আমাদের বড় হওয়ার সময়টাকে বুদ্ধদেব ভট্টচার্য তাঁর মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন
Buddhadeb Bhattacharjee: যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে, সে আমি একা হই বা দলবল মিলে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হাতের কাছে পেলেই নানা প্রশ্ন করতাম।
আমরা যখন ছাত্র রাজনীতি করতে আসছি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন সক্রিয় রাজনীতির অঙ্গন থেকে আস্তে আস্তে প্রস্থান করছেন। মনে আছে, ২০১০-১১ সাল নাগাদ প্রথম আমার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা হয়। তারপর থেকে যে বিস্তর কথা বা সাক্ষাৎ হয়েছে এমন নয়। কিন্তু যে কয়েকবার তাঁকে পেয়েছি একান্ত পরিসরে, প্রতিটি মুহূর্ত ভাস্বর! যেমন মনে আছে, ২০১২ সালে বিশ্ব রাজনীতিতে একটা বড় ঘটনা ঘটে, গ্রিস দেউলিয়া হয়ে যায়। সেই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দীর্ঘ কথা হয়, আনুষঙ্গিক নানা বিষয় উঠে আসে। সেই আলোচনা ভোলার নয়! অত্যন্ত সহজ করে অত্যন্ত জটিল বিষয়কে বোঝাতে পারতেন। এরপরেও বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে ঠিকই, তবে ২০১৭-র পর তিনি প্রায় গৃহবন্দিই হয়ে যান, আমরাও কারণে-অকারণে খুব একটা বিরক্ত করতাম না তাঁকে।
আসলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শুধু সিপিআইএমের নন, সারা রাজ্যেরই অভিভাবক ছিলেন। এই কলুষময় রাজনীতির দুনিয়ায়, গোটা দেশ জুড়েই বিরলতম ব্যাতিক্রমী উদাহরণ ছিলেন তিনি। মূল্যবোধের প্রশ্নে সদা জাগরুক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জীবনে ন্যূনতম আপোস কখনও, কোনওদিনও করেননি। তিনিই ছিলেন আমাদের প্রজন্মের স্বপ্নদিশারী। একথা বলতে সংশয় নেই, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেখানো স্বপ্নে আমাদের প্রজন্ম বাঁচতে চেয়েছিল। বাংলার রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর নির্দিষ্ট কিছু সুপষ্ট পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনার সারবত্তা যে কতখানি গভীর ছিল তা ২০১১ সালের পর থেকে প্রতিনিয়ত আমরা বুঝতে পারছি।
আরও পড়ুন- নিঃশব্দে যে যায় লাল পতাকা মুড়ে… বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যা শিখিয়ে গেলেন বাংলাকে
শিক্ষা, পরিকাঠামো, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, রাজ্যের সার্বিক বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন ছিল তাঁরই চিন্তার একটা অংশ। আমাদের রাজ্য থেকে ততদিনে কিন্তু একটা বড় অংশের যুবক-যুবতী ভিনরাজ্যে, ভিনদেশে চলে যেতে শুরু করেছে। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব। চেয়েছিলেন রাজ্যের মেধা এই রাজ্যেরই মানবসম্পদকে আরও সমৃদ্ধ করুক। বুদ্ধদেব সুস্পষ্ট বুঝেছিলেন, রাজ্যে ভূমি সংস্কার হয়েছে, ধীরে ধীরে গ্রামীণ বাজার তৈরি হয়েছে, মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নও হয়েছে। এরপরে এই নতুন ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থান দরকার। পাশাপাশি, এই সব ছেলে-মেয়ে যেন নিজের রাজ্যেই কাজ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এই ভাবনা সেই সময় যে কতটা প্রাসঙ্গিক ছিল তা তো প্রতিদিনই আমরা বুঝছি।
আসলে আমরা মানুষ হিসেবে বড় হয়ে ওঠার এই সফরে প্রতিনিয়ত শিখতে থাকি। প্রাথমিক শেখার শুরুটা হয় বাবা-মা, পরিবার, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বন্ধুদের থেকেই। আমাদের সঙ্গে রোজ লেপ্টে থাকা এই পরিচিত বৃত্তের বাইরে একটা বড় সমাজও তো আছে। সেই সমাজই মূলত আমাদের মানুষ হিসেবে তৈরি করে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমাদের প্রজন্মে, দলমত নির্বিশেষে, আমরা যে ক'জন মানুষ হিসেবে তৈরি হওয়ার চেষ্টা করছি, আমরা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে অশেষ ঋণী। তিনি আমাদের সমাজের অভিভাবক ছিলেন। আমরা যে সময়ে বড় হচ্ছি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মূল্যবোধ, তাঁর আদর্শই ছিল আমাদের পাথেয়। এমনকী, যে মানুষ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কোনওদিন দেখেননি, নিকটেও আসেননি, যিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আত্মীয়ও নন, দলেরও কেউ নন সেই মানুষটিকেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মূল্যবোধ প্রভাবিত করেছিল। আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়টাকেই মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে দিতে পেরেছিলেন বুদ্ধদেব। আজ আমরা প্রত্যেকে যে যা হয়েছি, তার মধ্যে যা যা শুভ দিক আছে তাতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরাট, বিপুল অবদান থেকে গেছে।
