বলিউডের প্রথম 'কেচ্ছা'! যে ঘটনা টেকনিশয়ান থেকে তারকা করে তোলে অশোক কুমারকে
Amazon Prime Web Series Jubilee: 'অশোক কুমার’ নাম নিয়ে প্রথম সিনেমাতে আত্মপ্রকাশ কুমুদলালের। দেবিকা রানির বিপরীতে 'জীবন নাইয়া' সিনেমাই অশোক কুমারের জীবনের প্রথম হিট সিনেমা।
হিন্দি চলচ্চিত্র জগৎ। কৌতূহল, আকর্ষণ, গোপনীয়তা, কেচ্ছা এবং একে অন্যকে ফেলে উঠে যাওয়ার দৌড়- বিবিধ কাহিনি মিশে আছে শতবর্ষ প্রাচীন এই শিল্পে। বলিউড নিজেই আস্ত একটা সিনেমা, ঘটমান চলচ্চিত্র। মাঝে মাঝে নিজেরই জলে নিজের স্নান সেরে নেয় সে। হিন্দি সিনেমার ইতিহাস থেকে উঠে আসে বর্তমানের সিনেমা-সিরিজের কাহিনি। প্রাইম ভিডিওতে সম্প্রতি পরিচালক বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানের নতুন ওয়েব সিরিজ 'জুবিলি' অভিনয়, পিরিয়ড ড্রামার নকশা, পোশাক, বিষয়ের সূক্ষ্মতা নানা বিষয়ে দর্শকদের পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে। অথচ অনেকেই জানেন না, এই সিরিজের বিষয়টির জন্য বিক্রমাদিত্য ঋণী বলিউডেরই কাছে। অপারশক্তি খুরানা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অদিতি রাও হায়দারি, সিদ্ধান্ত গুপ্ত, ওয়ামিকা গাব্বির প্রতিটি চরিত্রের নেপথ্যে রয়েছেন ভারতীয় হিন্দি সিনেমার প্রাচীন কিছু মুখ, রয়েছে প্রাচীন নানা রহস্যও।
জুবিলি সিরিজটির মূল চরিত্র রয় টকিজের বিখ্যাত প্রযোজক শ্রীকান্ত রায় (অভিনয়ে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়), তাঁর তারকা স্ত্রী সুমিত্রা কুমারী (অদিতি রাও হায়দারি), উঠতি অভিনেতা জামশেদ খান (নন্দীশ সান্ধু), রয় টকিজের ল্যাব টেকনিশিয়ান বিনোদ দাস (অপারশক্তি খুরানা) সকলেই আসলে হিন্দি সিনেমা জগতে ঘটা প্রথম এক 'স্ক্যান্ডালের' চরিত্র। সুমিত্রা কুমারীর সঙ্গে জামশেদ খানের প্রেম বিষয়টিকে শেষ করে সব কিছু ঠিক করার দায়িত্ব দেওয়া হয় বিনোদ দাসকে যাতে প্রযোজক শ্রীকান্ত তাঁর আসন্ন ছবিতে জামশেদ খানকে মদন কুমার হিসাবে তুলে ধরতে পারেন। যারা হিন্দি সিনেমা নিয়ে অল্প বিস্তর চর্চা করেন তারা জানেন, শ্রীকান্ত রায়ের চরিত্রটি পুরনো দিনের চলচ্চিত্র প্রযোজক হিমাংশু রায়ের জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এবং রয় টকিজ হচ্ছে বোম্বে টকিজ, ভারতের প্রথম ফিল্ম স্টুডিও।
আরও পড়ুন- পর্দায় প্রথম চুম্বনদৃশ্য, অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন নেহরু || আজীবন বিতর্কিত ছিলেন দেবিকা রানি
শ্রীকান্তের তারকা স্ত্রী সুমিত্রা কুমারী আসলে হিমাংশু রায়ের স্ত্রী দেবিকা রানি, ৩০ এবং ৪০-এর দশকের চলচ্চিত্র তারকা ছিলেন দেবিকা। সাল ১৯৩৫, হিমাংশু 'জওয়ানি কি হাওয়া' নামে প্রযোজক হিসাবে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র তৈরি করছিলেন। এই চলচ্চিত্রে নায়িকা ছিলেন হিমাংশুর তারকা স্ত্রী দেবিকা। দেবিকার বিপরীতে নাজমুল হাসান নামে একজন নতুন অভিনেতাকে নিয়ে আসেন তিনি। ভাইচাঁদ প্যাটেল তার বই ‘Bollywood’s Top 20: Superstars of Indian Cinema’-এ লিখেছেন, লখনউয়ের রাজপরিবারের বংশধর, লম্বা সুপুরুষ যুবক নাজমুল বোম্বে টকিজের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবিতেই সই করেছিলেন। নাজমুল হাসান আইন বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন, কিন্তু শেষ করার আগেই তিনি চলে যান তৎকালীন বোম্বেতে। সেখানেই হিমাংশুর সঙ্গে দেখা। প্রথম চলচ্চিত্রটি ব্যাপক হিট হয়। 'জীবন নাইয়া' নামে এই জুটিকে নিয়েই দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের শ্যুটিং শুরু করেন হিমাংশু। সিনেমা চলাকালীন দেবিকা রানি আর নাজমুল হাসান প্রেমে পড়েন এবং পালিয়ে যান।
