আসল সুভাষকে ভুলিয়ে দিতেই স্ট্যাচু নির্মাণ, কর্তব্যপথ খুঁজে নিন নেতাজিপ্রেমীরাই
Netaji Subhash Chandra Bose: গুজরাত হিংসার দিনে অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানুকে যারা ধর্ষণ করেছিল স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে তারাই আজাদ! নেতাজি কি এই শৌর্য মানতেন, না কি গুঁড়িয়ে দিতেন?
নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে সিনেমা আমরা দেখেছি ঢের। মিথ-মিথ্যে-পোস্ট ট্রুথের দোলনায় নেতাজিকে ঘুরপাক খাইয়ে অনেকেই করে-কম্মে খাচ্ছেন। কিন্তু দু'-একটা ইঁদুর ধরার সুযোগ এমন চমৎকারভাবে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবহার করল, তার তুলনা মেলা ভার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আইকনকে নিজস্ব রাজনৈতিক প্রচারতন্ত্রে মিলিয়ে দিতে পারঙ্গম বহুকাল থেকেই। অতীতে তিনি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনই প্রতিদিন স্বামীজির বাণী ট্যুইট করতেন। ক্রমেই স্বামীজি তাহাদেরই লোক- এমন একটা ধারণা জনমানসে তৈরি করা গেছে। অথচ, বাঙালির মায়, সারা ভারতের হাতের কাছে এক অন্য বিবেকানন্দ ছিল। কেমন সেই বিবেকানন্দ? একটা বহু-প্রচারিত ছোট্ট গল্পে বলে দেওয়া যাক।
একবার গোরক্ষাসমিতির থেকে স্বামীজির কাছে চাঁদা চাওয়া হয়। দুর্ভিক্ষের সময় সেটা, ন'লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিবেকানন্দ এই গোরক্ষকদের জিজ্ঞেস করেন, “আপনাদের সভা এই দুর্ভিক্ষকালে কোনও সাহায্যদানের আয়োজন করেছে কি?” প্রচারক বললেন, “আমরা দুর্ভিক্ষাদিতে সাহায্য করি না। কেবলমাত্র গোমাতাগণের রক্ষাকল্পেই এই সভা স্থাপিত।” স্বামীজি বিস্মিত হয়ে বলেন, “যে দুর্ভিক্ষে আপনাদের জাতভাই লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হল, সামর্থ্য সত্ত্বেও আপনারা এই ভীষণ দুর্দিনে তাদের অন্ন দিয়ে সাহায্য করা উচিত মনে করেননি?” প্রচারক জানালেন, না, কারণ লোকের পাপে এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং তাদের কর্মফলেই তারা মরেছে।
শিষ্য বর্ণনা করেছেন, এই কথা শুনে স্বামীজির মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি সোজা বলে দিলেন,
যে সভা-সমিতি মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে না, নিজের ভাই অনশনে মরছে দেখেও তার প্রাণরক্ষার জন্য এক মুষ্টি অন্ন না দিয়ে পশুপক্ষী রক্ষার জন্য রাশি রাশি অন্ন বিতরণ করে, তার সঙ্গে আমার কিছুমাত্র সহানুভূতি নেই; তার দ্বারা সমাজের বিশেষ কিছু উপকার হয় বলে আমার বিশ্বাস নেই।
