একের পর এক হিট, তবু কেন গান লিখতে চাননি বলিউডের বিদ্রোহী কবি কাইফি আজমি?

Kaifi Azmi: ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর লিখেছিলেন দীর্ঘ কবিতা “রাম কি দুসরি বনবাস” নামে। সবাই প্রকাশ করতে মানা করেছিল। তবুও, বড্ড একগুঁয়ে ছিলেন লোকটা।

ছেলেবেলা থেকেই বিদ্রোহী তিনি। শোনা যায় স্কুলে মাস্টারমশাই গালে চড় মারলে নিচে না তাকিয়ে সোজা মাস্টারের চোখের দিকে তাকাতেন। মার বাড়ত। মাথা ঝুঁকত না। কে জানত এককালে সেই মাথা ঝোঁকানোকে সম্বল করেই অমর হবেন তিনি! কাইফি আজমির জীবন এক বিদ্রোহীর। যিনি চিরকাল মনেপ্রাণে এক বিপ্লবী কবি হতে চেয়েছিলেন। নিজেকে সেই নামেই পরিচয় দিতেন। আর তাই প্রায় স্বেচ্ছায় নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন গীতিকার কাইফি আজমিকে। বন্ধু সাহির লুধিয়ানভি যখন একের পর এক গানকে প্রায় নিজের একান্ত বিশ্বাসের এজেন্ডা বানিয়ে লিখে চলেছেন, “না মুহ ছুপাকে জিও/ না শর ঝুঁকাকে জিও” কিংবা “আল্লাহ তেরো নাম”-এর মতো কাল্ট হয়ে যাওয়া গান, আজমির কবিতা আর গান কখনই কাব্যিক ভাবনাকে ছাপিয়ে যায় না। কী বলতে চাইয়ের থেকেও বড় হয়ে ওঠে কীভাবে বলতে চাই?

মাত্র এগারো বছরে জীবনের প্রথম গজল লিখে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন একদিকে সক্রিয় কমিউনিস্ট পার্টির কাজ, আর অন্যদিকে কবিতা লিখেই জীবন কাটিয়ে দেবেন। সিনেমার গান লেখাটাকে কোনওদিনই দরের কাজ মনে করতেন না। কিন্তু পেটের বড় দায়। শৈলেন্দ্রর মতো তিনিও বাধ্য হলেন স্টুডিও পাড়ায় ঘুরতে। খুব বেশি কিছু আশা ছিল না। কী জানি এই তরুণের মধ্যে কী দেখেছিলেন শচীন কত্তা। গুরু দত্তের জীবনের সবচেয়ে ডার্ক ছবি “কাগজ কে ফুল” তৈরি হচ্ছে। সেই ছবির সবচেয়ে ইন্টেনস এক দৃশ্য এগিয়ে চলবে শুধু গানে। একেবারে আনকোরা কাইফিকে সে গান লেখার দায়িত্ব দিলেন বর্মন সাহেব। আর কী গানই না লিখলেন কাইফি। প্রায় অন্ধকার স্টুডিও, স্পট লাইট আর গীতা দত্তের মাদকতাভরা গলায় গাওয়া “ওয়ক্ত নে কিয়া ক্যায়া হাসিন সিতম” ভারতীয় ছবির অন্যতম সেরা কাল্ট গান হয়ে রয়েছে আজও। জীবনের শেষ দিকে কাইফি নিজেও স্বীকার করেছিলেন, এই একটা গানের জন্য তিনি গর্ববোধ করবেন চিরকাল। গান কাল্ট হল কিন্তু গীতা-গুরু-ওয়াহিদা-শচীনে ঢাকা পড়ে গেলেন কাইফি। তাঁর জীবনে সেই প্রথম। তবে সেই শেষ না।

আরও পড়ুন- ডুবন্ত সুরাইয়াকে বাঁচিয়েছিলেন তিনিই, তবু দেব আনন্দকে খুন করতে চেয়েছিল পরিবার…

