উত্তম কুমার: ফিরে পড়া এক সিনেমাজীবন

প্যারাডাইস, নিউ এম্পায়ার, মেট্রো ছিল এককালীন কলকাতার এলিট ভদ্রলোকেদের একচেটিয়া। রমরমিয়ে কলকাতার বুকে তখন হলিউডের সিনেমা চলছে। বাংলা সিনেমাকে কে পোছে? সিনেমা ব্যাপারটাই খুব একটা আম পাবলিকের জন্য ছিল না। উপনিবেশের শিকড়ে জন্মগত আভিজাত্য নিয়েই সে এদেশে এসেছিল। কাজেই সরাসরি বিদেশি পুঁজিচালিত বড় বড় আন্তর্জাতিক প্রোডাকশন হাউসগুলিই মূলত ইংরেজি সিনেমা চালাত। অন্তত ১৯৫৩-র আগে অবধি তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। মেট্রোয় সিনেমা দেখে কলকাতার বাবু বিবিরা পাশেই বিখ্যাত ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ ফিরপো’জ-এ রোস্ট ডাক, প্রেসড্‌ বিফ, হ্যাম পাই, পম্ফ্রেট ফিলেট উইথ টারটারে সস–এইসব খেতেন। চৌরঙ্গীর পরিবেশের সঙ্গে যা ছিল দিব্য মানানসই। কিন্তু বছর পাঁচেকের ব্যবধানে মধ্যে এমন কিছু একটা ঘটল যাতে করে এইসব এলিট হলগুলো বাংলা সিনেমাকে জায়গা শুধু ছাড়তে বাধ্যই হল না, কলকাতার বুকে হলিউডের তৎকালীন একাধিপত্যও ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কী এমন ঘটল? উত্তরে তুলসী লাহিড়ির কথায়, ‘সে কি ভুলিবার ধন…” গাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ দিনের শেষে যা পড়ে থাকে তার সবটাই নিপাট জাদু। ম্যাজিক। ১৯৫৩ সালে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের কাছে প্যারাডাইস সিনেমায় মুক্তি পায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ঠিক তার তিন বছর পরে ১৯৫৬তে নিউ এম্পায়ারে মুক্তি পাচ্ছে দেবকী বসুর ‘চিরকুমার সভা’। এবং ১৯৫৭র ১৪ নভেম্বর মেট্রো সিনেমায় ‘চন্দ্রনাথ’। এবং তিনটিই ‘ইংলিশ ফিল্ম অনলি’-র শর্ত ভেঙে হলগুলিতে দেখানো প্রথম বাংলা সিনেমা। যোগসূত্র কী? উত্তম।

তবে মেট্রোর ঘটনাটি একটু বিশেষ। কারণ যে সময় মেট্রোতে ‘চন্দ্রনাথ’ চলছে সে সময় সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় নামের এক ভদ্রলোক ছিলেন মেট্রোর চিফ প্রজেকশনিস্ট। ততদিনে উত্তম বাংলার এক এবং অদ্বিতীয় তারকা হয়ে গিয়েছেন। নিজের হলে নিজে প্রথমবার উত্তমের ছবি চালিয়ে পর্দায় অভিনয় দেখতে দেখতে সাতকড়ি আবেগ সামলাতে পারেননি। কারণ, পর্দার নায়ক তাঁরই জেষ্ঠ্যপুত্র। সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘদিন মেট্রোতে কাজ করেছেন, তার আগে কাজ করেছেন এলফিস্টোন পিকচার প্যালেসে। কিন্তু তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি একদিন চৌরঙ্গীর মাঝখানে বসে মেট্রো হলে একটা বাংলা ছবি চালানো যেতে পারে যা কিনা লোকে হই হই করে দেখতে আসবে। সেই কলরবই উত্তমের স্টারডমের সবথেকে বড় অর্জন। প্রজেকশনিস্টের ঘরে জন্মের সূত্রে উত্তম একরকম পর্দার পিছনের দিকটায় জন্মেছিলেন। সেখানে থেকে মধ্যবিত্তের যাবতীয় বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তাঁকে পর্দার সামনে উঠে আসতে হয়েছিল। কাজেই মহানায়কের স্টারডমে কোনও আভিজাত্যের জায়গা না থাকাই স্বাভাবিক। 

