অবসরের আমি, আমার অবসর
সত্যিই কি নির্জনতাকে চিনতে পারা, নির্জনে নিজেকে দেখতে চাওয়টা শৈল্পিক ভঙ্গিমা নয়? অবসরকে, নির্জনতাকে একাকিত্বকে কীভাবে দেখছেন দার্শনিকরা?
দিন কয়েক আগে জয় গোস্বামী লেখাপ্রকাশ থেকে স্বেচ্ছা-অবসর ঘোষণা করেছেন। ২৪ পাতার একটি পুস্তিকায় তিনি এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট, কার্যকারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এ ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল ধারবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর কাব্যপুস্তিকায়। গত দেড় বছরে লাগাতার যে ছোট ছোট সংকলনগুলি প্রকাশ পাচ্ছিল তার শেষের দিকে, পর্যায়ক্রমে প্রকাশ পেয়েছিল অবসর এবং বানপ্রস্থ নামক দু'টি বই। জীবনসায়াহ্নের এই গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলি কবির মনে স্থায়ীভাবে প্রভাব বিস্তার করছিল বোঝা যায়। একা-নির্জনে তাঁর এই সিদ্ধান্তটির কথা আমি বারবার ভেবেছি। মানুষ কেন স্বেচ্ছা অবসর নেয়? অবসর শব্দটির ব্যঞ্জনা কত দূর?
আপাতভাবে অবসর কথাটি দু'রকম অর্থে প্রযুক্ত হয়। "প্রভাতে পথিক ডেকে যায়/ অবসর পাইনে আমি হায়। " জনপ্রিয় রবীন্দ্রগানটিতে অবসর মানে উদ্যোগে, উদযাপনে শামিল হওয়ার জন্য নিজের কাজ থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়া। এইখানে যে অবসর চাইছে সে প্রভাতের পথিকের ডাক ফেরাতে বাধ্য হচ্ছে। সে অবসর পাচ্ছে না। অবসরের এই ধারণাটি এখানে সাময়িক বিরতির বোধ। এই ধরনের অবসর মন সরিয়ে কিছুক্ষণ অন্য একটা কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ। ফুরসত। আমরা বলি, অবসরে আমি বই পড়ি। বাগান করি। অর্থাৎ এই অবসরে আমার কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয় না। স্বাভাবিক বিরতির পর গতানুগতিকতায় ফেরা সুনিশ্চিত, এই ধারণাই থাকে বরং। অবসর ফুরোয় নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেই।
আরেক ধরনের অবসর রয়েছে। একটি দীর্ঘ পথরেখা পেরিয়ে, পূর্ণচ্ছেদের ধারণা নিয়ে আসে সেই অবসর। একজন ক্রীড়াবিদ যখন খেলা থেকে অবসর নেবেন ভাবেন, তখন সেই সরে আসা চিরতরে সরে আসা। ইতি। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ২০ বছর খেলার পর টেনিস ব্যাট নামিয়ে রাখলেন সানিয়া মির্জা। বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদছিলেন সানিয়া। শুধু তারকাই নয়, ধরা যাক, একজন লোকো-পাইলট যখন সিদ্ধান্ত নেন তিনি আর ট্রেন চালাবেন না। তখন থেকেই এই অবসরের শুরু। এই সিদ্ধান্তে চোখে জল আসা অবশ্যম্ভাবী। সারাজীবন একনিষ্ঠ হয়ে যে কাজ করেছি তা আর করব না, এই ঘোষণা করার সময় মানুষ পিছনে ফিরে তাকায়। বন্ধুরা স্মৃতিচারণ করে। চোখে জল আসে। কখনও এই অবসর স্বেচ্ছাধীন। কখনও আবার তা আসে পূর্বনির্ধারিত সময়ে। হয়তো মেয়ের বিয়ের জন্য বাবার এককালীন টাকা দরকার। তিনি ভাবলেন চাকরি থেকে স্বেচ্ছা-অবসর