উই দ্য পিপল: পাতা উল্টে ভারত ভ্রমণ করায় যে বই

We The People Book Review: ভারতবর্ষ মানেই তথাকথিত ডিজিটাল মিডিয়া বা ডিজিটাল ইন্ডিয়া বা সোশ্যাল অ্যাটাচমেন্ট নয়।

বাংলা কথা সাহিত্যের উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের লেখায় যে জাতি ও জনজীবনের বৃহত্তর কাহিনি আমাদের কাছে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছিলেন, যেভাবে জীবনব্যাপী মনুষ্য চরিত্রের ওঠা-পড়া এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের যে কঠিন পথ, যেখানে ছিল জীবনের বাঁকে মরণ খাদ, অথচ যাদের পা ঢুকে গেছে কাদায়, যাদের সহায় সম্বল বলতে শুধুমাত্র নিজেদের কঠিন জীবন আর বেঁচে থাকার জন্য আগামীর আশা — এই সহজ, সরল এবং চিরন্তন মানব সত্যের ইতিহাসের দলিল আমরা জেনেছি তাঁদের লেখায়। সেই কাদায় পড়ে থাকা মানুষ আর আজকের বৃহত্তর ডিজিটাল ইন্ডিয়ার টাওয়ারের নিচে ঘাসে শুধু সজ্জিত মানুষদের কাহিনি নিয়েই যেন আমরা পড়ে ফেলি 'উই দ্য পিপল'-এর পাতা।

ভারতবর্ষের সংবিধানের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য সার্বভৌমত্ব। ভারতবর্ষের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় যে ধরনের গণতান্ত্রিক চেতনার পরিকাঠামো দরকার, স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরও সেই পরিকাঠামো নির্মাণে অনেক গোড়ায় গলদ থেকে গেছে। খুব সাধারণভাবে দেখলে বোঝা যায়, ভারতবর্ষ মানেই তথাকথিত ডিজিটাল মিডিয়া বা ডিজিটাল ইন্ডিয়া বা সোশ্যাল অ্যাটাচমেন্ট নয়। বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানী অথবা রাজ্যে জেলার অন্তর্গত সদর শহর কেন্দ্রিক মানব সভ্যতার যে পরিকাঠামো, তার বাইরেও বৃহত্তর একটি জনজাতি ও জনগোষ্ঠী ও জনপরিসংখ্যান ব্যাপকভাবে এই সরকারি বিভিন্ন রীতিনীতি ও পরিকাঠামোর আওতার বাইরে। আর এই বাইরে থাকার মূল কারণ বিরাট সংখ্যক একটি জাতি বা একাধিক জাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা। চিন্তক ও লেখক সমৃদ্ধ দত্তের 'উই দ্য পিপল' যেন পাতা উল্টে ভারত ভ্রমণ করে ফেলার নিদর্শন। বইটিতে প্রায় ১৪টি স্বাধীন লেখা পরিবেশিত হয়েছে। প্রতিটি লেখার মধ্যেই ভারতবর্ষের বিরাট চকমকি আলোর বিপরীতে থাকা অন্ধকার এক মানব জনজাতি ও তাদের জীবন-জীবিকার এবং প্রতিনিয়ত জীবনের সঙ্গে সংগ্রামের এক বাস্তব দলিল তুলে ধরেছেন লেখক। এই বইটির প্রতিটি আলোচনা বা লেখা দেশের যেকোনও সচেতন ও চিন্তাশীল ব্যক্তি বা পাঠককে নাড়া দেবে বলেই বিশ্বাস। বইটির নামকরণ 'উই দ্য পিপল'। এই 'পিপল' কারা ? এখানে 'উই' কারা? এই প্রশ্নগুলি আমাদের সাধারণভাবে ভাবতে শেখাবে, এই রাষ্ট্রের বা স্বাধীন দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের জীবন কাহিনি ও জীবিকা প্রণালী।

আরও পড়ুন- দৃষ্টি হারিয়ে অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে পাওয়াই সলমন রুশদির ‘নাইফ’

