মেঘে মেঘে তারায় তারায়: ধ্রুপদী পথে হাঁটতে হাঁটতে ধ্রুপদহীন বাঁক

Meghe Meghe Taray Taray: সাধারণত বাঙালি সনাতন হিন্দু মৃত্যু বিয়োগের পর তাদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের যে শ্বেত শুভ্র বস্ত্রের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় তা মূলত লেখকের কথায় এসেছে আমাদের দক্ষিণি সিনেমা থেকে

বাংলা ও বাঙালিজাতির দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংস্কৃতি ও পরম্পরা যে কত বিচিত্র এবং রুচিসম্পন্ন আর সর্বোপরি মানববন্ধন যুক্ত, তা এই বইটি পড়লেই খুব সহজে বোঝা যায়। আজকের এই উন্নততর প্রযুক্তি এবং উন্নত বৈজ্ঞানিক যুগে যখন আমাদের সাবেকি চিন্তা ও ভাবনা সংকুচিত হয়ে আসছে, ঠিক এই সময়ে এই বইটির প্রণেতা পণ্ডিত সুধীর চক্রবর্তী যেন আমাদের ফেলে আসা চিরকালীন বাংলা ও বাঙালি জাতির পারস্পরিক সম্পর্ক, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরম্পরা — সবকিছুই দুই মলাটের মধ্যে ধরে ফেলেছেন। বইটির আত্মপক্ষ বিভাগে লেখক নাতিদীর্ঘ একটি কথা বলেছেন। আলোচনা প্রসঙ্গে এই কথাটি দিয়েই শুরু করব।

"ছোটবেলা থেকে মানুষের কথার টানে শুনে এসেছি একটা পরিহাসোক্তি যে, তুমি চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। কথাটার ভেতরে কেমন যেন একটা পাল্লাদারির ভাব রয়েছে। অনেক পরে, বছর কুড়ি আগে, চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের বাক্যব্যবহারে শুনেছিলাম- তিনি বলছিলেন একজনকে, 'জানো, দক্ষিণ ভারতে আমার একটা ফিল্মের শুটিং করতে গিয়ে শুনেছিলাম ওদের প্রবচন "তুমি চলো মেঘে মেঘে, আমি চলি তারায় তারায়”।' আড়াল থেকে এ সংলাপ শুনে মনে মনে ভারি তারিফ করেছিলাম। বাঃ! বেশ তো কাব্যিক উক্তি এটা, অথচ কোনও পাল্লাদারি বা উম্মা নেই। আমার এই সদ্যতন বইটির নামকরণের ব্যাপার নিয়ে এটুকুই আত্মকথন। এ বইয়ে ধরা আছে পঞ্চাশটি মিতায়তন গদ্যে পঞ্চাশ রকম অভিব্যক্তি, যা ব্যক্তিগত।"

এই যে লেখকের একটি অভিজ্ঞতা, যেখান থেকে তাঁর এই বইটির নামকরণ, সেই বইটি পড়লেই খুব সহজেই আমরা অন্তত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি বছর পেছনে চলে যেতে পারি। একটি বই যখন নির্মাণ হয় বা বই প্রকাশের পরিকল্পনা করা হয় তখন যেভাবে একজন লেখক সেই বইটির প্রাসঙ্গিকতা ও সামাজিক মূল্যকে বোঝার চেষ্টা করেন, তেমনই প্রকাশক, সম্পাদকরাও ঠিক তেমনভাবেই চেষ্টা করেন বইটিকে পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে প্রস্তুত করা। 'মেঘে মেঘে তারায় তারায়' পড়তে পড়তে সব সময়ই মনে হয়েছে যেন, ফেলে আসা বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাতাবরণ একটু একটু করে লিপিবদ্ধ করছেন আপন খেয়ালে। আমরা প্রকাশের পর সেই বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে একটু করে লেপন করছি নিজেদের কংক্রিটের আঙিনায়। প্রায় পঞ্চাশটি প্রবন্ধ নিয়ে বইটি প্রস্তুত হয়েছে। যদিও প্রতিটি লেখায় লেখকের একান্তই ব্যক্তিগত বক্তব্য, ভাবনা এবং অভিব্যক্তি। প্রবন্ধগুলির মধ্যে সমগ্র বাঙালির  পুঙ্খানুপুঙ্খ জীবনের একটি ছবি রয়েছে। তখনকার বাঙালি আর আজকের বাঙালি সমাজের পার্থক্য কতখানি বেড়েছে তা এই বইটি পড়লেই বোঝা যায়। পড়তে পড়তে ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের শৈশবের কথা, গ্রামে থাকার কথা, একান্নবর্তী পরিবারের বিধি নিষেধ, নিয়ম নীতি সবটুকুই যেন ছবির মতো চোখে ভেসে উঠেছে। যেটুকু আপনকে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে একটি সমাজ সারা বিশ্বে যে আচরণের দাবি রেখেছিল, আজ সেই দাবি কোথাও যেন পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের মতোই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কোথায় সেই নিজের কথা? কোথায় সেই নিজের লোক? কোথায় সেই নিজেদের টুকু? আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় আমরা কতটা দূরত্ব মেপে মেপে চলছি একে অপরের থেকে। একটি শব্দ 'নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি'। সত্যিই আমরা সমষ্টি হয়েছিলাম, আজ কত একা একা হয়ে বেঁচে আছি।