নিলে ওই টাকাটা দ্রুত পাওয়া যাবে। আবার এমনও তো হতে পারে, তিনি পূর্বনির্ধারিত সময়ে অবসর নিয়ে যে টাকা পেলেন তা দিয়ে বাড়ির দোতলা করলেন। অবসরে তিনি কিন্তু একেবারে বসে গেলেন না। একটা পথ থামল। বাকি মুখরতাগুলি থাকল। প্রথম যে অবসরটির কথা আমরা আলোচনা করছিলাম, তা ফুরোলে কিন্তু আবার নিজের কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথম অবসরের ফল- আনন্দ। অথচ, এখানে আলোচিত দ্বিতীয় অবসর নিশ্চিত ভাবে দুঃখবোধবাহী। একটাই শব্দ তার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দ্যোতনা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৈপরিত্য আছে। আবার একটি মিলও আছে। অবসরের এই দুটি ধারণার সঙ্গেই সময় শর্ত হিসেবে প্রযুক্ত। প্রথম অবসরটি একটা নির্ধারিত কালখণ্ড। গরমের ছুটি যেমন। দ্বিতীয় অবসরটি আসবে স্বাভাবিক নিয়মে একটা কালখণ্ড পেরোনোর পর। অর্থাৎ দু'ক্ষেত্রেই সময় একটা সূচক।
কিন্তু অবসরের একটি তৃতীয় মাত্রাও আছে। সেই অবসর আসলে আধ্যাত্মিক নির্জনতা। মুখ গুঁজে যাঁরা বাড়ির কাজ করেন তাঁরা অনুযোগের সুরে বলেন, একটু নিজের দিকে চেয়ে দেখার অবসর পাই না৷ এই অবসর আসলে বৃহদার্থে নিজের দিকে চেয়ে দেখার অখণ্ড সময়। বাইরের খেলার ডাক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আত্মদর্শনের প্রস্তুতি।
আমরা হাপিত্যেশ করি, অবসরের পর লোকটা একা হয়ে যাবে। তাই বলি, থাকো। জীবনের হইহই, হাজারো ব্যস্ততা পেরিয়ে একা হওয়াটা যেন কাম্য নয়। কিন্তু একা হওয়া মানেই কি নিঃসঙ্গ হওয়া? অনেকের ভিড়েও কি মানুষ নিঃসঙ্গ বোধ করে না? নির্জনযাপন, স্বেচ্ছায় একা হওয়া মাত্রই অবসাদের দ্বারে ঘা, ভাবি আমরা। একা মানেই একঘরে, সমাজবিচ্ছিন্ন— এই ধারণাই আমাদের মধ্যে লালিত হয়েছে। একা হওয়া মানে যে একটা নতুনতর সংলাপ, সেই উপলব্ধি থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আমরা। বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের অন্তর্লীনতা মুছে ফেলেছে। আমাদের ভিড়ের মধ্যে এনে ফেলেছে। এখানে নির্জনতা বলে কিছু নেই। স্রোতে ভেসে থাকতে পারাই এই নয়া সমাজের বৈশিষ্ট্য। আমি কোনও ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি না তো, এই বোধ এই ডিজিটাল সমাজে সর্বদা জাগরুক। পরিভাষায় একে বলে— ফোমো বা ফিয়ার অফ মিসিং আউট। সমাজমনের এই স্বভাবগতি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কেউ একটু সরে দাঁড়াতে চাইছে। নিজের দিকে তাকাতে চাইছে। আত্মমগ্ন হতে চাইছে। ধ্যান ভাঙুক বারবার, এমনটা চাইছে না। বরং গভীর জলে অবগাহন করতে চাইছে, এ যেন বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ এই বিশেষ ভঙ্গিমাটির কোনও অস্বিত্বই এ জীবনে নেই। ফলে বিশ্বাসও নেই।
কিন্তু সত্যিই কি নির্জনতাকে চিনতে পারা, নির্জনে নিজেকে দেখতে চাওয়টা শৈল্পিক সাধনা নয়? অবসরকে, নির্জনতাকে একাকিত্বকে কীভাবে দেখছেন দার্শনিকরা?