বলাই বাহুল্য, এই স্বামীজি মূর্তিমান বিপদ। তাঁকে মুছে ফেলতে চাই এক নতুন দৃষ্টিকোণ নির্মাণ, বারবার তাকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট করতে করতে চলা। এই তালিকা দীর্ঘ। বল্লভভাই প্যাটেলকে যে আসলে তারাই মর্যাদা দিয়েছেন, তা বোঝাতে আকাশছোঁয়া মূর্তি তৈরি হয়েছে। ভোটের সময়টায় প্রধানমন্ত্রীর ঠোঁটে প্রতিদিন রবীন্দ্রকাব্য ঝুলত। দুর্জনে বলে, তিনি রবীন্দ্রনাথের সাজপোশাকও নকল করার চেষ্টা করতেন। এই ধারাবাহিকতাতেই এখন কর্তব্যপথ আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন নেতাজি।
কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, এ তো নেতাজিকে যথাযোগ্য সম্মাননা, আপত্তিটা তাহলে কোথায়! বর্তমান শাসক দলের উগ্র দেশপ্রেম এবং সংকীর্ণ মেরুকরণের রাজনীতির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে নেতাজির জীবন।
আরও পড়ুন:নেতাজির প্রিয় বাহন! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়ে আশি বছরের ফোর্ড জিপ এখন কলকাতার বাসিন্দা
ভোটে জিততে বর্তমান শাসক দল বালাকোটের মতো আখ্যান নির্মাণ করেছে। গত আট বছরে এ-দেশে লাগাতার অপর করা হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। অমিত মালব্য-র মতো শাসক দলের প্রতিনিধিরা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে দ্বিজাতিতত্ত্ব-র বীজে জল-সার দিয়ে গেছেন লাগাতার। এই সক্রিয়তার ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়েছিলেন নেতাজি। ভোটের লোভে প্রতিবেশী পাকিস্তানকে হামলার গপ্প আর আজাদ হিন্দ বাহিনীর মরণপণ লড়াইকে এক রেখায় বসানো অন্যায়। গেরুয়াবাহিনী তাত্ত্বিকভাবেই নেতাজির সত্ত্ব দাবি করতে পারে না।
নেতাজির স্মৃতিচারণে গান্ধী প্ৰথমেই লিখেছেন, নেতাজির জীবন থেকে সবার প্রথমেই শিখতে হয়, তিনি কীভাবে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও আঞ্চলিকতার উর্ধ্বে উঠে একই উদ্দেশ্য, রক্তদানে সকলকে একজোট করার পথ নিয়েছিলেন। বিজেপির আদর্শপুরুষ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চিঠিতে পাই,
সুভাষচন্দ্র আমার সাথে দেখা করেন এবং বলেন, হিন্দু মহাসভা যদি বাংলায় রাজনৈতিক সংগঠন হিসবে মাথাচাড়া দিতে চায়, তবে সেটা জন্মের আগেই গুঁড়িয়ে দিতে বাধ্য হব, যদি বলপ্রয়োগ করতে হয়, তা হলে সেটাই করব।
এই সুভাষচন্দ্রকে কীভাবে গ্রহণ করবেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরিরা?
১৯৪০ সালের ৪ মে ফরওয়ার্ড ব্লকের কাগজে ‘কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন’ শিরোনামে সুভাষ সম্পাদকীয় লেখেন,
হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কোনও সদস্য কংগ্রেসের কোনও নির্বাচনী কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।
হিন্দু মহাসভার রূপাদর্শে গড়ে ওঠা শাসক দল কি নেতাজির এই বাণীটি মুক্তকণ্ঠে প্রচার করতে পারবে? কর্তব্যপথের ধারের দেওয়াল রাঙিয়ে দেওয়া যাবে অসাম্প্রদায়িক নেতাজির দৃঢ় বাক্যগুলি দিয়ে?