অভাবনীয় কায়দায়, স্বাভাবিক গদ্যে তিনি এই বইটির প্রবন্ধগুলি ব্যক্তিগতভাবে লিখেছেন। বইটির একটি প্রবন্ধ 'বাউলদের কথা'। এই বাউল কোন ধরনের বাউল? আজকের বাউল আর ফেলে আসা সময়ের বাউল! সেদিনের বাউল উন্মত্ত নেশায়, উন্নাসিকতায় মেতে উঠতে পারতেন। ফাঁকা মাঠ, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, কাঠফাটা রোদ, প্যাচপ্যাচে কাদা, দিনের পর দিন না খাওয়া পেট, রাতের আকাশে মাথার উপরে থাকত না কোনও ছাউনি। অথচ এসব কিছু উপেক্ষা করে সেদিনের বাউল মেতে উঠতেন গানে। আর আজ সে বাউল কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! সেই বাউল আর উন্মাদনা চায় না! আজ বাউল বড় হিসেবি! আজ বাউল জানে, সময়ের তালে তালে সুর-তাল-ছন্দের হিসেব। আজ বাউলের হাতে একতারা বাজে অল্প, বিপরীতে জ্বলে ওঠে হাতের দামি সোনাটা ঘড়ি। এই প্রবন্ধেই তিনি যেমন আধ্যাত্মবাদী ও দেখাত্ববাদী বাউলের কৃচ্ছ সাধনার কথা বলছেন, তেমনই বলেছেন সেই বাউলের পার্থিব বস্তুর প্রতি নির্লোভ মোহ। সেদিনের আখড়ার বাউল আজকের বাউলের মতো মার্বেলের বাড়িতে থাকে না। তবে বিপরীতে তিনি প্রশ্নও তুলেছেন, এই সভ্যতার বিরাট পরিবর্তন কি শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে? তা কিন্তু নয়। সময় যত পরিবর্তিত হয়েছে ততই বেড়েছে সময়ের মূল্য। আর তাই এই মূল্য নির্ধারণের তুল্যমূল্য বাজারে বাধ সেজেছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যার ফলে বাউল কেন, সবাই হয়তো এই দাঁড়িপাল্লা নিয়ে সর্বদাই জীবন ও জীবিকার পথে পা বাড়িয়েছে। এই প্রসঙ্গেই প্রবন্ধটির দু'চার কথা এখানে তুলে আনি।

"কেন এমন হল? সমাজ অর্থনীতির পালাবদল? গ্রামপতনের অনিবার্য অন্তর্ঘাত? নাকি আমাদের শহুরে দেখনদারির ধান্দায় পড়ে তাদের স্বভাব বদল? আসলে বাউল জীবন তো মগ্নতার, অন্তর্ভাবনার, আত্মস্থতার। তাতে দেখনদারি আর দুনিয়াদারির চটক সয় না তারা আত্ম সাবধান হয়ে গুরুনির্দেশে জপে-