বইটির একটি ব্লার্ব অংশে যে বিষয়গুলিকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তাতেই খুব সহজে বইটির মধ্যে যেকোনও পাঠক সোজাসুজি প্রবেশ করতে পারবেন। প্রতিটি লেখা পড়ার পর পরবর্তী লেখাতে পৌঁছে যাওয়াও খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে কারণ, লেখক নিজেই এখানে একটি অদৃশ্য মালা গেঁথেছেন প্রথম থেকে চতুর্দশ লেখার মধ্যে। আসলে বৃহত্তর ইতিহাসের নেপথ্যের কাহিনি যারা নির্মাণ করেন অথবা যারা এই ইতিহাসের কারিগর তারাই প্রকৃত সেই দেশের সন্তান বা মানুষ বা সেই দেশের ভূমিপুত্রের মতো। তাদের মাধ্যমেই সেই দেশের অভিযোজন থেকে বিবর্তন সবটুকুই ধরা দেয় অবলীলাক্রমে। আমরা তাদের জীবনকে যখন খুব কাছ থেকে দেখি অথবা দেখার চেষ্টা চালাই তখন মনে হয়, এই জীবন প্রকৃত জীবন। এই লড়াই প্রকৃত লড়াই। এই বাঁচাই প্রকৃত বাঁচা। এই সংস্কৃতি দেশের আভিজাত্য। এই জীবন সংগ্রামের কাহিনি সেই দেশের প্রকৃত বেদ, প্রকৃত সংগ্রামের কাহিনি, প্রকৃত জীবনের কাহিনি। এই প্রসঙ্গকে আরেকটু তলিয়ে আলোচনা করলেই বোঝা যায় এই বইটির সার্বিক গুরুত্ব। একটি বই যা কিনা যেকোনও দেশের বা রাজ্যের বা কোনও জেলার প্রত্যন্ত অজ পাড়া গাঁ, যেখানে সেভাবে এখনও পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি আজকের উন্নত প্রযুক্তির ফাইভ জি-র মতো পরিষেবা। আর সবচেয়ে বড় কথা, যে কোনও জাতি গোষ্ঠীর বেড়ে ওঠার মূল দু'টি কারণ, এক) খাদ্য ও শিক্ষা এবং দুই) সামাজিকতা অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সমাজের তালে তাল মিলিয়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করা। তাই আজ ভারতবর্ষের প্রায় ১৪০ কোটির জনসংখ্যার দেশে একের পর এক গ্রামে বা অঞ্চলে যেমন আলো ফুটে উঠেছে, তেমনই অন্ধকারের প্রলেপ এখনও গ্রাস করে রেখেছে অনেক খেটে খাওয়া মানুষের চিন্তার স্রোত।

বইটির দ্বিতীয় প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে একটি গ্রামের জীবনের খুব সাধারণ কাহিনি। সাধারণত যেকোনও গ্রামের মানুষদের চিন্তার সঙ্গে শহুরে মানুষদের চিন্তার যে বিরাট ফারাক লক্ষ্য করা যায় তাতে কিন্তু খুব সহজেই বোঝা যায় গ্রাম ও শহরকেন্দ্রিক জীবন সভ্যতার মানুষের জীবিকা ও চিন্তার পরিবর্তন। খুব সুন্দরভাবে এই দ্বিতীয় প্রবন্ধে লেখক আলোচনা করেছেন একটি গ্রাম্য জীবনের কাহিনি। যদিও এই কাহিনি কোনও উপন্যাসের প্লট নয়। এই কাহিনি খুব সামনে থেকে চোখ দিয়ে দেখার ঘটনা, যা শুধুমাত্র গল্প করলে বোঝা যায় না সেই ঘটনার চরিত্রের মানুষদের সাধারণ জীবন যাপনের ছোট বড় নানা কাহিনি। এই প্রবন্ধের কথা যেভাবে শুরু হচ্ছে তা কিছুটা উল্লেখ করি,

