মগের মুলুক: ক্ষমতা-রাজনীতির চেনা ছবি অচেনা মোড়কে
Book Review: বিশ্বজিৎ রায়ের 'বারবার মগের মুলুক' (মান্দাস, ২০২২) বইয়ে ধরা রয়েছে শাসকের একেবারে অন্য চেহারা।
বিশ্বজিৎ রায়ের 'বারবার মগের মুলুক' (মান্দাস, ২০২২) বইয়ের উপশিরোনাম "একটি সম্পূর্ণ ‘অরাজনৈতিক’ না-নাটিকা"। এহেন উপশিরোনাম বক্রোক্তি হিসেবে পড়া হলে তা নেহাত ক্লিশেমাত্র। উপশিরোনামের প্রতিটি শব্দই কিছু প্রকার-প্রকরণগত দাবি নিয়ে উপস্থিত হয় পাঠকের সামনে। আমরা আপাতত ‘রাজনৈতিক নাটক’ অভিধা দিয়েই কাজ চালাব। বানান করে বলে দেওয়ার দরকার পড়েনি কোথাও, নাটকের ঘটনাক্রমের স্থান-কাল-চরিত্র সবই প্রকৃতপক্ষে আমাদের চেনা। যে মুলুকে ঘটনাক্রম এগিয়ে চলে, যার খণ্ডচিত্রর দৃশ্যাকার সমন্বয়ে নাটক সম্পূর্ণ হয়, সেই মগের মুলুকে জেলখানা আছে, আছে লোকসভাও। তিনরকম চরিত্রের মাধ্যমে এই দুই স্থানের মধ্যে সংযোগ সাধিত হয়: পুলিশ-সেনা-টহলদার, জেলখানার আগন্তুক ও কয়েদি, শাসক ও তার অনুগামী। নাটকটি বেশ কিছু রূপকের সাহায্য নেয় প্রায়ই, কখনও একেবারে রোজকার বাস্তবজগৎ থেকে সটান কিছু উল্লেখ, লব্জ উদ্ধৃত করে দেয়, কখনও সাধারণ সংলাপের মাধ্যমে দুই জগতের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে চায়। আবার বাস্তবের সঙ্গে সংযোগকে ক্রমাগত প্রতিহত করে চলার প্রয়াসও লক্ষণীয় পাঠকৃতির বিভিন্ন পরতে। একই কারণে, নাটকের শাসককে আগাগোড়া বাস্তবের শাসকদের চর্চিত কোনও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যমালার অনুকরণে ছেনে বসানোর সহজ হাতছানি এড়িয়ে যান নাট্যকার। স্রেফ সস্তা প্যারোডির রাস্তায় হাঁটেন না তিনি।
এই নাটকের মুখ্য উপাদান সংলাপ। কিছু বর্ণনা, অভিব্যক্তির আবশ্যিক নির্দেশ যেমন থাকার, থাকলেও কার্যত চরিত্রদের মুখের কথাবার্তাই নাটকের তিনটি দৃশ্যের গঠনগত একক। আঙ্গিকগত বাহার নিয়ে বিশ্বজিৎ রায় খুব চিন্তিত নন। সংলাপের সূত্রে একটা জগতের নির্মাণ- নাট্যকার সন্তুষ্ট এই সাদামাটা প্রকল্পেই। প্রতিটি দৃশ্যের অব্যবহিত আগে, সংলাপ থেকেই সরাসরি উদ্ধৃত, সচিত্র তিনটি অভিলেখ এই জগতের চরিত্র-নির্দেশক। প্রসঙ্গত, পাঠক সুনিশ্চিতভাবেই ভাববেন, মঞ্চ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে দৃশ্যের সম্পূরক হিসেবে অভিলেখের প্রয়োগ-সম্ভাব্যতা নিয়ে।
আরও পড়ুন: ‘প্রেম অতি হাস্যকর বস্তু’, কেন এমনটা মনে করতেন রাজশেখর বসু