'আপন সাধন কথা না কহিও যথাতথা
আপন আপনারে তুমি হইও সাবধান।

বহুদিন তাই বাউল জীবন ও বাউলের গোপন দেহতত্ত্ব ছিল সকলের কৌতূহলের সামগ্রী। আর একদল উন্নাসিক ও শুদ্ধতাবাদী বাঙালি মনে করত বাউলরা ঘৃণ্য, কদর্য, অস্পৃশ্য। তাদের নিয়ে সমাজের দুশ্চিন্তা ছিল, তবে 'গেল গেল' শোরগোল জাগেনি, কারণ তাদের ডেরা ছিল গ্রামপ্রান্তে সমাজের নিম্নবর্গেরও প্রান্তিক অংশে। কৃষিজীবীও নয়, শ্রমজীবীও নয়, সহৃদয় শ্রোতার স্বতঃস্ফূর্ত সমঝদারিতে আর দানে ভরে উঠত তাদের কাঁথায় তৈরি ঝোলা। সাজপোশাকের কৌশল ছিল না। নানা টুকরো কাপড় জুড়ে বর্ণরঙিন একটা আলপনা বা সাদা পিরান, ডোর কৌপীন আর সাদা কাপড়ের লুঙি। সর্বকেশ রক্ষা করাই বাউলের রীতি। মাথার চুল চূড়া করে বাঁধা (তাকে বলে 'ধম্মিল্ল') পায়ে ঘুঙুর, কোমরে ডুবকি, হাতে একতারা, দিনান্তে পরিক্রমা সেরে ঝোলায় জমা নানারকম চাল আর নানা জাতের সবজি একটা মেটে হাঁড়িতে চাপিয়ে কাঠকুটোর জ্বালে ফুটিয়ে দুটো অন্ন গ্রহণ। তাদের বাড়ি নেই, আছে আখড়া। সন্তান নেই, আছে শিষ্যসেবক। মন্ত্রতন্ত্র নেই, আছে গান।" (বাউলদের কথা)

অর্থাৎ কত সচেতনভাবে লেখক লিখছেন দু'টি কালের বর্ণনা। নিষ্কাম প্রেম, মোহহীন জীবনে অভ্যস্ত বাউল আজকে কতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আজকের বাউল শিখে গেছেন সংসার যাপনের কৌশল। স্ত্রী, সন্তান সবকিছুই যেন তার আগে। কথার মধ্যে চলে এসেছে কত মারপ্যাঁচ। একক ও একাকিত্বের জীবন থেকে আজকের বাউল কত সমষ্টিবদ্ধ। যদিও এক অর্থে তিনি শুধুমাত্র বাউলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি, এর সঙ্গে অনেকটা দায়ী আজকের সমাজ ব্যবস্থা। এই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করছেন, বাউলদের ট্রেনে ফেরি করে গান করার কথা। এই প্রবন্ধ পড়তে পড়তেই মনে হয়েছে, সত্যিই তো আজ যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের বোলপুর-শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাই, তখন খুব স্বাভাবিক ছবিই চোখে আসে যে বাউল এক হাতে একতারা ছেড়ে ইলেকট্রিক বক্সে  গান বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে এ কামরা থেকে ও কামরা গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন। যৎসামান্য যা দেয় ট্রেনযাত্রী, তাই যেন বাউলদের প্রতিদিনের রোজগার হয়ে দাঁড়ায়। আজ কোথাও মাচা বেঁধে বাউল গানের আসর হয়, অথচ সে হওয়ায় প্রাণ নেই, নেই দেহাত্মের মিলন। সেখানে কোথাও যেন কাজ করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাউলের লেনদেনের হিসেব। যে লালনের গান, যে বাউলের গান রবীন্দ্রনাথকেও করেছিল বিচলিত করেছিল, প্রেমান্বিত করেছিল, সেই গান আজ কোথায়। সেই প্রাণ আজ কোথায়? কোথায় সে প্রেম? সুন্দরভাবেই উপমার সঙ্গে এই বাউলদের কথা তিনি এই প্রবন্ধে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় ও বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের জানাচ্ছেন।