"নিয়মটা হল কেউ অসুস্থ হলে সবার আগে তার খাটের কাছে দুটো বাঁশ এনে রাখতে হয়। আর কিছু দড়ি। নাম অবশ্য খাট, আসলে চারপাই। সেটারও অনেক সময়ই দড়ি ছেঁড়া। প্রথম প্রথম অসুস্থ হলে সেটা উপেক্ষা করাই নিয়ম এখানে। সামান্য জ্বর হয়েছে, সর্দি কাশি কিংবা ফোঁড়া বা মুখ থেকে রক্ত পড়ছে এরকম কোনও ঘটনার জন্য ডাক্তার দেখানো যথেষ্ট বিলাসিতা। দরকারই নেই। কিন্তু সন্তানবতী নারীর যখন ধীরে ধীরে যন্ত্রণা শুরু হয় কিংবা বহুদিন অসুস্থ থাকা কোনও মানুষ যখন আর কিছুতেই ব্যথা বেদনা সহ্য করতে পারছেন না, তখন আর উপায় থাকে না। ডাক্তারকে তো দেখাতেই হয়। নিয়ে যেতে হবে হাসপাতালে। তাই সর্বপ্রথম এরকম সময়ে ওই বাঁশ খাটিয়ার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। এমনভাবে বাঁশ বাঁধতে হবে যাতে দু'জন অথবা চারজন বাঁশে কাঁধ দিয়ে খাট বহন করতে পারে। সোজা কথায় যেভাবে মৃতদেহ সৎকারে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে এভাবে ৬ কিলোমিটার হাঁটা। সেই রাস্তাটা বেশি কঠিন। কারণ ওটা ঠিক রাস্তা নয়। কোনওভাবে একটা পথ করে নেওয়া। তাই বেশিরভাগ সময়ই কাদা জলে ভরা। কাঁধে বাঁশ ধরে খাটে থাকা অসুস্থ মানুষকে ব্যালান্স করাই মুশকিল। তার জন্য অবশ্য সহজ একটি পন্থা আছে। আর এক্সট্রা দড়ি দিয়ে ওই খাটের সঙ্গেই অসুস্থ মানুষ অথবা গর্ভবতী নারীকে বেঁধে নিতে হয়। যাতে বহনকারী চার অথবা দু'জন কোনও কারণে ওই কর্দমাক্ত অমসৃণ রাস্তায় ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেও অসুস্থ মানুষটি পড়ে না যায়। এভাবে ৬ কিলোমিটার হাঁটার পর যে রাস্তায় ওঠা যাবে সেটি হল মোটরেবল রোড। অর্থাৎ গ্রামের ভাষায় হাইরোড। এখানে গাড়ি চলে। তবে এরপর একটা গুরুতর কাজ। সেটিই আসল। ওই বাঁশের ভারা বাঁধা খাটিয়াকে রাস্তার পাশে সন্তর্পণে রেখে চলন্ত গাড়িকে হাত দেখানো। যাতে কেউ দয়া করে থেমে যায়। বেশিরভাগ থামবে না জানা কথা। তাই হয়। তবে ক্বচিৎ কদাচিৎ কেউ হয়তো থেমেও গেল। তখন সেই গাড়িতে চাপানো হবে ওই অসুস্থ মানুষকে। আর তারপর ১২ কিলোমিটার দূরে কমিউনিটি হেলথ সেন্টার। আর যদি একটিও গাড়ি না থামে? তাহলে অগত্যা আবার সেই খাটিয়া বহন করে ১২ কিলোমিটার হাঁটা এবং পৌঁছনো কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে।"

