প্রচ্ছদ কি আসলে এক চিত্রকর্ম? উত্তর দেবে শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্তের অভাবনীয় যে কীর্তিরা

Subodh Dasgupta Illustration :সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস 'আত্মপ্রকাশ'-এ ভাঙাচোরা জ্যামিতিক মোটিফ ব্যবহার করে মানবী শরীর আত্মপ্রকাশ করে।

SP

প্রচ্ছদ কি শুধু বইয়ের মলাট? সিনেমার পোস্টার কি শুধুই বিজ্ঞাপন প্রচারের কৌশলমাত্র? প্রচ্ছদ বা পোস্টারকে শিল্পকর্ম বলা যায় কিনা এই নিয়ে বহু যুগের তর্ক রয়েছে। শিল্প বাণিজ্যিক হলে তা শিল্প থাকে কিনা সেই নিয়েও তর্ক রয়েছে। তবে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের ওয়েস্ট গ্যালারিতে গত ৮ থেকে ১৪ অক্টোবর সুবোধ দাশগুপ্তের নির্বাচিত শিল্পকর্মের যে প্রদর্শনী আয়োজিত হলো, তা এই তর্ক, এই প্রশ্নের অনেকখানি উত্তর দিয়ে দেয়। আকাদেমিতে কোনও চিত্রশিল্পী নয়, শুধুমাত্র অঙ্কনশিল্পী বা ইলাস্ট্রেটরের বাণিজ্যিক কাজের প্রদর্শনী সাধারণত দেখাই যায় না। এক্ষেত্রে সুবোধ দাশগুপ্তের ছকভাঙা ইলাস্ট্রেশনের মতোই তা চমকপ্রদ। প্রদর্শনীতে সুবোধ দাশগুপ্তের ইলাস্ট্রেশনরা কথা বলে, দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। অমোঘ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে বলে, ভাবতে বলে, "এভাবেও ভাবা যায়?"

গ্যালারিতে ঢোকার মুখেই ডানদিকে বা দু'দিকেই বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে শুরু। সুবোধ দাশগুপ্তের করা অজস্র প্রচ্ছদের থেকে বাছাই করা শ'খানেক প্রচ্ছদ! দেখতে দেখতে শুধুমাত্র শিল্পভাবনা না, কিছু নস্টালজিয়াও আচ্ছন্ন করে দেয় মনকে। ভোলগা থেকে গঙ্গার দু'মলাট জুড়ে থাকা ছবি যেন গুহার দেওয়াল জোড়া প্রাগৈতিহাসিক ছায়াতে মানুষের অঙ্কনরীতিকে অনুসরণ করে বিবর্তনের কাহিনি। মাত্র দু' রঙে করা, রিভার্স গ্রাউন্ড থেকে সাদা বের করে এনে তাতে বই এবং লেখকের নাম সামান্য তেরছা করে রাখা। পাঠকের চোখ প্রথমেই চলে যায় বইয়ের নামে, প্রচ্ছদের মূল উদ্দেশ্য সাধিত হয় সেখানেই। প্রফুল্ল রায়ের নদীর মতো কভারে নদীর স্রোতের মতোই ভেসে চলে বইয়ের নাম, যেন নৌকা বা জলেরই অংশ।

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস 'আত্মপ্রকাশ'-এ ভাঙাচোরা জ্যামিতিক মোটিফ ব্যবহার করে মানবী শরীর আত্মপ্রকাশ করে। এরকম অজস্র ছকভাঙা, বিমূর্ত অবয়ব দিয়ে গড়ে ওঠা প্রচ্ছদ চোখ আটকে দেয়। দেখিয়ে-শিখিয়ে-চিনিয়ে-পড়িয়ে দেয় উপন্যাস বা কবিতার মর্মগাথাকে, প্রথম দর্শনেই।

আরও পড়ুন- “থিও ভ্যান গঘ: ১৮৫৭-১৮৯১” – অচেনা বই, অচিন এক জীবনের খোঁজ

সমরেশ মজুমদারের 'দৌড়', শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'কুবেরের বিষয় আশয়', 'বৃহন্নলা', মতি নন্দীর 'দ্বাদশ ব্যাক্তি', কৃষ্ণা দত্তর 'ইংলিশ চ্যানেল', কালকূটের 'নির্জন সৈকতে', বুদ্ধদেব বসুর 'তপস্বী ও তরঙ্গিনী' (কোণারকের চুম্বনরত মিথুন মূর্তির ব্যবহার, তার সঙ্গে বইয়ের নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ক্যালিগ্রাফি), সমরেশ বসুর 'গঙ্গা' (ন্যারেটিভের সঙ্গে পুরাণ কাহিনির মেটামরফোসিস), আপ্টন সিনক্লেয়ারের অয়েলের তরলতা তৈলাক্ত লেটারিং, সংস্কৃত সাহিত্যসম্ভার, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'পঞ্চাননের হাতি' (যেখানে হাতির শুঁড়ের মতোন পাকানো বিশাল বড় করে বইয়ের নাম লেখা), জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর শ্রেষ্ঠ গল্প, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'যাও পাখি'– প্রচ্ছদ বই বা লেখকের নাম বাদ দিয়েও মৌলিক শিল্পকলা বা পেইন্টিং হয়ে ওঠার দাবি রাখে। একজন বাণিজ্যিক শিল্পীর চোখ এবং ছাপার পদ্ধতির জ্ঞানের দক্ষতার মিশ্রণ এই অজস্র বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ- যা বেশিরভাগ সময়েই হারিয়ে যায়।