ব্যক্তিগত এবং পেশাদারি জীবনে এমন আঘাত ছিল হিমাংশু রায়ের কাছে অপ্রত্যাশিত। হিমাংশুকে সেই সময় সামলান তাঁর স্টুডিওর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (পরবর্তীকালে তাঁকে চিনব অভিনেত্রী কাজলের ঠাকুরদা হিসেবে) শশধর মুখোপাধ্যায়। কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেল অবধি দেবিকা এবং নাজমুলের পিছু নেন শশধর। তারকা অভিনেত্রী দেবিকাকে নাজমুলের সঙ্গে এই সম্পর্ক শেষ করতে এবং স্বামী হিমাংশুর কাছে ফিরে যেতে রাজি করিয়েছিলেন শশধর।
দেবিকা রানি ফিরে আসেন ঠিকই, কিন্তু হিমাংশু রায় নাজমুল হাসানকে ওই চলচ্চিত্র থেকে বাদ দিয়ে দেন। 'জীবন নাইয়া' চলচ্চিত্রটির কাজ শুরু হয় ফের একদম প্রথম থেকে। সুতরাং দরকার পড়ে প্রধান চরিত্রে এক নতুন অভিনেতার। ফের হিমাংশু রায়ের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন শশধর। তাঁর শ্যালক কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম সুপারিশ করেন তিনি। কুমুদ তখন বোম্বে টকিজেই ল্যাব টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতেন।
হিমাংশু রায় কুমুদলালকে নায়ক হিসেবে নিয়ে আসতে চাইলেও ছবির পরিচালক জার্মানির ফ্রাঞ্জ ওস্টেন রাজি হন না মোটেও। তিনি জানান, হিরোসুলভ চেহারাই নয় কুমুদের। এত সাধারণ দেখতে একজন নায়ক কীভাবে হতে পারেন! যাইহোক, হিমাংশু রায়ের পীড়াপীড়িতে শেষ অবধি তিনি রাজি হন। কুমুদলাল নিজেও ক্যামেরার মুখোমুখি হতে আগ্রহী ছিলেন না কিন্তু শশধর তাঁর শ্যালককেও রাজি করিয়ে নেন।
আরও পড়ুন- ‘সৃষ্টির তাড়নাই আমার কাছে যৌনতা’, বলেছিল প্রসেনজিৎ
তবে কুমুদলাল নামে চলবে না। সিনেমাতে প্রয়োজন অন্য নাম, 'অশোক কুমার’ নাম নিয়ে প্রথম সিনেমাতে আত্মপ্রকাশ কুমুদলালের। দেবিকা রানির বিপরীতে 'জীবন নাইয়া' সিনেমাই অশোক কুমারের জীবনের প্রথম হিট সিনেমা। ওই একই বছরে, তাঁদের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র 'অছ্যুত কন্যা' মুক্তি পায় যা ব্যাপক হিট হয় এবং রাতারাতি তারকা হয়ে ওঠেন অশোক কুমার।
জীবন নাইয়া সিনেমার মূল নায়ক, নাজমুল হাসান কলকাতায় ফিরে আসেন। বিএন সরকারের নিউ থিয়েটার্সে যোগ দেন। পৃথ্বীরাজ কাপুর এবং কেএল সায়গলের মতো তারকা তখন কাজ করেন নিউ থিয়েটার্সে। তবে বেশিরভাগ সিনেমাতেই নায়ক হতে পারেননি নাজমুল। দেশভাগের পরে পাকিস্তানে চলে যান তিনি, সেখানে চলচ্চিত্রেই কাজ করতে থাকেন কিন্তু তাঁর জায়গায় উঠে আসা অশোক কুমার যে সাফল্য এবং খ্যাতি পেয়েছিলেন তা কখনই পাননি নাজমুল। নাজমুল পৃথ্বীরাজ কাপুরের 'অনাথ আশ্রম' (১৯৩৭) এবং কেএল সায়গলের 'দুশমন' (১৯৩৮) এর মতো ছবিতে কাজ করেছিলেন। ভারত ভাগের আগে নাজমুলের শেষ ছবি ছিল মীনাক্ষী (১৯৪২)।
জুবিলি সিরিজে অপারশক্তি খুরানার চরিত্রটি শশধর মুখোপাধ্যায় এবং কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে অশোক কুমারের সংমিশ্রণ। শ্রীকান্ত রায় এখানে হিমাংশু রায়, সুমিত্রা কুমারী হচ্ছেন দেবিকা রানি এবং জামশেদ খান হলেন নাজমুল হাসান। সব চরিত্র মোটেও কাল্পনিক নয়, সব ঘটনাও না। বিক্রমাদিত্যের এই সিরিজে বলিউডের সেই প্রথম পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন উঠে আসে, যা না এলে অশোক কুমারের উত্থান ঘটত না, নাজমুলের মতো অভিনেতাও হারিয়ে যেতেন না।