বর্ধমানের রানি বসন্তকুমারীর পরকীয়া ও প্রথম বিধবাবিবাহ ।। ফিরে দেখা নাটকীয় আখ্যান
প্রায় দুই শতাব্দী আগে, ১৮২১ সালে, বর্ধমানের রাজপরিবারে যে নজরকাড়া ঘটনাটি ঘটে, তার সঙ্গে একমাত্র ঢাকার ভাওয়াল সন্ন্যাসীর ঘটনার তুলনা চলে। হুবহু একই ঘটনা ঘটে বর্ধমানের 'ছোট রাজা' প্রতাপচাঁদের সঙ্গে। ১৮২১ সালে কালনার 'টপ্পা'-ঘাটে তাঁর অন্তর্জলি যাত্রা, তাঁর মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা এবং তারও ঠিক ১৪ বছর পরে গোলাপবাগ ফটকের কাছে নাটকীয়ভাবে সন্ন্যাসী রূপে সেই রাজার ফিরে আসা, এবং ১৮৩৮ সালে চুঁচুড়া কোর্টে শুরু হওয়া সেই সাড়াজাগানো ঐতিহাসিক জাল সন্ন্যাসী মামলা– এইসব নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বর্ধমান রাজপরিবারের সিংহাসনে পালাবদল হয়েছিল।
ষড়যন্ত্র, প্রতারণা আর ক্ষমতা দখলের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই মহারাজা তেজচাঁদের বিধবা বালিকা বধূ বসন্তকুমারীর পরকীয়া এবং পরপুরুষের সঙ্গে রাজত্ব ত্যাগ করে নতুন জীবনের মুক্তিসন্ধান পর্বটিও ছিল এক রূদ্ধশ্বাস নাটকীয় ঘটনা। তখনও বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্তৃক বিধবাবিবাহ প্রথা চালু হয়নি, কিন্তু বসন্তকুমারী তখনকার সমাজের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে বিধবাবিবাহ করার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন। তখনকার ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজকে তোলপাড় করে দিয়েছিল এই ঘটনাটি।
মহারাজা তেজচাঁদের আট জন মহিষীর মধ্যে মহারানি বসন্তকুমারী (১৮১৬-১৯০০) ছিলেন সর্বকনিষ্ঠা। এককথায় বৃদ্ধ তেজচাঁদের বালিকা বধূ। এই বিবাহ মহারাজের অনিচ্ছায় হয়েছিল। প্রতাপচাঁদের মৃত্যুর, মতান্তরে নিরুদ্দেশ হওয়ার কিছু পরেই মহারানি কমলকুমারীর ভ্রাতা এবং মহারাজ তেজচাঁদের শ্যালক পরাণচাঁদ কাপুর সিংহাসন দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। বলা বাহুল্য যে, বরাবরই মহারাজের সম্পত্তির ওপর তাঁর প্রবল লালসা ছিল। তিনি ভগিনী কমলকুমারীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নিজ পুত্র সাত বছরের চুনিলালকে দত্তক নেওয়ালেন এবং এগারো বৎসরের অসামান্যা রূপসি কন্যা বসন্তকুমারীর সাথে বাষট্টি বছরের বৃদ্ধ মহারাজা তেজচাঁদের বিবাহ দিলেন। একটা বড় রকমের ফাঁদ তৈরি করলেন নিজ বংশকে রাজবংশের উত্তরাধিকারী করার জন্য।
১৮৩২ সাল, মহারাজা তেজচাঁদ প্রয়াত হলেন। আট জন রানির মধ্যে ছ’ জন আগেই গত হয়েছেন। বেঁচে আছেন শুধু কমলকুমারী এবং বসন্তকুমারী। নিতান্ত নাবালিকা ষোলো বছরের নিঃসন্তান বসন্তকুমারীর জন্য রাজ এস্টেট থেকে যে সম্পত্তি নির্ধারিত ছিল, সেগুলো দখল নিলেন কমলকুমারী। অনিবার্যভাবেই সংঘাত বাধল পিসি-ভাইঝির (দুই 'সতীন'-ও বটে)। ১৮৩৮ সালে বাইশ বছরের সুন্দরী বিধবা মহারানি বসন্তকুমারী মোকদ্দমা করলেন। রাজকর্মচারী ষড়যন্ত্রী মদনমোহনকে বরখাস্ত করে তিনজন মোক্তার নিযুক্ত করার নির্দেশ দিলেন। এদের মধ্যে দু’জন বৃটিশ, উইলিয়াম প্রিন্সেস আর হেজর সাহেব। তৃতীয় জন ছিলেন একজন বাঙালি নন্দন। পাথুরেঘাটার ঠাকুরবাড়ির দৌহিত্রপুত্র 'জ্ঞানান্বেষণ' পত্রিকার কর্ণধার, ডিরোজিও সাহেবের প্রিয় ছাত্র ও অনুগামী তরুণ মোক্তার দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় (১৮১৪-১৮৭৮)। তিনি ছিলেন প্রায় বসন্তকুমারীর সমবয়সি, তাঁকে নিয়োগ করার পরামর্শ দেন রাজপরিবারের পরম সুহৃদ স্বয়ং রাজা রামমোহন রায়। একবার রাজবাড়িতে বসন্ত উৎসবে আমন্ত্রিত দক্ষিনারঞ্জনকে চিকের আড়াল থেকে রানি দেখেছিলেন। তখনই রানির মনে প্রেমের ময়ূরপঙ্খী পাল তুলেছিল সম্ভবত।