এরপর গ্যালারির চার দেওয়াল জুড়ে ঝুলতে থাকা ইলাস্ট্রেশনের দিকে চোখ যায়, ঢুকে পড়া যায় এক আশ্চর্য জগতে। পত্রিকায় দেখা গল্প বা উপন্যাসের সঙ্গে ইলাস্ট্রেশন আলাদা করে বড় মাপের ফ্রেমে বাঁধানো এক একটা ছবি। কী নিপুণ দক্ষতায়, ভাবনায়, বিভিন্ন মিডিয়াম ব্যবহার করে তা করা, সহজেই বোঝা যায়। আবারও ধরা পড়ে বাস্তবধর্মী ইলাস্ট্রেশনের সঙ্গে বিমূর্ত চিত্রায়নের দক্ষতা। গল্পের ইলাস্ট্রেশন দেখে মনে আসতে থাকে সেই কবেকার পড়ে আসা গল্পের কাহিনি, নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হতে হয়। আর এখানেই শিল্পীর সার্থকতা, তাঁর কাজের উত্তরণ।

একদম অন্যধারার, ছক ভাঙা কৌশলে, ভাবনায় সুবোধ দাশগুপ্তের এই অঙ্কনরীতি। নন্দগুপী লীলা মজুমদার সলিড কালোর ব্যবহার, ম্যাকের বাবা খ্যাঁকের লাইন, ক্রিসকস আর স্পিচ বাবল দিয়ে কাজ, পিকলুর সেই ছোটকায় ভারী আউটলাইনের ব্যবহার, সুশীল রায়ের রাজার ইলাস্ট্রেশনে মোটা ড্রাই ব্রাশের টানে আর সামান্য আঁচড়ে বিমূর্ততা কত সহজ সাবলীলভাবে বাস্তবে এনে ফেলা যায় তার প্রমাণ থেকে যায়। বজরার মোটা কাঠখোদাইধর্মী আঁকা, হঠাৎ আলো, বিমল করের সাইকেল চালানোর তুলি টেনে গতির চিত্রায়ন বা গঙ্গার ছবির সেই তুলির টানেই জলের গতি ইলাস্ট্রেটরের অপরিসীম দক্ষতা প্রমাণ করে। আর বাকরুদ্ধ হতে হয় যখন পুরো পাতার লে-আউট বা উপন্যাস, গল্পের শুরুর পাতার ছবির ফ্রেমের সামনে দাঁড়াতে হয়। এখানেই ইলাস্ট্রেটরের চরম কৃতিত্ব বা দক্ষতার পরিচয়।

দেশ ১৯৬৮-তে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'দোসর', দেশ ১৯৬৫-তে প্রতিভা বসুর 'অর্কেস্ট্রা', শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯৬২-তে বিমল করের 'গগনের অসুখ', দেশ ১৯৬৩-তে রাজলক্ষ্মী দেবীর 'তোমার অনুমতি নিয়ে'-তে সাদা স্পেস এবং চরিত্র আর গল্পের নামের কোণাকুণি প্লেসমেন্টের ভারসাম্য দেখার মতো কাজ।

রঙিন কাজ, বিশেষ করে ছোটদের জন্য করা ছড়ার ইলাস্ট্রেশনে রঙের সামান্য মার্জিত ব্যবহার চোখ আটকে রাখে অথচ তা আবার ছোটদের মনেও কল্পনাকে বাস্তবায়িত করে।

আরও পড়ুন- এঁকেছিলেন সংবিধানেরও ছবি! সহজ পাঠের আড়ালে অজানা নন্দলাল বসু…

অসামান্য কিছু মাস্টহেড বা গল্পের হেডপিসের মধ্যে চমকে দেয় 'অধিকাংশ ড্রাইভারই মাতাল' (অনন্যা ১৯৫৮)। শুধুমাত্র লাইনে কয়েকটা গাড়ি একে অপরের মধ্যে দিয়ে ওভারল্যাপ করে যায়- মাতালের চোখের দেখার মতোই। ফ্লিন্ট স্ট্রিটের গল্পের লাইটপোস্টে নামলিপি, মার্কিন-নামাতে টুপির মধ্যে লেখা নাম, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের 'অস্থি', অজয় দাশগুপ্তের 'হাওয়া' এরকম আরও অনেক অনেক মনকাড়া কাজ।

সঙ্গে বাড়তি পাওনা রঙিন কাজ সিনেমার প্রচারপত্রের কভার, লে-আউট- 'অনুষ্টুপ ছন্দ' এবং 'রাজদ্রোহী'। দুটো প্রচ্ছদের লোগোধর্মী লেটারিংয়ে নামলিপি এবং নায়ক নায়িকার মুখের ছবির প্লেসমেন্ট, রঙ ব্যবহার চমৎকৃত করে।

সুবোধ দাশগুপ্তের এই নির্বাচিত শিল্পকর্মের প্রদর্শনী চোখ খুলে দেয়। ইলাস্ট্রেশনকে অন্যভাবে দেখার-বোঝার-শেখার জন্য বাণিজ্যিক চিত্রকর্মও যে শিল্পের উচ্চতায় উঠতে পারে তা প্রমাণ করে। প্রমাণ করে, প্রয়োগ নৈপুণ্যতার দক্ষতায় এবং প্রকাশনা শিল্পের, ছাপার জগতের কৌশলের সুষ্ঠু ব্যবহারে শিল্পকে নতুন করে চেনার অবকাশ রয়ে গেছে এখনও। এটাই শিল্পীকে মনে রেখে দেবার অধিকার আমাদের। অজস্র ধন্যবাদ শিল্পীর পরিবারকে, যারা অপরসীম মমত্ত্ব এবং শ্রদ্ধায় তাঁর কাজকে এত যত্ন করে সাজিয়ে সুন্দর করে দর্শকদের কাছে উপস্থাপিত করেছেন।

More Articles