নেতাজির জীবনের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। এ-দেশের শাসক দল যে সম্প্রদায়কে ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই টার্গেট করেছিল, সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে নেতাজির সম্পর্কটা কেমন ছিল? ১৯৪১ সালে তাঁর অন্তর্ধান পর্বে পেশোয়ারে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন মিঞা আকবর শাহ। ইউরোপ থেকে এশিয়া সাবমেরিন যাত্রায় তাঁর একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী ছিলেন আবিদ হাসান। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম ডিভিশন, যারা ইমফলে, কোহিমায় লড়াই করল- তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহম্মদ জামান কিয়ানি। তাঁর গান্ধী ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছিল ইনায়াত জামান কিয়ানি। ইম্ফলের কাছে এপ্রিল ১৯৪৪-এ তেরঙ্গা উত্তোলন করেন শওকত মালিক।
১৯৪৩ সালে ইউরোপ থেকে এশিয়া আসেন নেতাজি। তিনমাসের যাত্রার পর তিনি এশিয়া এসে পৌঁছলেন, জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আজাদ হিন্দ আন্দোলন শুরু হল। আজাদ হিন্দ আন্দোলনে হিন্দু, মুসলিম, শিখ- সব সম্প্রদায়ের সমান অধিকার ছিল। সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করতেন তাঁরা। আজাদ হিন্দ ফৌজে কোনও ভেদাভেদ ছিল না। লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারপর্বে গান্ধি দেখা করতে গিয়েছিলেন বন্দি সেনাধ্যক্ষদের সঙ্গে। তাঁরা গান্ধীকে বললেন, "আমাদের এখানে হিন্দু চা আলাদা মুসলিম চা আলাদা দেওয়া হয়।" নেতাজি এমনটা কখনও হতে দেননি। গান্ধী বললেন, তোমরা এটা মানো কেন? শাহনওয়াজ খানরা বলেছিলেন, “মানি না, আমরা চা খাবার সব ভাগ করেই খাই।” আইএনএ-র মোটো ছিল- Ittehad, Itemad, Qurbani. বাহিনীর ৪০ শতাংশ সদস্য ছিলেন মুসলিম। আইএনএ–র মেজর ছিলেন জৈন–উল–আবেদিন। জয় হিন্দ স্লোগানটি তাঁরই দেওয়া। বাহিনীর রিক্রুটমেন্ট অফিসার ছিলেন হুসেন মুস্তাক রনদেরি। আদাজ হিন্দ ফৌজ গঠনের জন্য নেতাজি যখন অর্থসাহায্য নিচ্ছেন, সবচেয়ে বেশি সাহায্য এসেছিল মেমন আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানির থেকে। সেই আমলে এক কোটি টাকা নগদ দিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: ৮ সেপ্টেম্বর দিনটিকে কেন বেছে নেওয়া হলো নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের জন্য? তুঙ্গে বিতর্ক
লালকেল্লায় ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে যখন বিচার বসল, আজাদ হিন্দের যে তিন সামরিক নেতাকে ডাকা হলো, তাদের একজন শাহনওয়াজ খান। নেতাজির শেষ বিমানযাত্রায় একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী ছিলেন হাবিবুর রহমান। হরিপুরা কংগ্রেসের বক্তৃতায় নেতাজি বলেছিলেন, কংগ্রেসের আদর্শই হলো, লিভ অ্যান্ড লেট লিভ। এই নীতির মূল আদর্শ ছিল অন্যের ধর্ম পোশাক, খাদ্য, সংস্কৃতিতে নাক না-গলানো। অসূয়া না রাখা।
এই মহাজীবনের আদর্শ জোর গলায় প্রচার করতে পারবেন বিজেপির বড়-ছোট-সেজ-মেজ নেতারা? গুজরাত হিংসার দিনে অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানুকে যারা ধর্ষণ করেছিল স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে তারাই আজাদ! নেতাজি কি এই শৌর্য মানতেন, না কি গুঁড়িয়ে দিতেন? যে শাসক দলের কর্মীরা নিয়ম করে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ভাইরাল করে, তাদের কর্তব্যপথকে নেতাজি প্রতিহতই করতে চাইতেন না কি? শাসক দলের সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা এই প্রকৃত নেতাজিকে কখনও তুলে ধরবে না, তুলে ধরবে এক যুদ্ধবাজের সংরূপ, যাতে ভোটের রণভেরিটা তাঁকে সামনে রেখেই বাজানো যায়। আসল নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে ভুলিয়ে দেওয়ার মোক্ষম সময় এটা। কর্তব্যপথ নির্ধারণ করুক নেতাজিপ্রেমীরা।