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘সেই সময়’ উপন্যাসটিতেও আমরা বসন্তকুমারী ও দক্ষিণারঞ্জনের প্রেমের বিবরণ পাই। ১৮৮৪ সালে জীবনীকার টমাস এডওয়ার্ড-এর ( লুই হেনরি ডিরোজিওর সমকালীন জনপ্রিয় লেখক ) লেখায় আমরা জানতে পারি যে, মহারানি বসন্তকুমারীর অতি বিশ্বাসভাজন সহচরীদের সাহায্যে বিশালাকার ফলের চুবড়িতে করে লুকিয়ে দক্ষিণারঞ্জন রাজঅন্তঃপুরে গিয়ে নিশিযাপন করেন। ঘন ঘন রাজঅন্তঃপুরে রানি কারণে-অকারণে দক্ষিণারঞ্জনকে ডেকে পাঠাতেন এবং দু’জনে নিভৃত আলাপচারিতায় মত্ত থাকতেন। এই রকম অনেক রসালো গল্প তৎকালীন সমাজের মানুষের খোরাক হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে লেখক মন্মথ ঘোষ তাঁর 'রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়' শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন যে, যেহেতু দক্ষিণারঞ্জন ডিরজিওর অনুগামী ছিলেন, তাই তাঁর ভালবাসাকে ছোট করার জন্যই এইসব রসালো প্রেমকাহিনির উদ্ভব, এগুলি কল্পকথা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে এই ঘটনাটি সত্য, রাজবাড়ির কাছাকাছি এক মন্দির ছিল, একদিন প্রায় জনাপঞ্চাশেক পুরনারী একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। ওইদিন সন্ধ্যায় দু’জন বিশ্বস্ত দাসীর সহায়তায় রানি বসন্তকুমারী দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে পালিয়ে যান। কিন্তু মহারানি কমলকুমারীর তৎপরতায় ঘোড়সওয়ার বাহিনী তাঁদের তাড়া করে ধরে ফেলে।এরপর শাস্তিস্বরূপ দক্ষিণারঞ্জনের দুইশত টাকা জরিমানা-সহ বেত্রাঘাত ও বসন্তকুমারীর ‘জেনানাফটক’-এ নির্বাসন হয়।
কিন্তু ভালবাসাকে বন্দি করে রাখা যায় না। বর্ধমানের অন্ধকার গোলঘরে অন্তরীণ থাকাকালীন বন্দি রানি বসন্তকুমারী মোক্তার হেজর সাহেবকে পত্র পাঠান। তিনি পর্যবেক্ষণে এলে কমলকুমারী ও পরানচাঁদ বাধা দেন। তখন দক্ষিণারঞ্জন কলকাতা থেকে আবেদনপত্র পাঠান, তার প্রেক্ষিতেই একজন সিভিল সার্জনকে পাঠানো হয়, তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। সেই রিপোর্টে নিশ্চিতভাবে বলা হয় যে, একটি জানালাবিহীন অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর ঘরে রানিকে বন্দি রাখা হয়েছে। রাজপ্রাসাদের অন্ধকার জগৎ থেকে আলোয় ফেরেন রানি বসন্তকুমারী; এরপর প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও রামমোহন রায়ের পিতা রামকান্ত রায়ের মধ্যস্থতায় বর্ধমানের রাজকোষ থেকে তাঁর আজীবন পাঁচশত টাকা মাসোহারা পাওয়ার চুক্তি হয়। এরপর বসন্তকুমারী মামলা তুলে নেন। আবারও ভালোবাসার জয় হয়।
এই ঘটনা সেই সময়ের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে, সমাজ সংস্কারের এক দলিল। এটি একাধারে বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ এবং সিভিল বিবাহ। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন একজন ধর্মসংস্থাপক এবং সমাজসংস্কারক। অতঃপর রানি বসন্তকুমারীকে বর্ধমান থেকে কলকাতায় এনে, তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট বার্চ সাহেবের সম্মুখে ‘সিভিল ম্যারেজ’ করেন দক্ষিণারঞ্জন। এই বিবাহে সাক্ষী ছিলেন 'সম্বাদ ভাস্কর' পত্রিকার সম্পাদক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য মহাশয়, ডা. ডি. গুপ্ত প্রমুখ।
দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় স্ত্রী বসন্তকুমারীকে নিয়ে চলে যান লখনউ; সেখানে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইংরেজ সরকারের দেওয়া অযোধ্যার 'রাজা' উপাধিতে ভূষিত হন এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রথম দেশীয় কালেক্টরের পদমর্যাদা লাভ করেন। বেথুন সাহেবের সঙ্গে স্ত্রী-শিক্ষার জন্য তাঁর একনিষ্ঠ লড়াই স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। নবজাগরণের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন প্রচলন হওয়ারও কুড়ি বছর আগে, তৎকালীন সমাজের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে রানি বসন্তকুমারীকে পত্নীরূপে গ্রহণ নিঃসন্দেহে এক দুঃসাহসিক কাজ।
ভারতবাসীর মনে রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় চিরকাল অমর হয় থাকবেন এবং যুগে যুগে তাঁর দুঃসাহসিক প্রেমের কাহিনি আলোচিত হবে।
[তথ্যসূত্র: স্বপ্নকমল সরকার,শ্রী বিমলেশ রায়চৌধুরী]