নতুন প্রজন্ম চেয়েছিল বাংলাকে স্বপ্ন দেখাবেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই

Buddhadeb Bhattacharjee: জ্যোতি বসুর নিজস্ব ইমেজ, বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিজস্ব ইমেজ দলের সম্পদ ছিল। বিরোধীরাও তা জানতেন।

স্কুল বয়স থেকেই সুকান্ত ভট্টাচার্য আমার প্রিয় কবি ছিলেন। স্কুলে রচনা লিখতে দিলে, প্রিয় কবি, প্রিয় লেখকের ক্ষেত্রে সবসময় সুকান্ত ভট্টাচার্যই লিখতাম। ২০০০ সাল, তখন বয়স আমার ১৪! প্রথম যখন শুনলাম সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন, সে আলাদাই উত্তেজনা! সেই প্রথম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করা। আসলে আমি বা আমাদের প্রজন্মের কিছু ছেলে মেয়ে, যারা সেই সময় সিপিএমের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে তাঁদের কাছে এই ঝোঁকের একটা অন্যতম কারণ ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, এই নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা বলার মধ্যে একটা নতুন দিক খুঁজে পেলাম আমরা, তাঁর সংস্কৃতি মনস্কতা আমাদের নতুন একটা ঝাঁকুনি দিল। তাঁকে দেখেই রাজনীতিতে আসিনি একথা সত্য, তবে ছাত্রজীবনে যাদের দেখে বামপন্থার প্রতি আরও নিবিড় হয়েছি, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

সত্যি বলতে গেলে, ২০০৭ সাল, যখন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম ইস্যুতে রাজ্য উত্তাল, একটা পাল্টা হাওয়া উঠছে যে সময়, সেই মুহূর্তে কিন্তু আমরা আরও বেশি আকৃষ্ট হচ্ছি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি, তাঁর ভাবনার প্রতি। আমরা তো তখন কলেজে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলছেন রাজ্যে শিল্প দরকার, শিল্প এলে কর্মসংস্থান হবে। তখন তো আর জানি না, আগামীতে পার্টির হোলটাইমার হব। তখন আরও লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের মতোই আমিও চাকরির কথা ভাবছি, ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের কথা ভাবছি, শিল্প এলে কী কী হবে ভাবছি। ফলে আমাদের কাছে তখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য 'হিরো'! সিপিএমের ক্ষেত্রে সবসময়ই নেতার 'ইমেজ' একটা বড় বিষয় ছিল। জ্যোতি বসুর নিজস্ব ইমেজ, বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিজস্ব ইমেজ দলের সম্পদ ছিল। বিরোধীরাও তা জানতেন। জানতেন বলেই সবার আগে বুদ্ধদার ব্যক্তিগত ইমেজকেই নিশানা করা হয়েছিল। এখন যারা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মালা দিচ্ছেন, শোকবার্তা জানাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই সেই সময় বলেছিলেন, রতন টাটার সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গোপন কিছু লেনদেন হয়েছে বলেই তিনি সিঙ্গুর চুক্তি প্রকাশ করছেন না। শুভাপ্রসন্নের মতো শিল্পীরা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবি নিয়ে নানা কদর্যতার প্রমাণ রেখে গেছেন। তাতে আমাদের কিন্তু এই মানুষটির প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেছিল। এত আক্রমণের মুখে পড়েও নিজের আপোসহীন অবস্থান বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ধরে রেখেছিলেন। আজ সারা রাজ্য টের পাচ্ছে, বুদ্ধদেব ভট্টচার্য শিল্পায়নে সফল হলে ঠিক কী কী ঘটতে পারত!

