নীরবে এই রোগ প্রাণ কেড়েছে ঐন্দ্রিলার! প্রতি বছর আক্রান্ত দু'কোটি, কীভাবে সতর্ক হবেন
Brain Stroke: আগামী দিনে ভারতীয়দের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
নিঃশব্দে জীবন কেড়ে নিতে পারে ব্রেন স্ট্রোক। দু'বার ক্যানসার থেকে সেরে উঠে দিব্যি ভালোই ছিলেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা। কিন্তু ১ নভেম্বর ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই ফের জীবনযুদ্ধ শুরু হয় তাঁর। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের প্রায় দু'কোটি মানুষ প্রতি বছর ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন । সংখ্যাটা চমকে ওঠার মতোই। এই আক্রান্তদের তালিকায় আমাদের চেনাজানা বহু মানুষই রয়েছেন ঐন্দ্রিলার মতো। অন্য আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি চার জনে একজন ব্যক্তি যে কোনও সময় যে কোনও পরিস্থিতিতে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। অথচ একটু সজাগ থাকলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব এই নীরব ঘাতককে।
ভারতে স্ট্রোক এপিডেমোলজির একটি সমীক্ষা অনুসারে, গত চার দশকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে স্ট্রোকের ঘটনা প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে। অনুমান করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর ৮০ শতাংশই হবে মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে। আগামী দিনে ভারতীয়দের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন: ইউয়িংস সারকোমাই প্রাণ কাড়ল লড়াকু ঐন্দ্রিলার! কী উপসর্গ এই মারণ রোগের?
স্ট্রোক কী?
চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ভাষায় স্ট্রোককে সেরিব্রোভাসকুলার অ্যাকসিডেন্ট বলা হয়। আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন, স্ট্রোক হৃৎপিণ্ডের সমস্যা, যা একেবারেই ঠিক নয়। স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহজনিত দুর্ঘটনা। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের শরীরের প্রতিটি কোশে, এমনকী, মস্তিষ্কের কোশগুলিতেও অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত সঞ্চালন প্রয়োজন। কোনও কারণে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনীর পথ সংকীর্ণ হয়ে বা বাধাপ্রাপ্ত হলে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় ,আবার রক্তনালি ছিঁড়েও যেতে পারে। ফলস্বরূপ অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের কোশগুলি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এই অবস্থাকেই চিকিৎসকরা স্ট্রোক বলে থাকেন।
মূলত দু'রকমের স্ট্রোক হয়। ইসকেমিক স্ট্রোক এবং হেমারেজিক স্ট্রোক। এর মধ্যে হেমারেজিক স্ট্রোকে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনির দেওয়াল ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে স্নায়ু কোষগুলি নষ্ট হয়ে যায়। রক্তবাহী ধমনির দেওয়ালে রক্তচাপ খুব বেড়ে গেলে নালি ফেটে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের কারণেই ইসকেমিক রোগে আক্রান্ত হন কোনও ব্যক্তি। ইসকেমিক স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো হাতের প্যারালিসিস। এক্ষেত্রে স্ট্রোকের কিছুক্ষণ আগেই থেকেই এই লক্ষণ দেখা দিতে পারে। হাতে ব্যথার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে হাত তোলা সম্ভব হয় না।
স্ট্রোকের লক্ষণ
• শরীরের কোনও একদিক অবশ হয়ে যায়। অনেক সময় হাত-পা অসাড় মনে হয়,ফলে আক্রান্ত রোগী অকেজো হয়ে পড়েন।
• হঠাৎ কথা জড়িয়ে যায়, আবার অনেকের ক্ষেত্রে মুখ বেঁকেও যেতে পারে।
• হাঁটতে অসুবিধা এবং রোগীর শরীর যে-কোনও একদিকে হেলে যায় অর্থাৎ শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন রোগী। ফলস্বরূপ মস্তিষ্কের কোশগুলি শরীরের যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করে সেই অংশ প্যারালাইজড হয়ে যায়।
• হঠাৎ প্রচণ্ড মাথা ব্যথার সঙ্গে বমি হওয়া এবং প্রস্রাব ধরে রাখতে পারে না স্ট্রোক-আক্রান্ত রোগী।
কাদের ঝুঁকি বেশি?
উচ্চ রক্তচাপসম্পন্ন রোগীদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যোধপুর এইমসের চিকিৎসক পঙ্কজ ভরদ্বাজের মতে, "স্ট্রোক এবং উচ্চ রক্তচাপের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে, তার হাজার একটা প্রমাণ রয়েছে।" প্রতি বছর স্ট্রোক আক্রান্তদের ৭০ শতাংশই প্রথমবার আক্রান্ত হন তাই একেবারে গোড়া থেকেই উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করছেন চিকিৎসকেরা। এ-প্রসঙ্গে অভিজ্ঞ কার্ডিওলজিস্ট সুরিন্দর দেওরা জানিয়েছেন, "স্ট্রোক-আক্রান্ত রোগীদের ৫০ শতাংশই বাকি জীবনের জন্য প্রতিবন্ধী হয়ে যান ফলে স্ট্রোকের আর্থসামাজিক প্রভাব মারাত্মক।"
রক্তচাপজনিত সমস্যা ছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি এবং অত্যধিক ধূমপানও স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। তাই এই ধরনের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। তবে সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতের ৮৫.৭ % মানুষ স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতন নয়। ভারতের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যেভাবে স্ট্রোক-আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়।
স্ট্রোকের চিকিৎসা
স্ট্রোক আক্রান্ত হলে সেই ব্যক্তিকে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এই সময়ের মধ্যে রোগীর চিকিৎসা শুরু হলে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবন্ধকতাগুলিকে কমানো যেতে পারে। সাধারণত সিটি স্ক্যান, এমআরআই করে রোগীর স্ট্রোক নিশ্চিত করা হয়। স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা সাধারণত মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এই প্রক্রিয়ায় একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে রোগীর রক্তনালীতে জমাট বাঁধা রক্ত অপসারণের মাধ্যমে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।
তবে মারাত্মক রক্তপাত হলে মাথার হাড় কেটে ক্ষতিগ্রস্ত অংশটিকে চাপমুক্ত করা হয়, চেষ্টা করা হয় যেন সুস্থ অংশ আক্রান্ত না হয়ে পড়ে। একে বলা হয় ডিকম্প্রেস ক্র্যানিয়াকটমি।
স্ট্রোক রুখব কীভাবে?
• স্রোক আটকাতে অবশ্যই সুগার, প্রেশার এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
• শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখা আবশ্যক, তাই নিয়ম করে আধঘণ্টা হাঁটা আবশ্যক।
• বাড়িতে রান্না করা টাটকা সবজি ও মাছ-মাংস খেতে হবে। তবে বাইরের খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।
• ধূমপান, মদ্যপানের মতো বদভ্যাস ছাড়তেই হবে।