আরও পড়ুন- উই দ্য পিপল: পাতা উল্টে ভারত ভ্রমণ করায় যে বই

বইটির আরও একটি প্রবন্ধ হলো 'মেঘে মেঘে তারায় তারায়', অর্থাৎ নামকরণ প্রবন্ধ। বাঙালির চিরকালীন ঐতিহ্য, একে অপরের প্রতি সম্পর্ক ও মেলামেশা, একটি ঘরের সঙ্গে আরেকটি ঘরের মানুষের যোগস্থাপন, পারস্পারিক মেলবন্ধন। অথচ এসব এখন অতীত। গত শতাব্দীর শেষ দশকেও মানুষের সঙ্গে মানুষের, একটি পরিবারের সঙ্গে একটি পরিবারের অথবা একটি সম্পর্কের সঙ্গে গুটিকয়েক সম্পর্কের জোট ছিল দেখার মতো। আজ সে সমস্ত জোট কোথাও যেন শিথিল হয়ে খুলে গেছে। আর এই জোট গাঁটছড়া দেওয়ার লোক নেই। আসলে এই আধুনিক সভ্যতায় আমরা অনেকটাই 'নিউক্লিয়ার' হয়ে গেছি। তাই না পারি আপনকে পরের ঘরে সঁপে দিতে, আর না পারি পরকে আপন করে নিতে। এ প্রসঙ্গেই নিজের শৈশবের কথা আবারও উঠে আসেই। ছোটবেলায় নিজেদের বাড়িতে যখন মামা, মাসি অথবা দিদা-দাদুরা আসতেন সে কী আনন্দ! একসঙ্গে পাত পেড়ে খাওয়া-দাওয়া, বিছানায় জায়গা না হলে মেঝেতে তোষক-বালিশ পেতে একে অপরের গায়ে পা তুলে ঘুমিয়ে পড়া, মামা অথবা মাসির সঙ্গে বাড়ির বাইরের নিজের এলাকা বা নিজের শহর তাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো। যেদিন ফেরার সময় হতো, সেদিন যেন চোখের জল বাঁধ মানত না। তখন আমাদের মতো ঘরে বাড়ির বড়রা কেউ বেশ কয়েকদিন থাকার পর চলে যাওয়ার সময় বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে গুঁজে দিত দু-চার পয়সা। এমন এক একটা বছর গেছে, যে বছরের শেষে এই মামা, দাদু, মাসি, পিসি এসে যতবার টাকা গুঁজে দিয়েছে, বছর শেষে সেই টাকা যখন বসে গুনেছি তখন সেই টাকা থেকেই পুজোর জামা-প্যান্ট হয়ে গেছে। এক অদ্ভুত পরিবেশ, এক অকল্পনীয় সম্পর্ক, এক অনন্য ব্যবস্থা! আজ এসব কোথায়? এই বিষয়ের উপরই আলোচিত হয়েছে মূলত এই প্রবন্ধটি।