এই ঘটনা আমাদের মনকে পীড়া দেয়। নাড়া দেয় আমাদের চেতনাকে। তাহলে এর সমাধান? আসলে একদিকে যেমন প্রতিনিয়ত এক কলুর বলদের মতো বেঁচে থাকা এবং বিরাট আর্থিক সঙ্গতি থেকে সাধারণ এই কালো চামড়া মানুষদের দূরত্ব ক্রমাগত তৈরি হওয়া, এও এক রকমের অশিক্ষার পরিচয়। ঝাড়খণ্ডের গুন্ডা জেলার সুন্দর পাহাড়ি ব্লকের মাসপাড়া এবং রাজাভিঠা নামক দু'টি গ্রাম। যেখানে পাহাড়িয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের বসবাস। সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল' এই শব্দগুলি খুব ভারী হলেও সেভাবে এই সমস্ত 'পিপল'কে কখনই রাষ্ট্রীয় শাসন বার রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো এক জায়গায় বা এক ছাদের তলায় আনতে পারেনি। একের পর এক সভ্যতার আলো ক্রমাগত শহরকেন্দ্রিক ইমারতকে আলোকিত করেছে কিন্তু খোলা আকাশের নিচে টালির ছাদে বা মাটির ছাদে সেভাবে আলো পড়েনি। লেখক খুব সুন্দরভাবে ছোট জনজাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের বেঁচে থাকা থেকে কঠিন সংগ্রামের মধ্যে জীবিকার লড়াইয়ের ছবি আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। আসলে এই বই শুধুমাত্র পাঠ্যবই নয়, এই বই সাধারণ থেকে অতি সাধারণ মানুষদের জীবনের বাস্তব দলিল। যে সন্তানসম্ভবা মেয়েটি মাঝেমধ্যেই তার প্রসব যন্ত্রণায় বিচলিত হচ্ছেন, ব্যতিব্যস্ত হচ্ছেন, ঠিক তখনই সেই মেয়েটির স্বামী কিছুই বুঝতে পারেন না। এই না বোঝাটাই হয়তো ভারতবর্ষের কালো অংশের দিক। হয়তো ১৪০ কোটি ভারতবাসীর ভেতরে লুকিয়ে থাকা না দেখা অন্ধকার। তাই প্রসব ব্যথায় কাতরানো মেয়েটিকে যখন মাটির রাস্তা থেকে তুলে হাইরোডের উপর দিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়, তখন ডাক্তারের সঙ্গে সেই কালো চামড়ার স্বামীর কথাবার্তা বুঝিয়ে দেয় আজকের ভারতবর্ষের সঠিক ও প্রকৃত চেহারা। আজকের ফাইভ-জি যুগের ইন্টারনেট পরিষেবায় যখন সূর্যাস্তের পর গ্রামের মাঠ থেকে বাড়ির উঠোন পর্যন্ত কালো অন্ধকার ঢেকে নেয় সমস্ত আলোকে, তখন শুধুমাত্র কাঠ জ্বালিয়ে দু' পাঁচটা বাড়ির মাঝে আলো করে রাখার যে প্রচেষ্টা, সেই প্রচেষ্টা কি শুধুমাত্র পিছিয়ে থেকে একটু একটু করে ধাক্কা মেরে সামনে আসার প্রয়াস নয়? আজকের সভ্যতায় মোবাইল মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেখানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গুড্ডা জেলার এক প্রান্তিক গ্রামের অসংখ্য মানুষ ব্যবহার করছেন টর্চের আলো হিসেবে। সমসাময়িক আর্থসামাজিক পরিবেশের প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে যে সঠিক ও স্বাভাবিক পরিষেবা ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা থাকা দরকার, তার থেকেও অনেক অনেক দূরত্বে অবস্থান করছে রাষ্ট্রীয় শাসন। লেখক এই প্রবন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে পাঠককে জানাতে চেয়েছেন সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা।

আরও পড়ুন- যে বই প্রকাশনার অলঙ্কার, বাজারে তারই কাটতি বেশি

দুই

বইটির ষষ্ঠ প্রবন্ধটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবন্ধের শুরুতেই শান্তিনিকেতনে এসে সিএফ এন্ড্রুজের হাতে চিঠি পাঠিয়েছেন মহাত্মা গান্ধিকে। সাল ১৯৩৬, ডিসেম্বর মাস। সেই চিঠিতে তিনি প্রশ্ন করেছেন, আপনার মতে একটি আদর্শ গ্রাম কাকে বলে? আর আজকের এই সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনও একটি সাধারণ গ্রামকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলাই বা কীভাবে সম্ভব? ১৯৩৭ সালের হরিজন পত্রিকায় ৯ জানুয়ারির সংখ্যায় গান্ধিজি সেই চিঠির উল্লেখ করে লিখেছেন,

"একটি আদর্শ গ্রামের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো সবার আগে সেটির নিকাশি ব্যবস্থা আর পরিচ্ছন্নতা। এমন কোটি নির্মাণ করা যেটিতে যথেষ্ট আলো বাতাস আসে। সেই কুটির সামনে অথবা পেছনে জমি থাকে এবং সেই জমিতে প্রয়োজনীয় সবজি ও ফল গ্রামবাসীরা নিজেরাই উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মেটাতে পারেন। আদর্শ গ্রামে থাকা দরকার একটি কমন প্রার্থনাস্থল। যেখানে সকলেই এসে প্রার্থনা করতে পারবেন।"