এই বইটি সেই দীর্ঘ পথ, সাধনার শ্রমকে কুঁদে কুঁদে ফুটিয়ে তুলেছে মহাকালের গায়। অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের নিজস্ব সংগ্রাম, অভিনয়ের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য—তারকা উত্তমের গড়ে ওঠায় এদের ভুমিকা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনই অনস্বীকার্য দর্শকদের মনোভাবের আঙ্গিকটিও। তারকা আসে, তারকা ঝরে যায় মহাকাশের অন্ধকারের গর্ভে। অথচ কিছু তারা অবিকল থাকে মৃত্যু পেরিয়েও কত কত বছর। কেবলমাত্র দূরত্বের কারণে। এই দূরত্বের খোঁজই সায়নদেব বাবুর ‘উত্তম কুমার–আ লাইফ ইন সিনেমা’। বাংলার আর্ট ফিল্ম নিয়ে যত চর্চার যা বহর এবং বয়েস, তুলনামূলকভাবে পপুলার ছবি নিয়ে গবেষণামূলক চর্চা অত্যন্ত নতুন এবং ক্ষীণকায়। এবং সায়নদেববাবু খেয়াল করে আশ্চর্য হয়েছেন, বাংলায় বা ইংরেজিতে উত্তমের এই সত্তর বছরব্যাপী জনপ্রিয়তার পিছনের কারণ ঠিক কী তা নিয়ে তেমন জুতসই কোনও কাজ হয়নি। জীবনী যে কেবল অভিনেতার জীবনটুকু নয়–এই বোধের অভাব রয়েছে অন্তত উত্তমের অতি সুলভ জীবনীগুলিতে। ইংরেজিতে হাতে গোনা তিনটি বইয়ের উল্লেখ করেছেন লেখক। কিন্তু কোনওটিই তর্কে তেমন দড় বলে মনে হয়নি তাঁর। কাজেই দীর্ঘ সতেরো বছরব্যাপী এই কাজ। এবং উত্তমের উপরে একাধারে এত যৌক্তিক ও কাব্যিক কাজ সত্যিই বিরল। বিশেষত উত্তম বাঙালির জীবনে এত চর্চিত একটি ক্ষেত্র, যে সেখানে নতুন একটি দৃষ্টিকোণ তুলে আনা সম্ভব–এ বোধহয় এ বইটি না পড়লে অজানা রয়ে যেত।

দশটি অধ্যায়ে ধাপে ধাপে ‘মহানায়ক’কে বিনির্মাণ করেছেন লেখক। কোথাও ছড়িয়ে গিয়েছে মহানায়কের সেই বিখ্যাত হাসি, আবার কোথাও তাকে দাঁড় করানো হয়েছে দৈত্যপ্রতিম বাংলা সিনেমার ঐতিহাসিক পটভূমিকায়। হীরালাল সেন থেকে যে ঐতিহ্যের শুরু, সেই কলকাতার সিনেমা ‘বাংলা সিনেমা’ হয়ে উঠল সবাক সিনেমার যুগটিতে। দুর্গাদাস ব্যানার্জীর মতো প্রথম ম্যাটিনি আইডলের জন্ম বাংলা সিনেমার সঞ্চয়ে ছিল। ছিল প্রমথেশ বড়ুয়ার মতো প্রভাবশালী অভিনেতার ইতিহাস। কাজেই সেই সব দৈত্যদের পরে মানুষ উত্তমকে তেমন পছন্দ হয়নি প্রাথমিকভাবে দর্শকদের। অভিনয়ের তেমন কোনও প্রশিক্ষণ তো ছিলই না, ছিল না আগের নায়কদের মতো অভিজাত বংশমর্যাদাও। রাজকীয়তাহীন সামান্য কেরানি। অভিনয়ের সেই চড়া সুর প্রথমদিন থেকেই উত্তমের ছিল না। লোকে তাকে নতুন দুর্গাদাস বলে ভেঙিয়েছে। লাগাতার খান কুড়ি সিনেমা ফ্লপ প্রায় বছর পাঁচ ছয় ধরে। ফ্লপ-মাষ্টার জেনারেল নাম হয়ে গিয়েছিল সিনেমা জগতে। কেউ চট করে ছবিতে নিতে চাইতেন না। এমন একটা অবস্থান থেকে নিজেকে তিনটি দশক জুড়ে বাংলা সিনেমার এক এবং অদ্বিতীয় মহানায়কের স্তরে নিয়ে যাওয়াটা আর যাই হোক মামুলি ব্যাপার ছিল না। এবং এই ‘এক এবং অদ্বিতীয়’ খেতাব তাঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ।