ক্ষমতার কুর্সি, শাসকের গদিকে 'মগ' হিসেবে উল্লেখ প্রথম দৃশ্যের আগে, প্রথম অভিলেখের ক্ষেত্রে চিত্রসহ যেভাবে আসে, সংলাপের সূত্রে পুনরায় যার মুখোমুখি হন পাঠক, দ্বিতীয় দৃশ্যের সূচনা হয় সেই চিত্ররই সরাসরি দৃশ্যায়ন সহকারে। লোকসভা কেন্দ্রে বসে থাকা শাসকের পর্দার পিছনে পাঠক তথা দর্শক আবিষ্কার করেন মগভর্তি জলের ছবি। ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গিয়েছি,
মগ থেকে যেমন জল ছিটকে পড়ে, মাটি ভিজিয়ে জল হারিয়ে যায়, তেমনি করে আগের সরকারের প্রধান কুর্সি থেকে ছিটকে পড়ে মাটি রক্তে ভিজিয়ে হারিয়ে গেল।
নাট্যকারের চোখে ক্ষমতা স্রেফ পীড়নের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। নাটকের আগাগোড়াজুড়ে একটি চিন্তা বারবার নিঃশব্দে উচ্চারিত হয়: ক্ষমতা কেবল নিষেধমূলক, প্রতিষেধাত্মক নয়। তা তোয়াজ করে, 'সন্মান' দেয়, নতজানু হয়। ক্ষমতার কুর্সি মগের মতো, আর ক্ষমতার মুখ জলের মতো। জল চলকে যাওয়ার মতো করেই ক্ষমতার মুখ, রং, নাম বদলায়।
শাসক ও অনুগামীদের দেখা যায় কেবল দ্বিতীয় দৃশ্যে। তীক্ষ্ণ আয়রনির মোড়কে নাট্যকার শাসকের মুখেই রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে অমোঘ সত্যি উক্তিটি বসিয়ে দেন- “যে কোনও নৌকাই আসলে দলা পাকিয়ে যায়। যে কোনও দল, যাকে মনে হয় বৈতরণীর খেয়া, শেষ পর্যন্ত তা দলা পাকাবেই।" জেলখানায় নজরদারি রাখার সুবাদে শাসক ও তার অনুগামীরা কয়েদি ও আগন্তুকের কথোপকথন আগাগোড়া খেয়াল করেছে। ক্ষমতার চরিত্র যেমন, অনুভবরহিত কিন্তু সন্দেহপ্রবণ। ক্ষমতা যে কোনও উচ্চারণের তাৎপর্য নির্ধারণ করতে চায় নিজেই। স্বার্থই অর্থের নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। শাসকমাত্রেই এই ছকে নাম লেখায়। শাসকের মন কীভাবে কাজ করে, তার অনবদ্য নাট্যরূপ পাওয়া যায় দ্বিতীয় দৃশ্যে। তাই মগের মুলুকেও কয়েদি আর আগন্তুকের স্বাভাবিক কথোপকথনের তাৎপর্য নিজের মতো করে গড়েপিটে নেয় শাসক ও তার অনুগামীরা। বলা বাহুল্য, সে অর্থের ব্যাখ্যা শুনে কয়েদি নিজেই বিস্মিত হয়। পরবর্তী দৃশ্যে, অর্থাৎ নাটকের শেষে দেখা যায়, আগন্তুক এবং কয়েদির ভাষা বদলে গেছে।
