নিঃশব্দে যে যায় লাল পতাকা মুড়ে... বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যা শিখিয়ে গেলেন বাংলাকে
Buddhadeb Bhattacharjee Death: বুদ্ধদেব প্রকাশ্য সভায় নিজের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন, গুলি চালানোর ওই ঘটনার জন্য তিনিই দায়ী।
‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০!’ এই একটি কথাতেই বোঝা গেছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে থাকতে চরম কমিউনিস্ট নেতাও একদিন 'শাসক' হয়ে ওঠেন। নিজেকে ক্রমাগত ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়েই যেতে হয় একজন সাম্যবাদীকে। শ্রেণিচেতনার কথা বলতে গিয়ে ফাঁকতালে কোথাও অন্দরে শ্রেণি তৈরি হয়ে যাচ্ছে কিনা, তা প্রতিক্ষণ ছাঁকনিতে দেখে নিতে হয়। বুদ্ধদেব যখন ২৩৫ টি আসনের গর্ব করেছিলেন, সেই ফাঁকেই তৈরি হয়ে গেছিল রাজ্যে ক্ষমতাবদলের আলপথ। আলপথ ক্রমে চওড়া হতে হতে গিলে নেয় বামেদের সাজানো লাল বাগিচা। অথচ বুদ্ধদেব তো স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিলেন। এমন এক স্বপ্ন, যে স্বপ্ন সারা বাংলা তারপর থেকে আর দেখলই না। ২০১১ সালে কে ভেবেছিল শিক্ষা-চাকরি সবটাই বাতিলের খাতায় চলে যাবে এই রাজ্যে? কে ভেবেছিল হকের চাকরি চাইতে লড়তে হবে শিক্ষিত মানুষকে? কে ভেবেছিল, রাজ্যে চাকরি না পেয়ে শ'য়ে শ'য়ে যুবক-যুবতী প্রতিবছর চলে যাবে ভিনরাজ্যে, ভিনদেশে? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাত ধরেই বাম শাসনের ইতি ঘটেছিল এই রাজ্যে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রয়াত। শুধু একটি প্রশ্ন থেকে গেছে, ভুল স্বপ্ন দেখেছিলেন, নাকি ভুল পথে স্বপ্ন দেখেছিলেন বাম নেতা?
বুদ্ধদেবের সাদা ধুতি পাঞ্জাবীতে রক্তের দাগ খুঁজতে খুঁজতে গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গেল। প্রতিটি নির্বাচনে বামেরা ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে শূন্যে এসে ঠেকেছে। বাংলার রাজনীতিতে দুর্নীতি সহজ শব্দ হয়ে উঠেছে ক্রমে। বামপন্থা সোশ্যাল মিডিয়ার স্টেটাসে আটকে গিয়েছে। চাকরি, শিক্ষা, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল নিয়ে আজকাল বিশেষ কেউ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও দেন না। যারা দেন তারা ক্রমেই বাতিলের খাতায়। এমন একটা পর্যায়কে নিজের চোখের সামনেই গড়ে উঠতে দেখেছেন বুদ্ধদেব। দীর্ঘদিন ধরে মূল রাজনীতি থেকে তিনি সরে গেছেন। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়েছেন। দীপ নিভেছে। বাংলা তাঁকে ডাকছে রাজনীতির 'শেষ ভদ্রলোক' নামে! ভদ্রতাকে রাজনীতি থেকে বাদ দিয়ে ভাবতেই এই ১৫ বছরে শিখে গিয়েছে মানুষ। বুদ্ধদেবের প্রয়াণে একটা আস্ত প্রজন্মের বেড়ে ওঠার বড় অধ্যায়ে তালা পড়ল।
আরও পড়ুন- ৪০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে জীবন কাটল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের, সততার সহজপাঠ ছিল হাতের কাছেই
তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র। প্রথম থেকেই যে রাজনীতিতে ঝোঁক ছিল তা নয়। তবে বামপন্থী পরিবারে বেড়ে ওঠাতে বাম সংস্কৃতি বুদ্ধদেবের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বাম-মনস্ক ছাত্র ছিলেন বুদ্ধদেব কিন্তু সরাসরি দলীয় কর্মী ছিলেন না। