয়েও।
ঘুরে দেখলাম কলকাতার দু'টি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কেয়ার হোমও। তার মধ্যে একটি হলো, ডেলোস্কি-র ‘দ্য ক্যালকাটা খ্রিস্টমাস (১৯৯৮)’ খ্যাত ‘টলিগঞ্জ হোমস’। তৈরি হয়েছিল ‘ইস্ট ইন্ডিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর উদ্যোগে। রিজেন্ট পার্কে রয়েছে এই ‘লালবাড়ি’, ফুলের বাগান, গান আর হাঁসের ছানাদের নিয়ে বিদেশি গ্রামের মতো সুন্দর। এই পৃথিবীতেও এক টুকরো নস্টালজিয়ায় বেঁচে থাকেন অশীতিপর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা বেশিরভাগই ছিল অস্থায়ী চাকুরিজীবি। তাঁদের বেশিরভাগেরই পেনশনের টাকা নেই। জানবাজার অঞ্চলে তাঁদের জন্য রয়েছে আরেকটি কেয়ার হোম, ‘লরেন্স ডি’সুজা হোম’।
আরও পড়ুন- অ্যাংলো বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন ভাগ করা ছিল মানা…
কিন্তু ‘আমাকে দেখবে না।’ এই কথা এত সহজে কী করে বলে ফেললেন গ্রেস?
আমাদের 'সেন্স অব এনটাইটেলমেন্ট' কোথা থেকে আসে? বুড়ো হতে যে অবকাশ লাগে তা কি কোনওদিনই পেয়েছিলেন তাঁরা? নোম্যাড এক কর্মপ্রবণ জাতি। রেলওয়ে ও বন্দরকে ঘিরে বারবার বাসা পাল্টেছে একখান থেকে অন্যখানে। টিকে থাকার জন্য খেটে খেতে হয়েছে বরাবর। সঞ্চয় ছিল না বলে জমে ওঠেনি মসৃণ পিছুটান। তারসঙ্গে বরাবরই ছিল হোয়াইটম্যানদের দেশে উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন। কাজেই, বার্ধক্য তাঁদের একাকী করলেও কাবু করতে পারেনি। তার মূলে হয়তো রয়েছে এই কর্মপ্রবণতাই।
কাজ আর ‘স্যুইট হোম’-এর খোঁজে অনেকেরই ছুঁয়ে দেখা হয়নি অবকাশ কিন্তু অ-ইওরোপিয় জিসাসের পুজো হয়েছে ধূপ জ্বালিয়ে, মাদার মেরি পরেছেন শাড়ি, কলকাতার শিশির মেখে খরগোশ শিকার করতে কতবার দূরে, দূরপাড়ে হোয়াইট ম্যানদের দেশে চলে গিয়েছেন অ্যাডাম আর ফ্রাঙ্ক।
গ্রেসের পুরনো বাড়ির সামনে ট্রাফিক জ্যামে কাটাকুটি হয় রোজ। সন্ধ্যা জড়িয়ে পড়ে বুড়ি শহরের গায়ে। জন্ম ইতিহাস আর মিশ্ররঙের জট খুলতে পারে না এই প্রান্তিক জনজাতি। বলিরেখার ভাঁজে জমে ওঠে গল্প, ক্রিসমাসের আনন্দে আত্মহারা হয় ডিসেম্বরের শহর। নস্টালজিয়ার চাদর বিছিয়ে আজও এই শহরেই বেঁচে থাকেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা। কলকাতার ক্রিসমাসে কি শিশির পড়ে এখনও?