কেমন ছিল, কেমন হল বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়ন
গায়ে গায়ে সাজানো রয়েছে টেবিল। তার উপর মেলে রাখা হরেক রকমের পত্র-পত্রিকা। বিকিকিনি চলছে আনন্দে। দশটা-পাঁচটা টিউবের আলোয় যেন গমগম করছে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন। আপামর বইপ্রেমীদের মিলনক্ষেত্র। অবশ্য সকলেই যে বইমেলা এসে লিটল ম্যাগাজিনে-র সন্ধান করেন এমনটা নয়। অনেকেরই বইমেলা-র আশা আকাঙ্খা ঘিরে থাকেন কেবলমাত্র বড় প্রকাশকরা। তাঁদের স্টলের বাইরেই তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দেন। সংগ্রহ করেন নতুন প্রকাশিত যা কিছু। তবু এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায় আজও বুক ফুলিয়ে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে রয়েছে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়ান। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয় বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’। তার ঠিক পরে পরেই আবির্ভূত হয় ‘সম্বাদ প্রভাকর’ বা ‘সমাচার চন্দ্রিকা’-র মতো পত্রিকা। ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন মনে করতেন এ সমস্ত পত্র-পত্রিকার মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষা উন্মুক্ত হয়েছিল। ‘সমাচার দর্পণ’-কে ঠিক লিটল ম্যাগাজিন বলা চলে না। কিন্তু এখানে যা দেখা যাচ্ছে তা হল, আধুনিক যুগে নানান সময় এই পত্র-পত্রিকাই নতুনত্বের বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে। আর সেই বার্তাকেই দশকের পর দশক ধরে সানন্দে গ্রহণ করেছেন সাধারণ মানুষ।
বইমেলা-র শুরুটা অনেকের কাছেই ছিল অন্ধকার যুগের পর একরাশ আলোর মতো। সাহিত্যিক প্রবুদ্ধ মিত্র বলছিলেন, ‘একটা উত্তাল দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর প্রথম বইমেলা যখন হয় তখন স্বাভাবিভাবেই আমাদের উৎসাহ উদ্দীপনা অত্যন্ত প্রবল ছিল, তার কারণ হচ্ছে যে আমরা তখন সবে লিখতে শুরু করেছি। লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে আমাদের একটা আবেগ ছিল সেই সময়। এবং ঠিক তখনই বইমেলা-টা শুরু হয়।’ সে ছিল সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। স্মৃতিতে তখনও রয়েছে নকশালবাড়ি আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বীভৎসতা। বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ তখন স্তিমিত। কিন্তু কলকাতার আনাচেকানাচে হঠাৎ দেখা যায় অগ্নিযুগের নানান দেওয়াল লিখন, ‘তোমাকে আমাকে দিচ্ছে নাড়া, মাও সে তুঙ-এর চিন্তাধারা,’ বা ‘বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।’ শহর ভোলেনি অভ্যুত্থানের ঘটনাবলীকে। এমতাবস্থায় প্রথম শুরু হল ‘কলকাতা বইমেলা’।
গোড়ার দিকে বইমেলার পরিসরটা ছিল অত্যন্ত ছোট। লিটল ম্যাগাজিনের জন্য আলাদা কোনও প্যাভিলিয়নের ব্যবস্থা সে সময় করা হয়নি। কিন্তু তাতেও ছোট পত্রিকা-র প্রকাশক এবং অনুরাগীরা দমে গেলেন না। চোখে একরাশ শাস্ত্রবিরোধী মস্তানি নিয়ে তাঁরা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে পত্রিকা-র পসরা সাজিয়ে বসলেন। সে সব দিনকাল আজও তাজা প্রবুদ্ধবাবু-র স্মৃতিতে। বলছিলেন, ‘যে ক’দিন বইমেলা চলত সে ক’দিন লিটল ম্যাগাজিনে-র তাঁবুতেই থাকতাম আমরা। সেই প্রত্যেকটা দিন আমরা বিকেল থেকে সেখানে হাজির থাকতাম, কখনও কখনও দুপুর থেকেও হাজিরা দিতাম।’ তাঁর কথায়, ‘বেকারত্বের মধ্যেও নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে একটা পত্রিকা করে সেটা পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার যে চেষ্টা আমরা করছিলাম, তা নিয়ে সে সময় সাহিত্য জগতে যথেষ্ট আলোড়ন পড়েছিল।’ বইমেলায় তখন বিনামূল্যে প্রবেশ করা যেত না, টিকিত কাটতে হত। তারপর কলকাতা বইমেলা ময়দানে উঠে আসার পর টিকিট ব্যবস্থা আস্তে আস্তে উঠে গেল।