এই গান শুনেই খৈয়াম কাইফিকে ডেকে নিলেন আরও কিছু নতুন গানের জন্য। কাইফি বুঝলেন তিনি জড়িয়ে পড়ছেন। তবু “শোলা অউর শবনম” ছবির জন্য লিখলেন “জানে ক্যায়া ঢুন্ডতি রহতি হ্যায়”। এবার হিট রফি- ধর্মেন্দ্র। ১৯৬২-র চিন ভারত যুদ্ধ নিয়ে চেতন আনন্দ ছবি করলেন। হকিকত। সুপার ডুপার হিট সেই ছবিতে রফি দরদভরে গাইলেন “কর চলে হাম ফিদা জান-ও-তন সাথিয়োঁ”। কথা কাইফি আজমি। সেই প্রথম কাইফির নাম জনগণের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। কিছুদিন পরেই হেমন্ত মুখুজ্যে তাঁর ‘অনুপমা’ ছবির জন্য কাইফিকেই বেছে নিলেন। কাইফি লিখলেন বাবার ভালবাসা না পাওয়া এক মেয়ের বুক ভাঙা কান্নার গান, “কুছ দিল নে কাহাঁ কুছ ভি নেহি”। লতার মায়াবী কণ্ঠে সেই গান ভারতের সব মেয়ের অভিমানের গান হয়ে উঠল অচিরেই।
হকিকতের সাফল্যের পর চেতন আনন্দ, মদন মোহনের সঙ্গে ট্রায়ো হিসেবে কাইফি আজমির নাম করা হতো। ১৯৬০ থেকে ৭০- এই দশ বছর হিন্দি ছবিতে রাজত্ব করেছিলেন এই ত্রয়ী। হীর রাঞ্ঝা ছবির গোটা স্ক্রিপ্ট কাইফি লিখলেন ছন্দে। মদন মোহনের সুরে রফি মাতিয়ে দিলেন “ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল মেরে কাম কি নেহি”। রাতারাতি দিলীপ কুমারকে টক্কর দিয়ে ট্রাজেডি কিং হিসেবে উঠে এলেন রাজকুমার। চারিদিকে জয়জয়কার। কাইফি তবু খুশি হতে পারছিলেন না। বারবার তাঁর ভিতরের চরম বামপন্থী সত্ত্বা বিদ্রোহ করে উঠত। ইচ্ছে করে ছেড়ে দিতেন হাতে আসা অফার। ডুবে যেতেন নিত্য নতুন গজল লেখায়। একদিন বন্ধু মদন মোহন এলেন তাঁকে বোঝাতে। কাইফি অনড়। তাঁর আর সিনেমার গান লিখতে ভালো লাগছে না। মদন মোহনও ছাড়বার পাত্র নন। বললেন “দেখি কী লিখেছ?”। কবিতার খাতা খুলে দিলেন কাইফি। সেই গজল থেকে পছন্দের একটা বেছে নিয়ে তাতে সুর করে লতাকে দিয়ে গাইয়ে মদন মোহন ব্যবহার করলেন “হাসতে জখম” ছবিতে। সেই গান “আজ সোচা তো আঁশু ভর আয়ে/ মুদ্দতে হো গয়ি মুস্কুরায়ে” এখন সর্বত্র ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত।

না চেয়েও হিন্দি ছবির গান কাইফিকে ছাড়ছিল না। তবু তিনি আপ্রাণ দূরে থাকতে চাইতেন সিনেমার গান লেখা থেকে। অনেক ধরে বেঁধে সত্তরের শেষের দিকে গুলাম মহম্মদ তাঁকে দিয়ে নতুন সিনেমার গান লিখাতে চাইলেন। এই সিনেমায় নাকি গান কথার চেয়েও বেশি জরুরি। হিন্দি সিনেমার সেরা গীতিকাররা একত্র হয়েছেন এখানে। মজরু সুলতানপুরী, কামাল আমরোহি, কাইফ ভোপালি, মীর তাকি মীর। কাইফি না থাকলে ব্যাপারটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কী আর করা। অতএব আবার তিনি নিমরাজি হয়ে সিনেমার কুড়িটা গানের মধ্যে তিনটে লিখে দিলেন। সেই ছবি 'পাকিজা' রিলিজের পর রাতারাতি মীনা কুমারী নায়িকাদের মধ্যে একেবারে এক নম্বরে। সবার মুখে মুখে ফিরতে লাগল লতার গাওয়া “চলতে চলতে”। সিনেমার সব চেয়ে হিট গান। কাইফির সেই তিনটের একটা। অন্য দুটো “কৌন গলি গয়ো শ্যাম” আর “নজরিয়াঁ কি মার”।