এই প্রবন্ধের দু-চারটি কথা একটু কথা প্রসঙ্গে তুলে আনি।

"আগেকার সমাজ ব্যবস্থায় অনেক পরিবারে আসাযাওয়া করতেন দু-চারজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। যৌথ পরিবারের যাপনে তাঁরা কেউ এলে বেশ সাড়া পড়ে যেত। হয়তো সম্পর্কে বাবার কাকা কিংবা বাবার প্রাক্তন এক সহকর্মী কিংবা মা-র মামা। এঁদের যথেষ্ট মান্যতা ছিল। কেউ বা সকালে এসে সারাদিন কাটিয়ে, খেয়েদেয়ে সন্ধের দিকে চলে যেতেন। কেউ বা থেকে যেতেন দু-একদিন। কিন্তু তাঁদের চকিত আগমন মানেই ছোটখাট উৎসব। বিশেষ করে আমাদের মতো ছোটদের। সবচেয়ে মজার কথা এঁদের আগমনের কোনও রকম পূর্বানুমান থাকত না। হঠাৎ হঠাৎ আসতেন। লক্ষ্য করতাম এমন আকস্মিক আগন্তুক কেউ এলে মা-কাকিমারা একটুও আতান্তরে পড়ত না। হাসিমুখে অভ্যর্থনা করত। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জন্য রান্নাঘরে ঢুকে সুজির মোহনভোগ আর বেশ ক'খানা লুচি ভেজে ফেলত। পরে স্টোভ জ্বেলে চা হত। তখন বাড়িতে হঠাৎ কেউ এলে অন্দরবাসিনীরা যেমন মুখ ব্যাজার করত না, তেমনই টাকা বার করে পাড়ার দোকান থেকে বাক্সে করে মিষ্টি আনানোর রেওয়াজ ছিল না। যৌথ পরিবারে এমন সব জ্যেষ্ঠ হিতার্থীদের যথার্থ সমাদরের অনেকটা প্রসারিত হৃদয়বত্তা ছিল। তাঁদের সবাই বলত 'এসোজন বোসোজন'। যাঁরা আসবেন তাঁদের মধ্যে কারোর কারোর যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল বিনোদনের ব্যাপারে। নন্দ জ্যাঠামশাই এলেই দিদির হারমোনিয়াম বার করে মাদুর পেতে বসে হাসির গান শুনিয়ে অন্দরমহলে হাসির হররা ছড়িয়ে দিতেন।" (মেঘে মেঘে তারায় তারায়)

এ প্রবন্ধে কত সুন্দর সেকালের একটি ছবি যেন ধরা পড়ে। ঘটনার সঙ্গে আমরা হয়তো একাত্ম হয়ে থাকতে পারি। টুকরো টুকরো ঘটনা কোথাও যেন লেখকের স্মৃতিকথায় চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। তবে এই প্রবন্ধ লেখক কিন্তু একটু ব্যঙ্গ করেই শেষ করেছেন।

বইটির একটি বিশেষ প্রবন্ধ 'রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে'। ব্যক্তিগত জীবনে লেখকের তিনটি গল্প শোনার প্রাপ্তি এবং এই তিনটি গল্পই তিনি শুনেছেন তৃতীয় ব্যক্তির থেকে। এই তিনটি গল্পই রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে। খুব স্বাভাবিক এই গল্পের ঘটনাগুলি তার লেখক সত্তাকে নাড়া দিয়েছে। তিনি বুঝেছেন এই ঘটনাগুলির অর্থ।

আরও একটি প্রবন্ধ 'অঞ্চলের ইতিহাস'। এই প্রবন্ধে তিনি নবীন প্রাবন্ধিকের লেখা ও বইটির পর্যালোচনা নিয়ে একটু ব্যতিক্রমী আলোচনা করেছেন। বইটির তথ্য নিয়ে যেমন তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, আবার বেশ কিছু ত্রুটিও আলোচনা করেছেন। যে বইটি নিয়ে তাঁর এই 'অঞ্চলের ইতিহাস' প্রবন্ধ সেই বইটির নাম 'লৌকিক সমাজ ও সংস্কৃতি দর্পণে পীর-গাজী-বিবি'। অর্থাৎ এই আলোচনায় উঠে এসেছে মূলত দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লৌকিক দেব-দেবী, আচার-আচরণ, বিবির থান এবং এরই পাশাপাশি এই অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলিম বনবিবিদের যে চেহারার স্বতন্ত্রতার পরিচয় পাওয়া যায়। দুই জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে নকশা ও কল্পনার যে তুল্যমূল্য পার্থক্য, তা খুব সহজেই এই প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন।