প্রবুদ্ধবাবুদের পথিকৃৎদের মধ্যে সে সময় অন্যতম ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। বইমেলায় বই ফিরি করার এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। মাঠের মধ্যে সোজা মই খাটিয়ে তিনি তার উপর উঠে দাঁড়াতেন, তারপর নিজের সদ্য প্রকাশিত মিনি বুক-গুলো তাসের মতো করে মেলে ধরে জোর গলায় হাঁক পাড়তেন। এ সকল ঘটনা আজ ইতিহাস হয়ে আছে। নিজেদের পূর্বসূরিদের দেখেই খানিকটা উৎসাহিত হয়েছিলেন প্রবুদ্ধবাবু-রা, এবং সেই রীতি মেনেই খোলা মাঠে কাগজ পেতে তাঁরা বসে পড়তেন নিজেদের পত্র-পত্রিকা নিয়ে। তাঁদের সেখান থেকে তুলে দেওয়ার মতোও অবশ্য কেউ ছিল না। কলকাতা বইমেলা-র বৈশিষ্ট্যই হল, এখানে ছোট থেকে বড় সমস্ত ধরনের প্রতিষ্ঠান আগাগোড়া শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করেছে।
এর কয়েক বছরের মধ্যেই কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে একটা লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে-র ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। আজকের দিনে বইমেলা গেলে যে বর্ণময় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন-কে আমরা দেখি, তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকল্প ধারার প্রকাশক ও পাঠকদের বিপুল পরিশ্রম। তার এই সমগ্র যাত্রাপথকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন প্রবুদ্ধবাবু। তিনি বেশ কিছুটা প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলছিলেন, ‘এই যে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন হল, তারপর থেকে তাকে কেউ আর নিজের জায়গা থেকে সরাতে পারেনি। লিটল ম্যাগাজিন স্বমহিমায় নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। ক্রমশ লিটল ম্যাগাজিনের টেবিল বা কাগজের সংখ্যা বেড়েছে, উৎসাহী প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে, বইমেলায় ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে তার।’ এই লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন-কে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে কত মজার গল্প। সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী-র একটা বই ছিল, ‘ভূতগুলো সব গেল কোথায়?’ একবার ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ সে বইয়ের ব্যানারটা টাঙালো লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের দিকে মুখ করে। ‘আনন্দ’ সে সময় ছিল বাংলা প্রকাশক জগতের অন্যতম কুলীন প্রতিষ্ঠান। ফলত, বহু লিটল ম্যাগাজিন অনুরাগী মনে করেছিলেন যে তাঁদের খানিকটা টিটকিরি দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই এমনটা করা হল।
করোনাকালের স্তব্ধতার পর এ বছর ফের বিপুল কোলাহলে সেজে উঠেছে বইমেলা। যদিও মানুষজনের ভিড় গতবারের তুলনায় খানিকটা যেন কম। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টা এবার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নেকে কেন্দ্র করেই ঘটে গেছে। যে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন আগে ছিল অখণ্ড, তাকেই এবার তিন ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এই তিনটে ভাগই পড়েছে কলকাতা বইমেলা-র তিন প্রান্তে। গিল্ড কর্তৃপক্ষ অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, যে হারে প্রতি বছর পত্রিকার সংখ্যা বাড়ছে, তাতে করে এক জায়গায় সকলকে স্থান দেওয়া আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। যদিও এ ব্যবস্থায় লিটল ম্যাগাজিনের অনুরাগীরা বেশ খানিকটা হতাশই হয়েছেন। গিল্ড কর্তৃপক্ষকে সে কথা জানিয়েওছেন তাঁরা। আশা করা যায়, পরের বছর থেকে ঐতিহ্যবাহী লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের প্রতি সুবিচার করবেন গিল্ড কর্তৃপক্ষ।