কালো চালের ভাত, পায়েস, বিরিয়ানি! পুষ্টিগুণ জানলে চমকে উঠবেন

কালো চালের যে শুধু ভাতই হয় তা নয়। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, পায়েস, খিচুরি, স্যুপ, এমনকী, বিরিয়ানিও রান্না করা যায়। তবে রান্না করার পর এই ভাত বেশ আঠালো ধরনের হয়, সাদা চালের মতো ঝরঝরে হয় না।

ভাত ছাড়া বাঙালির একদম চলে না, দিনে একবারটি হলেও তার ভাত চাইই চাই। বহুকাল আগে থেকেই বাঙালির খাদ্যতালিকায় প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে ভাত। ভাতের সঙ্গে বাঙালির এক আলাদা টান রয়েছে। আমাদের বাড়িতে আমরা সাধারণত সাদা চালের ভাত খেয়ে থাকি। কিন্তু কালো চালও যে আছে, তা জানেন কি? আর তার পুষ্টিগুণও অন্যান্য চালের থেকে অনেক বেশি। তাই যাঁরা আপাতত ডায়েটে আছেন, আর ভাত দেখেও খেতে পারছেন না, তাঁদের জন্য এই কালো চাল যুগান্তকারী এক সৃষ্টি। কালো চালের নাম শুনে অনেকেই হয়তো নাক সিঁটকোচ্ছেন। তাঁদের জন্য একটাই কথা বলার, ‘সে দেখতে কালো, কিন্তু খেতে ভালো!'

এই কালো ধান চাষ প্রথম শুরু হয় বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায়। তারপর আস্তে আস্তে তা পশ্চিমবঙ্গে পরিচিত হয়। ২০০৮ সালে কালো চাল পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বার পাওয়া গিয়েছিল ফুলিয়ায়। ধান-গবেষক অনুপম পালের তত্ত্বাবধানে সেই ধান ফলানো হয়েছিল রাজ্যের কৃষি দপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে সেই কালো চাল আজ সাগরপারেও যাচ্ছে।

ভাতের চাল যদি কালো হয়, সবাই মুখ ফিরিয়ে নেবে এটাই সত্যি। কিন্তু ইতিহাসে বলছে, এই কালো চালের ভাত নাকি সাধারণ মানুষকে খেতেই দেওয়া হতো না। অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই সত্যি। ওরাইজা সাটিভা নামের কালো, আঠালো, বাদামের স্বাদযুক্ত ভীষণ পুষ্টিকর চালকে একসময় নিষিদ্ধ চাল বলা হতো। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানা যায়, এক সময় চিনের সম্রাট এবং তাদের রাজন্যবর্গের জন্যই কেবল সংরক্ষিত ছিল এই চাল। গোপনে এই কালো চালের চাষ করা হতো। সম্রাটদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করতে এই চাল খাওয়ার নির্দেশ ছিল এবং সেই কারণে সাধারণ জনগণের জন্য এই চাল নিষিদ্ধ ছিল।

আরও পড়ুন: পাতে এই খাবার থাকলেই ক্যানসারকে চিরবিদায়! বলছে গবেষণা

কালো চালের পুষ্টি উপাদান

সাদা চাল, বাদামি চাল, লাল চাল ও কালো চাল- এই চার রকমের চালের মধ্যে কালো চালের গুণাগুণ আধুনিক পুষ্টিবিদদের নজর কেড়েছে। ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম পরিচিতি লাভ শুরু করে কালো চাল। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে যেমন, চিন, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে এই চালের চাষ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এই চালের বহিরাংশে অ্যান্থোসায়ানিন বেশি মাত্রায় উপস্থিত থাকায় চালের রঙ কালো হয়। কৃষিবিজ্ঞানীরা চার রকমের কালো চালের খোঁজ পেয়েছেন। এগুলো হল ব্ল্যাক জাপনিকা চাল, ব্ল্যাক গ্লুটিনউস চাল, ইতালিয়ান কালো চাল ও থাই ব্ল্যাক জেসমিন চাল। হাফ কাপ কালো চালের পুষ্টিগুণ বিচার করলে দেখা যায় এতে শক্তি আছে ৩৫৬ কিলো ক্যালোরি, প্রোটিন ৮.৮৯ গ্রাম, ফ্যাট ৩.৩৩ গ্রাম, শর্করা ৭৫.৫৬ গ্রাম, ফাইবার ২.২ গ্রাম, আয়রন ২.৪ মিলিগ্রাম।