কবি সংগীত বা কবি গান একটা সময়ে যে পশ্চিমবঙ্গে বিরাট জনপ্রিয় ছিল, সেই ইতিহাস এবং সেই গানের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে 'কবিগান এখনও' প্রবন্ধে খুব সুন্দরভাবে নাতিদীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। আলোচনা প্রসঙ্গে এ বাংলার পাশাপাশি ওপার বাংলার বিশেষ কিছু কবি গানের প্রধান ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা রয়েছে। পূর্ববঙ্গের গান সম্পর্কে তিনি দীনেশচন্দ্র সিংহের বইপত্রের কথা বলতে ভোলেননি। হরিচরণ আচার্য (১৮৬১-১৯৪১), পূর্ববঙ্গের কবিগানের প্রধান ব্যক্তি এবং অগ্রপথিক। এরই পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামের গণকবি রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭), ফরিদপুর অঞ্চলের নিশিকান্ত (১৯১৩-১৯৯৩), নকুল দত্ত (১৮৯৪-১৯৮৭) ও বিজয় অধিকারীr (১৯০২-১৯র৮৫) কথাও আলোচনা প্রসঙ্গে এনেছেন।

আরও পড়ুন- ষোলোকলাম: সুখের স্থির জলে মুঠো-মুঠো পাথর ছুঁড়ে দেয় এই বই

'মৃত্যুর রঙ সাদা' প্রবন্ধে লেখক সাধারণত বাঙালির মৃত্যুর আচার-আচরণ, মৃতের বাড়ির নিয়ম-কানুন, ঘটনা এসব নিয়েই একটু শ্লেষধর্মী ব্যাখ্যা করেছেন। মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির বাড়ির যে সমস্ত পরলৌকিক কাজ, শ্রাদ্ধ-শান্তি, নিয়ম ভঙ্গ ও আচার অনুষ্ঠান মূলত এগুলি নিয়েই তিনি তাঁর সুচিন্তিত কিছু বক্তব্য ও অভিব্যক্তির প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মৃতের বাড়ির মানুষজনের কাজকর্ম এবং নিয়ম-কানুনের কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখা থেকেই উল্লেখ করা যাক-

"হঠাৎ দিন দশ-বারো আগে ওই দাদার প্রাণের বন্ধু অনাথ মিত্র স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন। খবর পেয়ে সেখানে গেলাম। পরে একদিন রীতি অনুযায়ী আতপ চাল, মটর ডাল, ঘি, কাঁচকলা, পাকাকলা, এক প্যাকেট মিষ্টি দিয়ে এলাম। তারপরে গতকাল না পরশু অনাথদার ছেলে পল্টু এল তার বাবার কাজে নেমন্তন্ন করতে। এ কালের যুবক, তাই প্যান্ট বা পায়জামাতেই অভ্যস্ত, কাছা পরে বিপন্ন দশা, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভেতরে আন্ডারওয়‍্যার। পায়ে হাওয়াই চটি। হাতে একখানা ছাপা সাদা কার্ড। যার চেহারা আর বয়ান সেই কবে থেকে দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। খামের ওপরে লেখা 'গঙ্গা'। সম্বোধনে লেখা থাকবে 'সময়োচিত নিবেদনমিদং' এবং তারপরে থাকে এক শোকবার্তা যে, তার পরমপূজনীয় পিতৃদেব অমুক দিন অমুক সময়ে সজ্ঞানে ইহলোক ত্যাগ করে সাধনোচিত ধামে গমন করেছেন। আমার এক তার্কিক গবেষক বন্ধু একবার বলেছিল, 'জানিস তো, সব লেটার প্রেসে শ্রাদ্ধের কার্ডের একটা ছাপা বয়ান থাকে। শুধু প্রয়াত বাবা বা মা-র নাম আর মৃত্যুর তারিখ ও সময়টা বসিয়ে একই বয়ান সব কার্ডে ওরা ছেপে দেয়- তাতে সবাই নিশ্চিন্ত হয়। কেননা, বাব্বা! বাংলা লেখার যা ঝকমারি আর বানানের যেসব ভজকট নিয়ম। কিন্তু কী জানিস ওই বয়ানে একটা ভয়ানক মিথ্যে কথা লেখা থাকে। কী বল তো? ওই যে লেখে অমুক সজ্ঞানে মারা গেছেন। আচ্ছা, তুইই বল, সজ্ঞানে কেউ মারা যেতে পারে? যাকগে এদেশে কোনও কথা একবার চালু হলে তাকে রোখা মুশকিল।"