মূলত এই প্রসঙ্গ নিয়েই এই পর্বের প্রবন্ধ শুরু হচ্ছে। অর্থাৎ গ্রাম তৈরির আদর্শ পরিকল্পনা খুব সহজেই গান্ধিজি পরিবেশন করেছেন। উল্লেখ্য, নিকাশি ব্যবস্থা আর পরিচ্ছন্নতা। এই পরিচ্ছন্নতা শব্দটির প্রতি একটু বেশি আলোকপাত করব। এই পরিচ্ছন্নতা শুধুমাত্র পরিবেশগত পরিছন্নতা নয়, এরই সঙ্গে আছে মনের পবিত্রতা, যেকোনও কাজের প্রতি গভীর সমর্পণ এবং যে কাজটি পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেই কাজটির সামাজিক গুরুত্ব। অর্থাৎ একটি জনসাধারণের চলার পথে বা দেশের হাইওয়ের উপর গাছ বসানো যেমন শুধুমাত্র হাইওয়ের পরিকাঠামো নির্মাণ নয়, তারই পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা যেমন একটি সামাজিক পরিকল্পনা, এই সামাজিক পরিকল্পনা এই নীতি এবং এই চিন্তায় প্রকৃত সমাজ উন্নতির চাবিকাঠি। এই প্রবন্ধের একটি জায়গায় লেখক বলছেন,

"নারায়ণপুরই শেষ সীমানা। এরপর ওই যে কাঁচা রাস্তাটা গিয়েছে দু'দিকের জঙ্গলের আভাস দিয়ে সেটাই বলা হয় গেটওয়ে। ওইদিকে অবুঝমাড়া। চারিদিকে পাহাড়। দু'দিকে ঘিরেছে ইন্দ্রাবতী নদী আর অরণ্য। সাড়ে চার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত। ২৩৩ টি গ্রাম। ১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত। সম্পূর্ণ মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল। তাই অগম্য। সভ্য আধুনিক ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ। মারিয়া সম্প্রদায়ের প্রাচীন আদিবাসী। কতটা অগম্য বস্তারের ভোট কভার করতে গিয়েছিলাম। নারায়ণপুরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ব্লক আধিকারিক অফিসে কর্মরত ওম প্রকাশ সুর্মা বলেছিলেন, মাসি দু'দিন এই মানুষগুলো রেশনের চাল গম চিনি নিতে আসেন কতটা পথ পেরিয়ে জানেন? কতটা? ৭০ কিলোমিটার..."