বিশ্বের ধনী দেশগুলিতে এই চালের ব্যাপক চাহিদা। যুক্তরাষ্ট্র-সহ ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে কালো চালের বাজার আছে। আমেরিকা ও আরব দুনিয়ার ব্যবসায়ীরাও বাংলার কালো চালের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানাচ্ছেন বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল কমিটি-র চেয়ারম্যান সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়। ২০১৭-তে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত ‘ফুড ফেয়ার’-এ কালো চালের বিভিন্ন খাবার রাখা হয়, যাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজার ধরা যায়। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের অধীন সংস্থা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড প্রসেসড ফুড প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা ‘অ্যাপেডা’ সূত্রের খবর, কালো চালের নমুনা জাপানেও পাঠানো হয়েছিল এবং তাদের সাড়াও ইতিবাচক।

কালো চালের উপকারিতা

কালো চালের বহুমুখী উপকারিতা আছে। চিকিৎসা-সংক্রান্ত গুণাগুণের জন্য ব্ল্যাক রাইসের চালকে ‘ওয়ার্ল্ড সুপার ফুড’ বলা হয়। তাই এর দামও অন্য সব চালের তুলনায় অনেক বেশি। এই চালে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রচুর থাকায় শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ত্বক পরিষ্কার করে ও শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দেয়। কালো চাল শরীরের Inflammation কমায় ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে। এতে থাকা ফাইবার হার্টকে সুস্থ রাখে। গবেষণায় জানা গেছে, কালো চাল নিয়মিত খেলে সংবহন তন্ত্রে এথেরসক্লেরো টিক প্লাক তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে শিরা-ধমনির ভেতরে ফ্যাট জমে না ও রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে। এমনকী, এই চাল ক্যানসারও প্রতিরোধ করে। কালো চাল হজমেও সাহায্য করে। এই চালে প্রচুর ভিটামিন বি থাকায় মানসিক চাপ কমায় ও স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখে।

সাদা চাল না কালো চাল?

যাঁরা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান বা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাঁরা খাদ্যতালিকা থেকে ভাতকে একেবারেই বাদ দিয়ে দেন! কিন্তু আমরা যেহেতু বহুকাল ধরে ভাত খেতে অভ্যস্ত, তাই এর থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা একটু অস্বস্তিকর। পুষ্টিবিদরা বলেন, কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়ে গেলে কিছু সমস্যা হয়। ধবধবে সাদা চাল দেখতে সুন্দর হলেও ভাতে পুষ্টিগুণের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট থাকে না অতিরিক্ত পালিশ করার ফলে। কিন্তু ঢেঁকি-ছাঁটা লাল চাল বা কালো চালের ভাত খেতে তো ভালোই, সেইসঙ্গে নানা পুষ্টিগুণেও তা সমৃদ্ধ।

Black Rice

 

সাদা চালের চেয়ে কালো চালে ক্যালোরির পরিমাণ কম, উল্টে পাওয়া যায় উদ্ভিজ প্রোটিন। শরীরে কোনও Inflammation থাকলে তাও কমিয়ে দেয়। সুস্থ রাখে হার্ট আর লিভার, কমায় স্ট্রেসের মাত্রা।

ব্ল্যাক রাইস তৈরির রন্ধন প্রণালী

প্রথমে প্রয়োজন অনুসারে ব্ল্যাক রাইস নিন। এরপর একটা পাত্রের মধ্যে সারারাত ধরে এই চাল জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। যদি তাড়াতাড়ি তৈরি করার দরকার হয়, তাহলে ঘণ্টাদুয়েক জলে কালো চাল ভিজিয়ে রাখতে হবে।

এরপর চাল ফুলে গেলে তা থেকে জল ঝরিয়ে নিন।

এরপর পরিষ্কার জল দিয়ে ওই চাল ৩-৪ বার ধুয়ে নিতে হবে।

এরপর চালের পরিমাণের ঠিক দ্বিগুণ জল দিয়ে মাঝারি আঁচে রান্না করতে হবে।

যদি সারারাত ধরে চাল জলে ভেজানো থাকে, তাহলে আধ ঘণ্টা ধরে ভাত ফোটাতে হবে আর যদি দু'-ঘণ্টা সময়ের জন্য চাল ভেজানো থাকে, তাহলে এক ঘণ্টা সময় নিয়ে ফোটাতে হবে।

ভাত ফোটানোর সময় মাঝে মাঝে হাঁড়ির ঢাকনা সরিয়ে জলের পরিমাণ ঠিক আছে কি না, দেখে নিতে হবে।