আশির দশকের একেবারে শুরুতে মহেশ ভাট নামে এক নতুন পরিচালক তাঁকে পাকড়াও করল। সে কোনও কথাই শুনবে না। তাঁর নতুন ছবিতে কাইফি সাবকেই গান লিখতে হবে। নিজের চিরাচরিত স্টাইল একেবারে ভেঙে ‘অর্থ’ ছবির প্রতিটা গান লিখলেন তিনি। সেই সিনেমা ঘুচিয়ে দিল আর্ট আর কমার্শিয়াল ছবির এতদিনের ফারাক। সবাই নতুন করে আবিষ্কার করল শাবানা আজমি নামে এক অভিনেত্রীকে। ১৯৮৩ সালের সব ক'টা বেস্ট অ্যাকট্রেস পুরস্কার কাইফির মেয়ের জন্যেই যেন রাখা ছিল। এবং পঞ্জাব থেকে আসা এক নতুন সুরকার জগজিৎ সিং। কী অপরূপ সুর আর গায়কিতে মাতোয়ারা করে দিলেন তিনি। আজও কাইফির লেখা সেই তিনটে গান “ঝুঁকি ঝুঁকি সি নজর, দিল মে প্যায়ার হ্যায় কে নেহি”, “কোই ইসে ক্যায়সে বাতায়ে” আর “তুম ইতনা জো মুসকুরা রহে হো”-কে সবাই জগজিৎ সিংয়ের গান বলেই জানেন, মানেন। কাইফি আবার শাবানা-মহেশ-জগজিতের আড়ালে চলে গেলেন। যেমন যেতেন।

আরও পড়ুন- চারশো টাকা না পেলে হাসপাতাল থেকে ফিরত না স্ত্রী! যেভাবে আমজাদ খান হলেন গব্বর সিং

কাইফির শেষ জীবন খুব একটা সুখের সময় নয়। আনন্দের সময় নয়। ধর্মে ধর্মে হানাহানি, রক্তপাত তাঁকে ভিতর ভিতর আহত করছিল। বলিউডের চকচকে জীবনকে কোনওদিন আপন করে নিতে পারেননি তিনি। পারলে কী হত জানি না, তবে গান লেখাটা সিরিয়াসলি না করেই এই! সিরিয়াসলি করলে কী হত, ভাবলে আফসোস হয়। কিংবা হয় না। হয়তো এই বিশ্বজোড়া বাজারের দাপটে দুই একজন কাইফিকে সত্যিই দরকার যারা চিরটাকাল এই খ্যাতি, সেলেব স্ট্যাটাস আর স্পটলাইটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের শর্তে বেঁচেছেন। ‘গরম হাওয়া’ ছবির চিত্রনাট্য আসলে কাইফির দর্শনের কথাই বলে। “ওটাই আসল আমি,” বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর লিখেছিলেন দীর্ঘ কবিতা “রাম কি দুসরি বনবাস” নামে। সবাই প্রকাশ করতে মানা করেছিল। তবুও, বড্ড একগুঁয়ে ছিলেন লোকটা। গোটা মুম্বইতে তখন জাতিদাঙ্গা চলছে। সবাই জানে তিনি সফট টার্গেট। মেয়ে শাবানা অবধি হাতে পায়ে ধরছেন “পালিয়ে এস আব্বা”। তিনি এক মুহূর্তের জন্য তাঁর জুহুর জানকী কুটির থেকে নড়েননি। “সেটা করলে আমার সারা জীবন যে আদর্শ নিয়ে বেঁচে আছি, সেটাকে খুন করতে হতো। আর সেটা খুন হলে আমার বেঁচে থাকার অর্থ কী?”

এরও এক দশক পর, ক্লান্ত, অসুস্থ কাইফিকে গুজরাতের দাঙ্গাও দেখতে হলো। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি লিখলেন নিজের মনে কথা। তাঁর বই 'মেরি আওয়াজ শুনো'। তাঁর সোয়ান সং। ১০ মে, ২০০২, এক উন্নততর ভারতের স্বপ্ন বুকে নিয়ে চলে গেলেন কাইফি আজমি। বলিউডের বিদ্রোহী কবি।

More Articles