ক্ষমতা, নজরদারি নিয়ে কথা শুরু হতে অনিবার্যভাবেই নাটকটি অপরাধ ও শাস্তির সংজ্ঞা, প্রকৃতি নিয়েও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে ছুঁয়ে যায়। সত্তার শরীরের শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণের কৃৎকৌশলের ছবি প্রায় প্রত্যেক সংলাপেই লক্ষ করবেন পাঠক। সংলাপনির্ভর নাটকে শব্দের মারপ্যাঁচ প্রত্যাশিত। ব্যতিক্রমহীনভাবে এই নাটকে চরিত্রদের জগৎ তৈরি হয় ভাষার মাধ্যমে। আগন্তুক আর কয়েদির শ্রেণিচরিত্রের নির্দেশক অবধারিতভাবেই তাদের ভাষা। দৃশ্যান্তরে এই চরিত্রদের বিবর্তনেরও সূচক হয় ভাষা। এ-ব্যাপারে গতানুগতিক ছকে চলেন নাট্যকার। এই নাটক শুরু হয় মগের মুলুক বাগধারার পানিং দিয়ে। মগের চিত্রকল্পটি গোড়ায় কিছুটা আরোপিত মনে হলেও পানিংয়ের জোরেই তা পাঠকের মনে থিতু হয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, নাট্যকার মাঝেমাঝেই পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন বহুস্তরী ভাষাজটের সামনের। ঢোকা, বেরনো, শেখা, শোনা, বলা- ইত্যাদি প্রতিটি সরল ক্রিয়াবাচক শব্দের প্রয়োগকে কৌশলে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিতে থাকেন তিনি। ক্রিয়া আর কর্তার সম্পর্কের কোনও একমাত্রিক সংজ্ঞায় আশ্বস্ত নন নাট্যকার। নাটকটি পাঠের ক্ষেত্রে পাঠকের নির্বিকল্প কর্তব্য এই ভাষাজটগুলির সামনে থমকে দাঁড়ানো, সময় নিয়ে এগুলির তাৎপর্য বিবেচনা করা। সমসাময়িক রাষ্ট্র-রাজনীতির বিচার, রূপক-উল্লেখের সূত্রে নাট্যআঙ্গিকে নিজস্ব বোঝাপড়ার ছবি তুলে ধরা, ইত্যাদি তো আলোচ্য বটেই। পাশাপাশি স্মর্তব্য, নাট্যকার প্রকৃত প্রস্তাবে ভাবিত যা নিয়ে, তাত্ত্বিক লব্জে তা হলো দৈনন্দিনতার স্পর্শে ‘সাবজেক্টিভিটি’-র নির্মাণের প্রশ্ন, বিষয়ীসত্তার প্রশ্ন। “সকলই তোমারই ইচ্ছা” বা “পারি কিন্তু চাই না”- কথাগুলিকে পড়তে হবে এই নিরিখেই।
নজরদারি, ক্ষমতাতন্ত্রের উপাদান ও কার্যপ্রণালী বিষয়ে নাটককার নতুন কোনও দিকনির্দেশ করেন না। কোনও নিস্তার বা উত্তরণের ছক বাতলে দিতেও আগ্রহী নন তিনি। এমন কোনও লক্ষ্যই তাঁর ছিল বলেও মনে হয় না। ক্ষমতার স্বয়ংক্রিয় চলমানতাই হলো ক্ষমতাতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বুনিয়াদি কথা। দলীয় রাজনীতির সম্ভাবনা সম্পর্কে ঔদাসীন্য এবং কার্যত আস্থাহীনতা নাটকের নানা ছত্রে প্রকট। এই বুনিয়াদি রাজনৈতিক কথার সমান্তরালে কয়েদি, আগন্তুক, পুলিশ, সেনা, টহলদার আর শাসক ও তার অনুগামীদের কথোপকথনের সূত্রে উপস্থাপিত ভাষাজটগুলি ও বৃহত্তর দার্শনিক প্রশ্নগুচ্ছকে এড়িয়ে গেলে তা নাটকটির অসম্পূর্ণ পাঠ হবে।
বই: বারবার মগের মুলুক
লেখক: বিশ্বজিৎ রায়
প্রচ্ছদ: দেবব্রত ঘোষ
অলংকরণ: দেবরাজ গোস্বামী
প্রকাশক: মান্দাস
মূল্য: ১২০/-