আরও পড়ুন- সেদিন সন্তানতুল্য বুদ্ধদেবের কটাক্ষে আহত হয়েছিলেন গীতা মুখোপাধ্যায়

আমার সঙ্গে বুদ্ধদার আলাপ ২০১১ সালে। তার আগে কথা হয়েছে কয়েকবার। তখন আমি ছাত্র সংগ্রামের সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। পুজো সংখ্যার লেখা ওঁর কাছ থেকে নিতে গেছি। টুকটাক কথা, এটুকুই। আমাকে তিনি চিনলেন ২০১১ সালে, যখন আমাকে প্রার্থী করা হলো। তখন ভালো করে আলাপ শুরু। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বেশ কয়েকবার কসবায় আমার প্রচারে আসেন। যাদবপুরে তখন প্রার্থী বুদ্ধদেব ভট্টচার্য। কাছাকাছি জায়গা হওয়ার ফলে অনেক ক'টা মিছিলে আমরা সঙ্গে ছিলাম। দু'জনেই প্রার্থী হিসেবেই যৌথ প্রচার করেছিলাম। নন্দীবাগান মাঠে বড় সমাবেশ হয়েছিল, অ্যান্ড্রুজ কলেজে একসঙ্গে ছাত্রদের সঙ্গে মুখোমুখি একটা আলোচনারও আয়োজন হয়েছিল। তাতে আমরা সঙ্গে ছিলাম।

রাজনীতিতে 'ভদ্রলোক' নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে আজ! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সেই সময় এহেন খারাপ কথা নেই যা শুনতে হয়নি। তবে যাবতীয় খারাপ কথা, ঘৃণাভাষণের সামনে দাঁড়িয়েও বুদ্ধদা কখনও এমন কোনও কথা বলেননি, কোনও শব্দ উচ্চারণ করেননি যা সভ্য নয়। শুধু তৃণমূল বা বিজেপি তো নয়, সবসময় যে আমরাও এই শব্দের ব্যবহার মেনে চলতে পারি এমনটা কিন্তু নয়। কেউ খারাপ বললে, পাল্টা খারাপ শব্দই বলে ফেলেছি হয়তো কখনও যেটা একেবারেই আমার বলা উচিত হয়নি। এটা আসলে কেবল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নন, সেই প্রজন্মের অনেক নেতাই, যেমন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, প্রণব মুখোপাধ্যায়, তপন শিকদার— কেউই কুকথা ব্যবহার করতেন না। কিন্তু গত ১০/১১ বছরে রাজনীতি এমন এক বাঁকে এসে দাঁড়াল যেখানে এমন অনেক শব্দই রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠেছে যা ভাবাও যায় না! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও একবার বলেছিলেন, রাজনীতিতে অন্ধকার জগতের ভাষা শোনা যাচ্ছে। একবার মনে আছে, ভোটেরই প্রচার চলেছে। কসবায় একটা জায়গায় বোম পাওয়া গেছে। তৃণমূল বোমা মজুত করেছিল যা পরে আমাদের দলীয় কর্মীরাই খুঁজে বের করে। আমি সংবাদমাধ্যমে কিছু কথা বলি তখন। সন্ধেবেলা আমার কাছে ফোন এল পার্টি অফিস থেকে, বুদ্ধবাবু কথা বলবেন। আমাকে ফোনে বোঝালেন, শুনলাম তুমি এই এই কথা বলেছো। তুমি কথাটা এভাবে বলো না। এভাবে বললে অন্য অর্থ দাঁড়ায়। অন্যভাবে বলো। এই ঘটনাটা বড্ড মনে পড়ছে আজ।