এই ঘটনা শুধুমাত্র একজন গ্রামের মানুষের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। একজন শহুরে ব্যক্তির বা জনজাতির পক্ষে এই অবস্থা বোঝার পরিস্থিতি ও সাধ্য কোনওটাই থাকতে পারে না। আসলে গ্রাম শব্দটির মধ্যেই রয়েছে বৃহত্তর মানব গোষ্ঠীর বিবর্তিত রূপ। আর এই বিবর্তন একদিনে আসেনি। যে সময় দাঁড়িয়ে আমরা আজকের ছোট থেকে বড় সমস্ত কিছুই মানদণ্ড থেকে অর্থনীতি দণ্ডের উপর নির্ভর করে বিচার থেকে আলোচনা ও পর্যালোচনা সবটাই করি, সেখানে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র এটুকু ভেবে নিলে চলবে না যে, ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যারা আসেন তারা কেন আসেন? কী জন্য আসেন? কাদের জন্য আসেন? এই প্রশ্নগুলো সহজেই আমাদের বিবর্তনের পথকে কিছুটা হলেও সুরাহা দিতে পারবে। একটি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড নির্মাণ হয় শুধুমাত্র অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর ভিত্তিতে নয়। সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেই সমাজে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের সামাজিক চেতনা। যে গ্রামের এক মহিলার প্রসব যন্ত্রণা সেই নারীর স্বামীর কাছে শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়, সেই দেশের অসংখ্য মানুষের পক্ষের কোনওভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না রাষ্ট্রের পক্ষে সাওয়াল রেখে জীবনের ধারাপাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বিপরীতে তারাই নিজেদের অজান্তে রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রের পরিষেবার বিপরীতে পা বাড়ায়। শুধুমাত্র বিরাট সংখ্যক মানুষের অশিক্ষা এখানে সবচেয়ে বেশি দায়ী হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন, এই দায় কার? বেশ কিছু বছর আগে আমরা দেখেছি, এই ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে কৃষিই প্রায় ৪০% মানুষের প্রধান ও একমাত্র জীবিকা, তারাই সবচেয়ে বেশি প্রতারিত এবং শোষিত ও সামাজিকভাবে উপেক্ষিত। যে চাষের জমিতে ফসল ফুলিয়ে কৃষক এত কাল ধরে সমগ্র বিশ্ব জাতির মুখে জুগিয়েছে অন্ন, তারাই রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। সারা দেশ জুড়ে, একের পর এক ঘটেছে কৃষক আন্দোলন। ভারতবর্ষের মতো দেশে বিরাট কৃষক সম্প্রদায় মহানগরের রাস্তায় নেমেছে আন্দোলনের জন্য, অধিকারের জন্য। নেমেছে তাদের ন্যায্য প্রাপ্যের জন্য। শুধুমাত্র বেশ কিছু কূটনৈতিক ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মধ্যে ভারতবর্ষের মতো এই বহুবিধ ভাষা, ধর্ম, জাতির মানুষের পক্ষে এককভাবে কখনও সময় পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে না। সামগ্রিক পরিবর্তন আসে সামগ্রিক জনসাধারণের সামাজিক ও আর্থিক চিন্তায়।

আরও পড়ুন- ষোলোকলাম: সুখের স্থির জলে মুঠো-মুঠো পাথর ছুঁড়ে দেয় এই বই

তিন

বইটির একাদশতম প্রবন্ধে ধর্মীয় চেতনা, ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে লেখক খুব সূক্ষ্মভাবে মানুষের অন্তরের ধর্মীয় বিশ্বাসের মর্যাদা যে কতখানি তা আলোচনা করেছেন। যেকোনও দেশের বা রাষ্ট্রের পরিকাঠামোয় স্বাভাবিকভাবেই থেকে যায় ধর্মীয় চেতনার মদত। এই ধর্মীয় চেতনাকেই সম্প্রতি রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক চিন্তা কুক্ষিগত করে নিতে পেরেছে। আর এর পেছনে রয়েছে বিরাট একটি শ্রেণির অশিক্ষা। অশিক্ষা থেকেই জন্ম নিয়েছে অন্ধবিশ্বাস। এই অন্ধবিশ্বাসেই গা ভাসিয়েছে সারা ভারতবর্ষের একের পর এক গ্রামের অসংখ্য সাধারণ মানুষ। একটি চরিত্র 'ধর্মেন্দ্র' এখানে সেই ধর্মীয় বিশ্বাস সম্প্রদায়ের যেন প্রতিনিধি। এই ধর্মেন্দ্রর মতো অনেক মানুষই ধর্মীয় বিশ্বাসকে তাদের নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেছে দিনের পর দিন। আবার এই ব্যবহারই সামাজিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছে সমাজের স্বার্থে। তাই খুব সহজেই বলা যায়, কোন দেশের বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিস্থিতি যদি সর্বদাই প্রতিটি সিস্টেমের বিরুদ্ধে এগোতে এগোতে ক্রমশ লক্ষ্যের দিকে পৌঁছতে পারে, তাতে শুধুমাত্র পৌঁছনই যাবে কিন্তু উদ্দেশ্য থেকে যাবে লক্ষ্যহীন। ভারতের শহর থেকে গ্রাম, মেলা থেকে সংস্কৃতিক উৎসব, জীবন থেকে ছোট বড় নানা জীবিকা, ক্ষুধা, অর্থাভাব, দারিদ্র অথবা মানসিক বিষাদ, এইসবই কিন্তু এক বিরাট সম্প্রদায়ের অদৃশ্য মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়তই বিরাজমান। মনে আসে স্বামী বিবেকানন্দের সেই সূত্র জাগরণের কথা। আসলে যে কোনও জাতির মূল মানদণ্ড বয়ে চলে তার সমাজ নির্ভরতার উপর। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই সমষ্টিবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল আজ থেকে বহু লক্ষ বছর আগে, যা থেকেই তৈরি হয়েছিল গোষ্ঠী প্রথা বা গোষ্ঠীবদ্ধতা। অথচ আজ দ্বিবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা দেখেছি, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র আজ ডিজিটাল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে, যেখানে শুধুমাত্র যোগাযোগই আছে, নেই মনের অনুভূতি বা উপলব্ধির আদান প্রদান।