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটশে মনে করেন, আত্মপ্রত্যয় মনকে উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যায়। এই আত্মপ্রত্যয় আসে নির্জনতায়। নিটশে আমাদের 'পাথ অফ গ্রেটনেস' বা মহত্ত্বের পথ নামক অভিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করান। মহত্ত্ব এখানে দেবত্ব নয়। সদগুণের সর্বোচ্চ স্ফুরণ। নিটশে মনে করেন মহত্ত্বকে খুঁজতে গেলে, একজন ব্যক্তিকে ভিড় থেকে আলাদা হতেই হবে। একা হতেই হবে। নিটশের কথায় ব্যক্তিকে গোষ্ঠীর উদযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য সব সময় লড়তে হয়। কেউ চাইলে প্রায়শই একা হতে পারে। কেউ কেউ একা হতে ভয়ও পায়। কিন্তু আত্মিক নির্জনতা অর্জনের জন্যে কোনো দামই বেশি দাম নয়। দাস স্পোক জরথ্রুস্ট গ্রন্থে নিটশে দেখান সুখের আসল চাবিটা রয়েছে অন্তরে। আর অন্তরের দেখা মেলে নির্জনে। নিটশে আরও বলেন, মানুষের উপস্থিতি অনুপস্থিতির উপর আমার সুখ নির্ভরশীল নয়। আমি সেই উপস্থিতি অপছন্দ করি যা আমায় সমৃদ্ধই করে না। প্রকারান্তরে আমার নির্জনতাটুকু কেড়ে নেয়।
নিটশে নির্জনতা আর একাকিত্বকে আলাদা করেছেন। তাঁর মতে, একাকিত্ব একটা অভাববোধ। সে থাকলে আমার আর একা লাগত না। আমার একা লাগছে জানলেই সে মেসেজ করবে, ফোন করবে, তখন আমার আর এই বোধটা থাকবে না। আমি এই বোধটা আমায় ঘিরে ধরুক তা চাই না। এ হেন অনুভূতিমালা একাকিত্বে সাধারণ। কিন্তু নির্জনতা ঠিক উল্টো। তাকে অভ্যর্থনা জানানো একটা চয়েজ। যদি একাকিত্ব শূন্যতা হয় তবে নির্জনতা এক ধরনের পূর্ণতা। এই পূর্ণতার বোধ সত্তাকে সমৃদ্ধ করে।
আরেক বিশ্ববন্দিত দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্ড নির্জনযাপনের ব্যখ্যায় চমকপ্রদ তুলনা টেনেছেন। তিনি দেখান, ভিড় একটা বড় মিথ্যে। যিশুর ক্রুশবহনকালেও তো ভিড় ছিল। সবচেয়ে বেশি ভিড় ছিল। যিশু সেই ভিড়ের উদ্দেশ্যে সাতটি বাণী দেন। কিন্তু তিনি জনতার শুশ্রুষা নেননি। কোনও ভোটাভুটিতে যাননি। তারপক্ষে সওয়াল করার জন্য কাউকে চাননি। একা সত্যের সন্ধান করতে করতে নিজেই মিশে গিয়েছেন সত্যে। আমি আর আমার সত্য আমরা মুখোমুখি বসে থাকব, নিভৃতে, আমাদের সংলাপ আমার ভিতর আলো জ্বালবে। যে আলো নিভে গিয়েছে সামাজিকতায়, লোকখ্যাতির বিড়ম্বনায়, এই হলো তৃতীয় অবসরের স্বরূপ।
দ্য উইসডম অফ লাইফ গ্রন্থে দার্শনিক শোপেনহাওয়ার বলেন, একমাত্র একা হলেই একজন মানুষ তার নিজের মতো হয়ে ওঠে। সে যদি নির্জনতাকে ভালো না বাসে তবে সে স্বাধীনতাকেও ভালোবাসে না। গণিতজ্ঞ পাস্কাল দেখিয়েছিলেন, আমরা একটা ঘরে চুপচাপ নিজের সঙ্গে ঘর করতে পারি না। সমস্যার শুরু এখান থেকেই৷ আমরা নিজের অনুভূতিগুলির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাই বলেই, ক্রমাগত নানাদিকে ছড়িয়ে যাই, নানাভাবে জড়িয়ে যাই। সুতোর জটে জীবন কেটে যায়।
নির্জনতার মুখোমুখি হওয়ার অবসর, আত্মার আয়নায় নিজমুখ দর্শনের অবসর, সত্য অনুসন্ধানের অবসর, নিজের ভাঙা টুকরোগুলিকে জুড়ে, ধুয়েমুছে রাখার অবসর, যা দেখেও দেখি না, শুনেও শুনি না, তা অনুভব করার অবসর, নির্জনে সাধনার অবসর, একজন কবি চাইবেন, এই তো কাম্য। অবসরের মহানীলাকাশকেই আমি প্রণাম করি।