জীবনকে বাজি রেখে চিনের বৌদ্ধধর্মের প্রচার! বুদ্ধের আলোকে তবু ছায়াতেই বোধিধর্ম
Buddhism: বোধিধর্মনের মৃত্যু কবে হয়েছিল সে বিষয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তিনি তাঁর চার শিষ্যকে ডেকে নিজের শেষ জ্ঞানটুকু দান করে চলে যান।
আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে কথা, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বোধিধর্মর বাস তখন ভারতের মাটিতে। সমগ্র বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে গৌতম বুদ্ধের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন বোধিধর্মনই। পরবর্তীকালে বোধিধর্মর হাত ধরেই চিনে বৌদ্ধধর্মের উত্থান ঘটে। আরও পরের দিকে তাকেই ‘জেন বৌদ্ধধর্ম’ নামে ডাকা হতো। তবে কেবল চিনেই থেমে থাকেননি বোধিধর্ম। জাপান, কোরিয়া সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশেই এই ধর্মের প্রচার করেছিলেন তিনি।
চিনে এসেই প্রথমে লিয়াং সাম্রাজ্যে নিজের বসতি স্থাপন করেন তিনি। তখন সম্রাট উ-এর শাসন। সম্রাটও নিজেও ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ। ১১২৫ সালে সংকলিত ‘ব্লু ক্লিফ রেকর্ড’-এ তাঁর বিখ্যাত সভাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। বোধিধর্ম যখন প্রথমবার সম্রাটের সঙ্গে দেখা করেন, সম্রাট তাঁকে একটি প্রশ্ন করেন, “মন্দির বানিয়ে, সন্ন্যাসীদের দানধ্যান করে আমি কতটা পুণ্য অর্জন করেছি বলতে পারেন?”
উত্তরে বোধিধর্ম বলন, “এতে পুণ্য হয় না।”
শোনা মাত্রই বেজায় চিন্তায় পড়লেন সম্রাট। তিনি শুরু থেকেই বিশ্বাস করতেন, ভালো কাজ করলে, মানুষের ভালো করলে, পাশে দাঁড়ালে পুণ্য অর্জন হয় আর খারাপ কাজ করলে পাপ হয়। জীবনের কোনও না কোনও সময় সেই দুইয়েরই প্রায়শ্চিত্ত হয়। কিন্তু সন্ন্যাসীর মুখে প্রথমবার এমন কথা শুনে তিনি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি।
“যদি পাপ-পুণ্য না থাকে, তবে বৌদ্ধ ধর্মের সারমর্ম কী?” সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন।
‘পবিত্রতা’, জানালেন বোধিধর্ম।
সম্রাট তাঁর এই উত্তরে বিশেষ প্রভাবিত হলেন না বরং কিছুটা অসন্তুষ্টই হলেন। বলাইবাহুল্য, সম্রাট বোধিধর্মর শিক্ষার গভীরতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সম্রাটের দরবার ছেড়ে বেরিয়ে এলেন বোধিধর্ম। সেখান থেকে বোধিধর্ম চলে গেলেন উত্তর চিনের সোংশান পর্বতের শাওলিনসির মঠে। শোনা যায়, মঠে পৌঁছে বোধিধর্ম টানা নয় বছর ধ্যানে বসেছিলেন। ধ্যান শেষ হলে তিনি পাড়ি দেন আর এক অচেনার উদ্দেশ্যে।
আরও পড়ুন- মানুষের মস্তিষ্ক খেয়েই বাঁচছে AI! পারমাণবিক বোমার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে রোবটরা?
গ্রাম ছাড়ার পর নিকটবর্তী সীমান্তেই তিনি পেলেন নান-কিং গ্রাম। এক খ্যাতিমান জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেই গ্রামে এক সংকট আসতে চলেছে। বোধিধর্ম তখনই সেই গ্রামে পৌঁছলে ঘটনাচক্রে গ্রামবাসীরা তাঁকেই সংকট ভেবে বসেন এবং গ্রামে ঢুকতে বাধা দেন। বোধিধর্ম সেই সময় কোনও প্রতিবাদ না করেই হাসতে হাসতে গ্রামের বাইরে চলে যান। গ্রামবাসীরা ভাবেন সংকট কেটে গেছে। কিন্তু সেই জ্যোতিষীর কথা মতোই এক মারাত্মক মহামারী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ অসুস্থ হতে থাকে, গ্রামে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মাথা ঘোরা, জ্বর, ফুসকুড়ি জর্জরিত মানুষের ছোঁয়ায় অন্য ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হতে থাকেন। বোধিধর্ম ছিলেন একজন আয়ুর্বেদাচার্য। বিপদ দেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করলেন গ্রামবাসীদের। মহামারী দূর হলে গ্রামবাসীরা বোঝেন সংকট নন, ত্রাণকর্তা হয়ে এসেছেন বোধিধর্ম। আগের ভুল বোঝাবুঝির জন্য ক্ষমা চাইলে বোধিধর্মন তাঁদের ক্ষমা করে দেন, গ্রামবাসীদের বৌদ্ধধর্মে দক্ষ করে তোলেন, আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর পাশাপাশি যোগব্যায়াম, চিকিৎসাবিদ্যা, মার্শাল আর্টেও প্রশিক্ষণ দেন। এরপর বোধিধর্ম বৌদ্ধ শাওলিন মন্দিরে বসবাস শুরু করেন এবং চিনের ধর্মাচার্যদের সমস্ত জ্ঞান বিতরণ করেন। বোধিধর্মর দেওয়া এই শিক্ষার নামই ছিল 'জেন বৌদ্ধধর্ম'।
এইবার তিনি গিয়ে উঠলেন সম্রাট বু-এর সাম্রাজ্যে। গৌতম বুদ্ধ এবং তাঁর প্রচলিত শান্তি বার্তার বিষয়ে প্রজ্ঞা ছিল সম্রাট বু-য়ের। বলাইবাহুল্য গৌতম বুদ্ধ দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিতও ছিলেন তিনি। শোনা যায়, সম্রাট বু রীতিমতো প্রতীক্ষায় ছিলেন চিনে বৌদ্ধ ধর্মের শুরু ও প্রসারের জন্য। কিন্তু চিন্তা ছিল অন্য জায়গায়। কীভাবে ভারত থেকে হিমালয়ের এই দুর্গম পথ পেরিয়ে চিনে প্রবেশ করবেন কেউ! যতদিনে বোধিধর্ম চিনে পৌঁছন, সম্রাটের ততদিনে অনেক বয়স হয়েছে। নিজের একাধিক শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজে বোধিধর্মার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। আসলে সেই সময়ে তীব্র এক মানসিক রোগে ভুগছিলেন সম্রাট। বোধিধর্মার সঙ্গে দেখা হলে নিজের এই মানসিক সমস্যার কথা তাঁকে জানান সম্রাট। বলেন, “আমি অনেক চেষ্টা করেছি, সব রকমভাবে প্রচেষ্টা করে দেখেছি, কিন্তু আমার মন কোনওভাবেই শান্ত হচ্ছে না। আপনি কি আমার মনকে শান্ত করতে পারবেন?”