ভাত রান্না হয়ে গেলে সেগুলো আঙুলে চাপ দিয়ে দেখে নিতে হবে যে, ঠিকমতো সেদ্ধ হয়েছে কি না।

যদি ভাত নরম হয়ে যায়, তাহলে তা সেদ্ধ হয়ে গেছে বলেই ধরে নিতে হবে।

কালো চালের যে শুধু ভাতই হয় তা নয়। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, পায়েস, খিচুরি, স্যুপ, এমনকী, বিরিয়ানিও রান্না করা যায়। তবে রান্না করার পর এই ভাত বেশ আঠালো ধরনের হয়, সাদা চালের মতো ঝরঝরে হয় না।

কালো চালের ধান চাষের সময়

শুধুমাত্র আমনের মরশুমেই ব্ল্যাক রাইস চাষ করা যায়। বোরো মরশুমে চাষ হয় না। কারণ, এর ফুল ফোটার সময় যদি তাপমাত্রা বেশি থাকে তাহলে ফুল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই শ্রাবণের মাঝামাঝি ধান লাগানো হয়।

কালো চালের চাহিদা এবং ভবিষ্যৎ

পশ্চিমবঙ্গ থেকে কর্নাটক ও তামিলনাডুতেও যাচ্ছে কালো চাল। বাংলার কালো চালের ভালো বাজার তৈরি হচ্ছে ইউরোপের দেশে। চাষের এলাকা বাড়াতে কৃষি দপ্তর থেকে বীজ দেওয়া হয়। সঙ্গে প্রযুক্তিও দেওয়া হয়। মূলত এই রাজ্যে কালো চাল ‘ঔষধি চাল’ হিসেবেই উৎপাদন হচ্ছে। বেঙ্গালুরুতে কালো চাল অন্তত ১৬০ টাকা কেজি দরে বিকোচ্ছে, ফলাচ্ছেন কর্নাটকের চাষিরাই।

কিন্তু আলো-ছড়ানো সেই কালো চালের পথেও কাঁটা আছে! যথেষ্ট ফলনের অভাবের কাঁটা। সরকারি উদ্যোগে চাষ শুরুর এত বছর পরেও পশ্চিমবঙ্গের নয়টি জেলায় সব মিলিয়ে কালো চাল উৎপন্ন হচ্ছে মাত্র ১৫ টন! যেখানে রাজ্যে খরিফ ও রবি মরসুম মিলিয়ে চালের মোট উৎপাদন দেড় কোটি টনেরও বেশি। অ্যাপেডা-র বক্তব্য, ১৫ টনের মুঠিভর কালো চাল নিয়ে রপ্তানিতে যাওয়ার ভাবনা হাস্যকর। কমপক্ষে ২০০-২৫০ টন উৎপাদন হওয়া চাই। কাঁটা আরও আছে। কৃষি দপ্তর সূত্রের খবর, বর্ধমানের আউশগ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও এই বিশেষ ধান ভাঙানোর উপযুক্ত কল নেই। কালো চালের আসল উপাদান হল এর ওপরে থাকা কালো রঙের পাতলা খোসা। ধান ভাঙানোর সাধারণ মেশিনে ওই খোসা উঠে যায়। ঢেকিতে ছাঁটা এক্ষেত্রে আদর্শ, কিন্তু সেটা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। তাই চাই উপযুক্ত ধান-ভানা কল। তাতে উৎপাদন বাড়বে। কালো চালের বাজারও উন্নত হবে।

দেশের এক প্রথম সারির রেস্তোরাঁ গোষ্ঠীর কর্ণধার বলেছেন, “চিনের কুনমিং প্রদেশে দাই সম্প্রদায়ের মানুষ মূলত এই কালো চালেরই ভাত খান। কিন্তু এখানে আচমকা কালো ভাত যত্রতত্র চালু করলে লোকে ভয় পেয়ে যাবে। তাই বিশেষ বিশেষ পদের মাধ্যমে এর প্রসার ঘটাতে হবে।" তার মতে, “খাবারের রেস্তোরাঁয় কালো চাল দিয়ে বিশেষ পদ উৎসবের মরশুমে তৈরি করতে হবে। যাতে মানুষ আস্তে আস্তে এই চালের সঙ্গে পরিচিত হয়। কালো চালের চাহিদা বাড়লে এর বাজার ভালো হবে এবং কৃষকরাও কিছুটা লাভ করতে পারবে।"

 

More Articles