বঙ্গভঙ্গ-উত্তর বাংলা সিনেমা এই দশকের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে ছিল অন্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বিয়াল্লিশের মন্বন্তর, দেশভাগ, দাঙ্গা, বিপুল উদ্বাস্তু সমস্যা—এ সবের ফলে বাংলার সমাজজীবনে যে ব্যাপক ভাঙাগড়া চলছিল নিরন্তর, তাকে ধরার মতো প্লট দিতে অক্ষম হয়ে পড়ছিল সিনেমা। উত্তমের অভিনয়জীবনে ‘বসু-পরিবার’ প্রথম এমন একটি ছবি, যা ‘ভদ্র’বাড়ির অতীত এবং নতুন মূল্যবোধের মধ্যেকার দ্বন্দ্বটি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল। মূলত চল্লিশের দশক পেরিয়ে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার থেকেই সমকালীন কাহিনীকে ধরার একটি ঝোঁক লক্ষ্য করা যায় বাংলা সিনেমায়। সিনেমা নাগরিক। সিনেমা নাগরিকতার সন্তান। কাজেই নগর নামের এই বিশেষ ক্ষেত্রটিকে আধুনিকতার ভাষ্য দিয়ে দেখার অপর নাম হয়ে ওঠে সিনেমা। প্রযুক্তি যে আধুনিকতার অন্যতম অঙ্গ, সেই প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে একটি আয়না নির্মাণ করে আধুনিক নগর সভ্যতা। এই আয়নাই হল সিনেমা। যাতে টুকরো টুকরো বহুধা বিভক্ত জীবনের একীভূত প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। এই বহুধা টুকরো গুলির ভাঙা ভাঙা দাগ মিলিয়ে দেয় যে ম্যাজিক, তাকেই আমরা আধুনিকতা বলে থাকি, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী বলে থাকি। এই পুনর্নির্মিত শহর আসলে সিনেমাটিক সিটি। তা বাস্তব শহর নয়। নানা ঘটনায় বিপর্যস্ত হয়ে নিজের মুখ দেখতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন সিনেমার নাগরিক দর্শকেরা। একটু একটু করে জমে উঠছিল এক ব্যাপক অভাববোধ। কিন্তু অতীতকেন্দ্রিক রোমান্সের ভিড় শ্বাস নিতে দিচ্ছিল না তাঁদের। ঠিক এমন এক সময় অত্যন্ত স্বাভাবিক অভিনয় এবং সমসাময়িক গল্পের মেলবন্ধনের মাঝে এসে দাঁড়ালেন উত্তম। যে বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁকে হেয় করা হয়ে আসছিল এযাবৎ, তাঁর সেই অতিসাধারণ চেহারা, স্বাভাবিক অভিনয়, মধ্যবিত্ত অতীত–সমস্তই অত্যন্ত উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল দর্শকদের কাছে।