সবশেষে এটুকুই বলা যায়, একটি স্বাধীন দেশ কিছু নিয়ম-নীতি ও সংবিধান এবং প্রশাসনিক নীতির মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ এই বিরাট সভ্যতার নিচে যারা শুধুমাত্র জনগণ বা জনসংখ্যা- এই অভিধা নিয়েই দিনের পর দিন জীবন ও সভ্যতা অতিবাহিত করে আসছে, শিক্ষিত ও এলিট ক্লাস তাদের কোনওভাবেই গুরুত্ব দিয়ে উঠতে পারেনি। এই দুই সমাজের পার্থক্য প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত থেকেই গেছে। একজন কালো চামড়ার মানুষ সারাদিন মাঠে-ঘাটে কাজ করে ফসল ফলায়, সূর্যাস্তের আলোয় মাটির ঘরে ফিরে আসে। তার কাছে জীবন যেমন এক নিদারুণ স্বপ্নের ভেলা, সেখানে নেই কোনও বোঝা, নেই কোনও পরিকল্পনা, নেই কোনও লক্ষ্য, অথচ এই সংখ্যাটাই সবচেয়ে বেশি। তাও এদের মূল্যবোধ বা চিন্তা বা আদর্শ বা সামাজিক মানদণ্ড দিয়ে গোটা দেশ বা জাতির কাঠামো নির্মাণ হয় না। আমরা মন্দিরে বা প্যান্ডেলে যে প্রতিমা দেখতে যাই, তার বাইরের অবয়ব চিকন হলেও, পিছনে সেই কঙ্কালসার শূন্যতা।  মাটি, বাঁশ দিয়ে পরিকাঠামোর উপর প্রলেপিত হয় চিন্ময়ী রূপ, যা বাহ্যিকভাবেই রূপের তারতম্য ও সৌন্দর্যের জৌলুস অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। তেমনই শহুরে ও নাগরিক চিন্তা, উচ্চবৃত্তের জীবন আকাঙ্খা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো বাহ্যিক দেশের জৌলুস বাড়িয়ে দেয়, সেখানে অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকে এই বিস্তীর্ণ দু'ভাগের 'পিপল'-রা। তাদের না আছে ঘর, না আছে শখ, না আছে মন। আছে শুধু লড়াইয়ের মানসিকতা। আছে শুধু এগিয়ে যাবার ক্ষমতা। আছে শুধু মাটি আঁকড়ে নিজের জীবিকা নির্বাহের স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা, যা কখনই একটি দেশের গরিমাকে রূপ দিতে পারে না।

তাই লেখক বলেছেন, "অসংখ্য জাদু চরিত্র ঘুরছে।" নিছক ভোটার তালিকায়, আধার কার্ডে, নাগরিকত্বের পরীক্ষায়, সংবিধানের অধিকারে, গণতন্ত্রের থিসিসে তাদের অন্তরের সুখ দুঃখের সন্ধান পাওয়া যাবে না। এই কোলাহলের নাগরিক বিকাশ আর উচ্চকিত গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পগুলির ঠিক মাঝখানে তারা আছেন অদৃশ্য মানুষ হিসাবে। কখনও তারা আমাদের চেনা মুখ। কখনও অচেনা। এই মানুষগুলির দোদুল্যমান জীবনযাপন প্রণালী ও বেঁচে থাকার সুদীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা প্রয়াসই এই বইয়ের আখ্যান।

উই দ্য পিপল - সমৃদ্ধ দত্ত

দেজ পাবলিশিং

মূল্য ২৫০.০০

More Articles