মৃত ব্যক্তির বাড়ির কাছের লোক ও আত্মীয়দের কার্ড ছাপিয়ে নেমন্তন্ন করা এবং আদ্যশ্রাদ্ধের দিন খাওয়া দাওয়ার কোনওরকম ব্যবস্থা না রাখা, যাতে ওই দিন সাধারণত হিন্দু শাস্ত্র মতে লুচি ও নিরামিষ ভজন করতে হয়। লেখক তার জন্যই একটু বাঁকা সুরে ও শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে প্রবন্ধে বলেছেন, তার জন্য নতুন একটি দিন ব্যবস্থা করে ওই দিন মহাভোজন দিয়ে আত্মীয় ও কুটুম্বকে খুশি করার যে বন্দোবস্ত অর্থাৎ বলা যেতে পারে 'পাবলিক সেলিব্রেশন'। এই আয়োজনেরই তিনি একটু বিপরীত পথে হাঁটার চেষ্টা করেছেন এবং এই ঘটনা তিনি তাঁর নিজের জীবন দিয়েই উদাহরণ টেনে আলোচনা করেছেন। সাধারণত বাঙালি সনাতন হিন্দু মৃত্যু বিয়োগের পর তাদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের যে পোশাক-আশাকে শ্বেত শুভ্র বস্ত্রের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় তা মূলত লেখকের কথায় এসেছে আমাদের দক্ষিণি সিনেমা থেকে।

সবশেষে এটুকু বলাই যায়, বইটির মধ্যে নানাবিধ প্রবন্ধ যেমন - নববর্ষের অপলাপ আল্লার কল, হালুইকর, জলের জলছবি, ব্যয়কুণ্ঠের পাঁচালি, এমন মানবসমাজ কবে গো সৃজন হবে, গ্রুপ ফটো, শব্দের খেলা, ছোটগল্প কাকে বলে, পৌষ পার্বণ, লবেঞ্চুসের গল্প, পরিজন কথা, একাদশীর গপ্পো, দুর্গাপুজোর স্মৃতিকথা, বনসাই জীবন, নিঠুর মরণ, শ্মশানে বডির চাপ, সৌদামিনীর বৃত্তান্ত, বাল গোপালের লীলাকথা, মুদ্রণ প্রসঙ্গে, বাউলদের কথা, অন্যরকম মানুষ, পদাবলি, পরিযায়ী গানের রহস্য, রাবীন্দ্রিক ও স্বতন্ত্র প্রভৃতি আলোচনায় লেখকের এক ধরনের 'একাল ও সেকালের বাঙালিয়ানা-সংস্কৃতি-সাহিত্য-জীবনযাপন-সামাজিক মূল্যবোধ' ধরা পড়েছে। লেখক তাঁর নিজস্ব চিন্তা ও যুক্তি দিয়ে চমৎকার মুন্সিয়ানায় তা বর্ণনা করেছেন। বইটি প্রসঙ্গে বইটির নির্মাণকারী প্রকাশনা বলেছে, "আখ্যানের বহুগামিনী পথ, জীবনের সামান্য থেকে উঠে আসা বিচিত্র সব বিষয় তাঁর রচনা ও উৎসাহের একটা প্রধান অংশ। তাঁর অবলোকন-জগতে যে-কোনও সূক্ষ্ণ বিষয়ের গাম্ভীর্যেও শুষ্কতার পরিবর্তে রাখা থাকে স্নিগ্ধতার অবগাহন। বর্তমান বই, 'মেঘে মেঘে তারায় তারায়' নামটির অন্দরেও বাস করছে মনের সেই অভ্যন্তরীণ মাধুর্য। পঞ্চাশটি ব্যতিক্রমী গদ্যের সমাহারে তৈরি হয়ে উঠেছে এই বই। ভিন্ন স্বাদের এইসব লেখার ভেতর খুঁজে পাওয়া যাবে লেখকের অনুসন্ধিৎসু মন এবং দৃষ্টির নিরপেক্ষ বিন্যাস। লেখকের সরস গদ্যের নমুনায় এই বই নতুনতর সংযোজন।"

মেঘে মেঘে তারায় তারায়- সুধীর চক্রবর্তী

মুদ্রা প্রকাশনা

মূল্য -৩৫০.০০

More Articles