এর সঙ্গে রয়েছে মেলোড্রামার আঙ্গিকের গুরুত্ব। সায়নদেববাবু দেখাচ্ছেন, মেলোড্রামার ধারণাটি যুগে যুগে বদলে গিয়েছে। এবং একেকজন ব্যক্তি, একেকটি যুগ মেলোড্রামাকে নিজের মতো করে ব্যবহার করেছে। এই রেঞ্জ বোঝা যায় অজয় করের ছবির পাশে ঋত্বিকের ছবি রেখে দেখলে। তাই আর্ট ফিল্মের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে চলতিধারায় এমনভাবে এক ঝাঁক মেলোড্রামার পরিচালক উঠে আসছেন এ সময়ে যাঁদের সঙ্গে একাত্ম হতে আমজনতার কোথাও অসুবিধা হচ্ছে না। তবে বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ ইমেজের একান্ত প্রতিফলন পর্দায় উত্তমের চরিত্র ঘিরে গড়ে উঠলেও আশ্চর্যের ব্যপার উত্তমের ভক্তের ক্ষেত্রটি শুধু ‘ভদ্রলোক’ বৃত্ত এবং ‘নাগরিক’ বৃত্তের মধ্যেই আটকে থাকছে না। এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। প্রত্যন্ত গ্রামে শুটিং করতে গিয়ে বহুবার এমন ভিড়ের পাল্লায় পড়তে হয়েছে উত্তমকে। নদীর মাঝে নৌকায় শুটিং চলাকালীন ‘গুরু’র নাগাল না পাওয়ায় উন্মত্ত জনতা পাড় থেকে কাদাও ছুঁড়েছে তাঁদের দিকে। উত্তম এমন এক সেতু যাঁকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক বলয়গুলি অনেকটা হলেও একে অপরের গায়ে জড়িয়ে গিয়েছিল। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ, নেতাজীর ছবির সঙ্গে উত্তমই একমাত্র ব্যক্তি আজও সেলুনে, চায়ের দোকানে যার ছবি দেখতে পাওয়া যায়, যার ছবি বিক্রি হয়, তখনও হতো। বাঙালির কৃষ্টির সঙ্গে এভাবে অঙ্গাঙ্গী মিশে যাওয়া আর কোনও অভিনেতার পক্ষে সম্ভব হয়নি সম্ভবত। আজও মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরা এক জায়াগায় আড্ডা দিতে বসলে একবার না একবার উত্তমের কথা ওঠেই। এদেশের বামেরা ব্যাপারটাকে অপসংস্কৃতি বলতে চেয়েছে যদিও বহুদিন। কিন্তু তারা যেটা বুঝতে চাননি বা পারেননি, রবীন্দ্রনাথের মতো বা নেতাজির মতো বাঙালি সমাজে উত্তম অবদান রেখেছেন কিনা এক্ষেত্রে বিচার্যই নয়, হতে পারে না। সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে উত্তমের ব্যপ্তি কতটা, সেইটেই দেখার।

বইটির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল রচনার ভঙ্গিমাটি। অরুণ চ্যাটার্জি ও উত্তমকুমার–এই দুজনের মধ্যের দ্বন্দ্বটিকে তুলে ধরতে একদিকে জীবন অন্যদিকে কাজগুলিকে দাঁড় করিয়ে মাকু চালিয়েছেন লেখক। পরতে পরতে বইটি এমন এক বিরল জীবনীর নজির টেনেছে যেখানে জীবন এবং কাজ পরস্পরকে বুনে চলেছে। আর এই সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি যে প্রবল শব্দ তৈরি করছে, সেই শব্দে ফুটে উঠছে ক্লান্ত হতাশ দ্বিধাগ্রস্ত এক মানুষ। উত্তমকে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি বস্তুত ব্যবহার করেছে। সত্যজিতের দুটি ছবি এবং তপন সিনহা, পীযুষ বসু, যাত্রিক, সুকুমার দাশগুপ্ত, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গল চক্রবর্তী প্রভৃতি পরিচালকের খান চল্লিশেক মাস্টারপিস ছাড়া একের পর এক সেই একই ফরমূলায় ফেলা সিনেমার চাপের নিচেই একরকম শেষ হয়ে গিয়েছেন অরুণ চ্যাটার্জী। সমস্ত ষাটের দশক জুড়ে নিজের বাঁধাধরা গতকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে আসছেন উত্তম। এ চেষ্টা স্টারডমের ক্ষেত্রে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা আমরা চারপাশে একবার তাকালেই বুঝতে পারব। অথচ নিজের খ্যাতির শীর্ষে ‘নায়ক’-এর মতো ছবিতে সেই খ্যাতিকেই বিনির্মাণ করতে বিন্দুমাত্র ভয় পাননি উত্তম। আর তাঁকে কেন্দ্র করে ব্যবসার চেষ্টার লোভে ইন্ডাস্ট্রি এমনভাবে নিজেকে পঙ্গু করে ফেলল, যে তখন উত্তম “বিনা তারণের গতি নাই”। এই বিপুল চাপ আমরা দেখি সত্তরের দশকের ছবিগুলিতে। একদিকে রাজনৈতিক জগতের বিরাট ওলটপালট। তার মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে একের পর এক বাজে ছবি করে যেতে হচ্ছে উত্তমকে। আর যত বাজে ছবি করছেন তত ইন্ডাস্ট্রি দুর্বল হচ্ছে। এই প্যারাডক্সের মাঝে উত্তম পিষে যাচ্ছেন। অভিনয়ের থেকেও তখন বড় হয়ে উঠেছে অতগুলো পেটের দায়িত্ব। সিনেমাদের রুজিরুটি জড়িয়ে। খ্যাতির প্রথম দিন থেকে উত্তমের এ বৈশিষ্ট্য শেষদিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। সিনেমার সঙ্গে জড়িত লোকজনের কাছে ছিলেন মহীরুহ। কতলোককে কতভাবে সাহায্য করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