বুদ্ধদার সঙ্গে যখনই দেখা হতো, একটা বিষয় তিনি জিজ্ঞেস করতেনই। পরিবারের খোঁজ নিতেন, রাজনীতির তথ্য তো নিতেনই, পাশাপাশি সিনেমার কথা জিজ্ঞেস করতেন। যখনই দেখা হতো, জিজ্ঞেস করতেন, নতুন সিনেমা কী দেখলে? নতুন কোন গান শুনলে? আর শেষ কোন ভালো বই পড়লে? ক্ষয়িষ্ণু আদর্শের এই পৃথিবীতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হয়তো এই ছোট ছোট আচরণেই ছিলেন সবার মধ্যে অনন্য! এখন তৃণমূল আমাদের দিকে অভিযোগ তোলে যে, আগে ক্যামেরা, মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ইত্যাদি এত ছিল না, ফলে বামেদের অনেক 'কুকীর্তি'-র প্রমাণ পাওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে, ক্যামেরা, মোবাইল এসব ছিল না বলেই অতি সহজে অনেক মানুষের নামে মিথ্যা অপবাদও দেওয়া গেছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বুদ্ধদা জীবনে কখনও বলেননি, “আমি চোরদের মন্ত্রিসভায় থাকব না"। সচিবের সঙ্গে মনোমালিন্যে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে জ্যোতি বসুর সঙ্গে কথা বলে তা মিটিয়েও নেন। বর্তমান পত্রিকা সেই সময় মিথ্যে কথা লিখে প্রচার করে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের 'আমরা-ওরা' নিয়ে কত কথাই হয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঔদ্ধত্য নিয়ে কত নিন্দা হয়। গোটা কথা থেকে একটা খণ্ডাংশ তুলে এনে তাঁকে 'ভিলেন' তৈরির চেষ্টা হয়। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে শিল্প তৈরি করার ভাবনা হঠাৎ করে আসেনি। বিধানসভা ভোটের আগেই বামেরা বলেছিল, রাজ্য কৃষিতে একনম্বর স্থানে গেছে, এবার শিল্পে একনম্বরে পৌঁছনোর পালা। নির্বাচনে জিতলে কোন কোন স্থানে শিল্প হবে তা বলা হয়েছিল। এই কথা জেনেই মানুষ বামেদের পক্ষেও ভোট দিয়েছে, বিপক্ষেও দিয়েছে। আমরা ২৩৫, ওরা ৩০। মানুষ বেছে নিয়েছে। এই পুরো কথার মধ্যে থেকে খণ্ডাংশ তুলে এনে প্রমাণ করা হলো সংখ্যার অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না মুখ্যমন্ত্রীর! সত্যের অপলাপের বড় 'ভিকটিম' হয়েছেন বুদ্ধদেব।

আরও পড়ুন- নিঃশব্দে যে যায় লাল পতাকা মুড়ে… বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যা শিখিয়ে গেলেন বাংলাকে

বুদ্ধদা বলতেন, সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের এই লড়াইয়ে প্রশ্ন এটা নয় যে আমরা জিতব না হারব। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে আমাদের ভুল থাকতে পারে, ধরিয়ে দিন শুধরে নেব। ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ নিয়ে আমাদের ভুল থাকতে পারে, ধরিয়ে দিন, শুধরে নেব। কিন্তু আমরা চাই বাংলায় কলকারখানা হোক, শিল্প হোক, আমাদের এই চাওয়ার মধ্যে কোনও ভুল নেই। যদি এই চাওয়াকে আটকাতে চান তাহলে তার প্রায়শ্চিত্ত কেবল বামফ্রন্ট করবে না, সারা পশ্চিমবাংলার কয়েকটা প্রজন্ম করবে। বাংলা এই প্রায়শ্চিত্ত আক্ষিরক অর্থেই করতেন।

শেষ একটা ঘটনা না বললেই নয়। ২০১৬ সাল। বুদ্ধদেব আর ভোটে দাঁড়াননি। শরীরও ভেঙে গেছে তাঁর। ঢাকুরিয়া থেকে গড়িয়ার দিকে একটা মিছিলে আমি ছিলাম তাঁর সঙ্গে। সেবার দেখি, রাস্তার দু'ধারে প্রচুর কমবয়সি ছেলেমেয়ের ভিড়। তারা হাত বাড়িয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ছুঁতে চাইছে। অনেকেই বলছে, আপনাকে আবার মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চাই। বুদ্ধদেব মুচকি হাসছেন। কী আর বলবেন! তখন তিনি মূলধারার রাজনীতি থেকে বেশ দূরে, শরীরও দেয় না আর। তবু, নতুন প্রজন্ম তাঁকে চাইছে। চাইছে এমন একজন নেতাকে যিনি স্বপ্ন দেখাবেন বাংলাকে! আজ এই অবেলায়, সেই দৃশ্যই মনে পড়ছে খুব।

More Articles