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের পর ১৯৬৪ সালে সিপিআই (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি) ভেঙে সিপিএম বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) তৈরি হয়। ১৯৬৬ সালে বুদ্ধদেব সিপিএমের সদস্য হন। মূলত দলীয় পত্রপত্রিকা সম্পাদনা এবং লেখালিখির দায়িত্ব নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই সময়টা বাংলার রাজনীতি বড়ই অস্থির। সিপিআই-সিপিএম ভাঙন তো বটেই, নকশাল আন্দোলনও মাথাচাড়া দিচ্ছে। সশস্ত্র সংগ্রাম নাকি ধীর বিপ্লব, এই দ্বন্দ্বে ভাঙছে দল। তরুণ-যুবাদের দল ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময়েই, ষাটের দশকের শেষের দিকে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের (ডিওয়াইএফআই) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হন বুদ্ধদেব। খাদ্য আন্দোলনে অংশ নেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রচারেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ক্রমেই বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বৃত্তে যাতায়াত বাড়ে। এই সময়টাতেইই পোক্ত হয় বাংলার সংস্কৃতির চেতনার ভূমি। এরপর সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য হন বুদ্ধদেব। জীবনের প্রথম নির্বাচনেই জিতেছিলেন। ১৯৭৭ সালে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে বিধায়ক হন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে ১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যান বুদ্ধদেব। পরে ১৯৮৭ সালে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে জিতে আবারও তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন। ১৯৮৭ সাল থেকেই যাদবপুর ছিল তাঁর বিধানসভা কেন্দ্র। ২০১১ সালে তাঁকে হারিয়ে এই কেন্দ্র জিতে নেন তৃণমূলের মণীশ গুপ্ত। ২০১৬ সালে বাম নেতা সুজন চক্রবর্তী এই আসনে আবার জেতেন। তবে ২০২১ সালে তা ফের জেতেন তৃণমূলের দেবব্রত মজুমদার।
এই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি সচিবের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল তাঁর। পরে অবশ্য আবার মন্ত্রিসভায় ফিরে এসেছিলেন তিনি। তথ্য সংস্কৃতির পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও সামলেছেন বুদ্ধদেব। পুলিশ দফতরও পরিচালনা করতেন তিনি। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে জ্যোতি বসুর সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হন বুদ্ধদেব। ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর বুদ্ধদেব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন।
আরও পড়ুন- সেদিন সন্তানতুল্য বুদ্ধদেবের কটাক্ষে আহত হয়েছিলেন গীতা মুখোপাধ্যায়
২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪ টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২৩৫টি আসনে জেতে বামফ্রন্ট। যে কথাটিই তিনি বলেছিলেন ২০১১ সালে। কে জানত, ২৩৫ থেকে শূন্য হয়ে যেতে সময় লাগবে না মোটেও! শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর এক লক্ষ টাকার ন্যানো গাড়ির কারখানার প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, "কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ"। বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস এই শিল্পায়নকেই ইস্যু করে। সিঙ্গুরে জমি পরিদর্শনে গিয়ে গ্রামবাসীদের বিরোধিতার মুখে পড়েন টাটার প্রতিনিধিরা। রাজ্যের ভিত্তি ও ভবিষ্যৎ নাড়িয়ে দেয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন। ওই জমিতে কারখানার কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে আজও। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে কারখানা হলে কী কী হতো, কারখানার বদলে কী কী হলো আর কেউই প্রশ্ন করে না। এখন নন্দীগ্রাম বিজেপির দলবদলু নেতা শুভেন্দুর গড়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না শুভেন্দু কার দখলে থাকবে এই অঞ্চল তাই নিয়েই যত তর্ক। সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানা হয়নি। রতন টাটা সিঙ্গুর থেকে চলে যান গুজরাতে।