নিজের ছবি চলার বিরুদ্ধে এই মানুষগুলির দাবিতে অবরোধে পর্যন্ত বসেছেন নিজেই। মানুষ উত্তমের এই বিপুল দায়িত্ব কোথাও গিয়ে অভিনেতা উত্তমের পথ অবরুদ্ধ করে ফেলছিল। শেষদিকে সত্যজিতের ছবিতে যে কোনও চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছা পর্যন্ত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সে ইচ্ছে পূর্ণ হওয়ার আগেই যাবতীয় চাপ বুকের পেশিতে নিয়ে চলে গেলেন মহানায়ক। অভিনেতা উত্তম মানুষের কাছে কী তা সেদিন দেখেছিল কলকাতা। কিন্তু মানুষ উত্তমের খোঁজ পাওয়া যায় তাঁর মৃত্যুর পরে বিভিন্ন সময়ে সিনেমার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন স্তরের মানুষের কথাবার্তায়।

 

এরপরে এল টেলিভিশন। আপামরের উত্তমভক্তি মধ্যবিত্তের ঘরের ভিতর এসে দাঁড়াল। কলরব কোথাও গিয়ে আত্মসমর্পন করল নীরবতায়। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০–মধ্যবিত্তের জীবনযাপন কিন্তু টেলিভিশনের যুগে এর থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছে। পরিবর্তন হয়েছে আরো এবং আরো দ্রুততর। অথচ উত্তমের স্টারডম রয়ে গিয়েছে। সায়নদেব তাঁর যাবতীয় যুক্তি এইখানে এসে কালের বেদীতে নামিয়ে রেখেছেন। কেবল নষ্টালজিয়া দিয়ে এর ব্যাখ্যা হয় না। কেবল নষ্টালজিয়ায় জারিত হয়ে এত লম্বা বাঁচতে পারে না কোনও মানুষের ছায়া। ছবির সেই সব ছায়ারা আজও বাঙালির মুখ থেকে মননে ঘোরে। কখনও ময়রা স্ট্রিটের নতুন নামের ছায়ায় জিরোয় কিছুক্ষণ। টালিগঞ্জ মেট্রোর বেঞ্চে একা বসে থাকে। কিন্তু দলীয় রাজনীতির উগ্র গন্ধ সেইসব জায়গায় তাদের টিকতে দেয় না। চিরকাল বাম ডান কোনও দলীয় রাজনীতিকেই মেনে নিতে না পারা মানুষটির ছায়াছবিরা তাই ফিরে আসে হয়তো বাংলার বৃহত্তম ক্ষেত্রটিতে। কখনও পর্দায়, কখনও পার্কে, কখনও চায়ের ঠেকে, কখনও অজয়ের ধারে ধারে তাদের দেখা যায়। মুখে ফেনা তোলা চাকরির মাঝে হয়তো হঠাৎ কোনও যুবকের মনে পড়ে ‘গুরু’র কথা,  কলকাতার কোনও প্রাচীন জীর্ণ বাড়ির দোতলা থেকে গ্রামোফোন বাজে, গুরুর লিপে মান্নার গলায় “বড় একা লাগে এই আঁধারে”, নিম শহরে একা একটা বেতের চেয়ারে বসে ব্যালকনি থেকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কোনও বৃদ্ধা স্মরণ করেন তাঁর চিরকালীন প্রেমকে, আবার গাঁয়ের মলিন ঘরে কোথাও চোরা কয়লার গুঁড়োয় কালো টিভির পর্দায় কোনও দম্পতি সেই বই দেখতে দেখতে মমত্বে ভিজিয়ে নেয় সারা দিনের ক্লান্তি। মহানায়ক এমনই এক অস্তিত্ব। অন্তত বাঙালির কাছে তো বটেই। বাঙালির কাছে তো বটেই।

 

বই–UTTAM KUMAR, a life in cinema, By Sayandeb Chowdhury, bloomsbury
দাম- ৬৯৯ টাকা

 

More Articles