উত্তরে বোধিধর্ম বললেন, “কোথায় তোমার অশান্ত মন? আমায় দাও আমি শান্ত করে দিচ্ছি।”
এমন সহজ উত্তর পেয়েই সম্ভবত কথা ধরতে পারলেন না সম্রাট বু, সেখানেই নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন। বোধিধর্মা আরও বললেন, “আমি তোমার মন শান্ত করে দিতেই পারি, কিন্তু তার জন্য তোমায় ভোর চারটের সময়ে আমার আঙিনায় পৌঁছাতে হবে, তাও আবার একা। পারবে?”
বোধিধর্মর এমন অদ্ভুত কথায় সম্রাট বু আশ্চর্য হলেন। কিন্তু আর কোনও উপায় না পেয়ে তাঁর দেওয়া শর্ত মেনেও নিলেন। সারারাত সম্রাট দুই চোখের পাতা এক করতে পারেননি। খানিক দুশ্চিন্তা, খানিক কৌতূহল, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। শর্তানুসারে, পরদিন ভোর হতেই সম্রাট বোধিধর্মের চৌকাঠে উপস্থিত হলেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তখন ধ্যানে মগ্ন, সম্রাটের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি চোখ খুললেন, বললেন, “দাও, তোমার অশান্ত মন আমায় দাও।”
আরও পড়ুন- জিও টিভিতে বিশ্বকাপের দফারফা! মোদির ডিজিটাল ভারতের স্বপ্ন কি তবে অধরাই?
সম্রাট এবার ভীষণ বিরক্ত হলেন, বললেন “আশ্চর্য! আমি কীভাবে নিজের অশান্ত মন আপনাকে দিতে পারি, এটা তো আমার মস্তিষ্কের ভিতরে রয়েছে।” স্মিত হেসে বোধিধর্ম এবার উত্তর দিলেন, “সুতরাং, বুঝতেই পারছো তোমার অশান্ত মন তোমার সঙ্গেই আছে, তোমার মধ্যে আছে। এখানে বসে, চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে খোঁজো, দেখবে তুমি তোমার অশান্ত মনকে পেয়ে যাবে।”
সম্রাট সন্ন্যাসীর কথা মতোন চোখ বন্ধ করে, নিজের অশান্ত মনকে খোঁজা আরম্ভ করলেন। নিজের মনে তৈরি হওয়া খেয়াল ভাবতে লাগলেন, যতই ভাবলেন ততই গভীরে যেতে শুরু করলেন। কিন্তু এত করেও অশান্ত মনকে খুঁজে পেলেন না। কয়েক ঘণ্টা এভাবেই কেটে গেল, সূর্যাদয় হলো। এবার সম্রাট নিজের চোখ খুললেন। বোধিধর্ম সম্রাটকে পরেরদিনও ঠিক একই সময়ে উপস্থিত থাকতে বললেন। সন্ন্যাসীর কথা মতোন সম্রাট ফের পরের দিন উপস্থিত হলেন এবং ধ্যান আরম্ভ করলেন। ধ্যানের শেষে অবশেষে তিনি উপলব্ধি করলেন, অশান্তির খোঁজ করতে গিয়ে তিনি অজান্তেই নিজের মনকে শান্ত করে ফেলেছেন।
কথিত আছে যে, বোধিধর্ম আসলে এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পঞ্চম শতাব্দীর শুরুতে একজন ধর্মপ্রচারক-সন্ন্যাসী হিসেবে চিনের মাটিতে পা রাখেন। ভারত থেকে চিনের এই সফর মোটেই সহজ ছিল না, অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। শোনা যায়, রাস্তায় দস্যুরাও পথ আটকে ছিল তাঁর। সমস্ত বাধা পেরিয়ে চিনে পৌঁছেছিলেন বোধি। বোধিধর্মনের মৃত্যু কবে হয়েছিল সে বিষয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তিনি তাঁর চার শিষ্যকে ডেকে নিজের শেষ জ্ঞানটুকু দান করে চলে যান।