২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে গুলি চালায় পুলিশ। সংঘর্ষে নিহত হন ১৪ জন গ্রামবাসী। এই ছিল শেষের শুরু! ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটেই বোঝা গেছিল হাওয়া আর বামেদের পালে নেই। পঞ্চায়েত ভোটেই পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ দখল করে তৃণমূল। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২৭টিতে হেরে যায় বামফ্রন্ট। ১৯টি আসন জেতে বিরোধী তৃণমূল। স্পষ্ট হয়ে যায়, হাওয়া বদলাচ্ছে। দলবদলের হিড়িক পড়ে। আর এই সময়কালে তৃণমূল লাগাম ছাড়েনি একটুও। ২০০৭ সালের ইস্যুকে বাঁচিয়ে রেখে ২০১১ সালে রাজনৈতিক পাশা পাল্টে দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন দল।
আরও পড়ুন- বাংলার রাজনীতির শেষ ‘ভদ্রলোক’! প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
গুলি না চললে কি এই দিন দেখতে হতো বুদ্ধদেবকে? এই দিন দেখতে হতো আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাস করা অজস্র মানুষদের? বুদ্ধদেব সেই রাজনীতিক, যিনি সত্যকে স্বীকার করতে ভয় পাননি। বুদ্ধদেব প্রকাশ্য সভায় নিজের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন, গুলি চালানোর ওই ঘটনার জন্য তিনিই দায়ী। দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। তবে পাশাপাশি এও বিশ্বাস করতেন, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্তরে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়েছিল কিন্তু সেইজন্য শিল্পায়নের পথ থেকে সরে আসা উচিত নয়। তবে ততদিনে পাল্টে গেছে সরকার। জমি আন্দোলনকে সামনে রেখে নিজের শাসক রূপ প্রকাশের পথ প্রশস্ত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের আমলে বামেদের পতন মেনে নিতেন পারেননি বুদ্ধদেব। লহমায় নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন মূল ধারার রাজনীতি থেকে। শুধু মন নয়, শরীরও ভেঙে যায় তাঁর।
তবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও দু’বেলা আলিমুদ্দিনের দলীয় দফতরে আসতেন পড়াশোনা করার জন্য। এসব ঘটনা অবাক ঠেকে এখন। পড়াশোনার সঙ্গে রাজনীতিবিদদের যে সম্পর্ক থাকাটাই অবাস্তব, শাসকদলই মোটামুটি তা প্রমাণ করে দিয়েছে। শুধু রাজ্য কেন, দেশ জুড়েই তা প্রমাণিত। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়া, শ্বাসকষ্টের সমস্যায় আলিমুদ্দিনে এই নিবিড় পাঠও বন্ধ হয়ে যায় বুদ্ধদেবের। শেষ বার তাঁকে জনসমক্ষে দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশে। নিজের ছোট্ট বাড়িতে যেন সেঁধিয়ে গেছিলেন ক্রমেই। সেই ছোট্ট বাড়িতে থেকেই চলেও গেলেন এই নেতা। সেই নেতা যার কাঁধে আস্ত শাসন পতনের গ্লানি লেগে আছে। সেই নেতা যাকে শুনতে হয়েছে নন্দনপ্রেমী 'এলিট' হয়েই সর্বনাশ ঘটিয়েছেন দলের। সেই নেতা, যাকে ঢের পরে রাজনীতিতে আসা শিশুও সমালোচনা করে বলেছে তিনি বামশাসন পতনের 'কালপ্রিট'। দেহটুকু দান করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও ৪০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে থেকেছেন। এখন সদ্যনেতাদের ২২ লাখের গাড়ি, ডেস্টিনেশন ওয়েডিং! বুদ্ধদেব প্রমাণ করেছেন, কমিউনিজম একটা জীবন আদর্শ। কেউই কমিউনিস্ট হতে পারে না হয়তো, স্রেফ আজীবন চেষ্টা করে যেতে পারে। বুদ্ধদেব চেষ্টা করে গেলেন, আজীবন। বহু যুগ পরে যদি কোনও নব্য যুবক, সদ্য যুবতী লিও সাওচি নেড়ে হাউ টু বি আ গুড কমিউনিস্ট হতে চায়, বুদ্ধদেব নিশ্চয়ই তাঁদের দেখে ভরসা পাবেন।