মনে পড়ে, যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে, সে আমি একা হই বা দলবল মিলে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হাতের কাছে পেলেই নানা প্রশ্ন করতাম। এইটা কেন হলো? ওইটা কেন এভাবে ঘটছে — এসব প্রশ্নে ব্যাতিব্যস্ত করে ফেলতাম। অনেকসময় অনেক অপ্রিয় প্রশ্নও করেছি, যে কেউ খুব অস্বস্তিতে পড়তে পারতেন সেই সব প্রশ্নে। অথচ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অত্যন্ত স্নেহবৎসল হয়ে, হাসিমুখে, ঠান্ডা মাথায় পুরোটা বুঝিয়ে বলতেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন বাঁক, জাতীয় রাজনীতির নানা ওঠা-নামা সহজ করে বলতেন। আমাদের তো সেই সময় খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ছিল, আমরা হারলাম কেন? কী করলে আবার সমর্থন ফিরবে? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এসব অস্বস্তিকর প্রশ্ন কখনই এড়িয়ে যাননি। বিশ্লেষণ করেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর কথা বারেবারে মনে করিয়ে দিয়েছেন আমাদের।
আরও পড়ুন- ‘অন্ধকার বলে কিছু নেই, আছে আলোর অভাব’, বলতেন আজীবন মার্কসবাদী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
যে কথাটা আগেও বলছিলাম, বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে অত্যন্ত গভীর বীক্ষা, গভীর দূরদর্শিতা ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর অনেকরকম প্রশ্ন ওঠে। মূল একটা জায়গাতেই দ্বন্দ্ব ছিল যে, ২১ শতকে সমাজতন্ত্রের চেহারাটা কী হবে। সেই সমস্ত বিতর্কের দিশা পেতে যারা আমাদের প্রজন্মকে পথ দেখিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই থাকবেন সর্বাগ্রে। একটি ঘটনার কথা তাই না বললেই নয় বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার নিরিখে। ২০০৮ সালের মন্দার পর বিশ্ব রাজনীতিতে খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন ঘটে যায়। ঘটনাগুলো এতই একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে এবং এত দ্রুত ঘটতে থাকে যে একদিন বিশ্ব রাজনীতি সংক্রান্ত বিবিধ প্রশ্ন নিয়ে আমি এবং আরও কয়েকজন হাজির হই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে। এত সহজে, এত গুছিয়ে গ্রিসের সঙ্কট, ব্যাঙ্কিংয়ের সঙ্কট, তৃতীয় বিশ্বের দেশে কী প্রভাব, ভারতের কী শিক্ষণীয় সবটা বুঝিয়েছিলেন তিনি। ওই ২০১১-১২ নাগাদ তখনও বিজেপি ক্ষমতায় আসেনি ভারতে। আমার এই ঘটনাটা মনে আছে বিশেষ করে কারণ, সেই সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, বিশ্বজোড়া এই যে সঙ্কট, একে সামাল দিতে যদি পাল্টা জনমুখী কথা না বলা যায় তাহলে এর চরম পরিণতি হিসেবে দেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসবে, গরিব মানুষদের মধ্যে ভেদাভেদ বৃদ্ধি পাবে এবং আবারও মন্দির-মসজিদই হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম ইস্যু।
নতুন প্রজন্মকে নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিনেমা, গল্প, নাটক, গান কী কী নতুন হচ্ছে সব খবর রাখতেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ঘিরে যা যা বিতর্ক, তা ঘিরে তাঁকে প্রশ্ন করলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্নেহ বাৎসল্য কম হয়নি। তাঁর আদর্শ আমাদের বেঁচে থাকাকে অলক্ষ্যে গড়ে দিয়ে গেছে। আমাদের অসংখ্য কমরেড আছেন যারা তীব্র জীবন যন্ত্রণা সয়েও, প্রলোভনের হাতছানি সরিয়ে রেখে অত্যন্ত সৎভাবে শুধু কমিউনিস্ট পার্টিতে কাজ করে যাচ্ছেন তাই নয়, জীবনটাও সেই সততা দিয়েই অতিবাহিত করছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মূল্যবোধ ও সততার প্রশ্নে বিরলতম ব্যক্তি ছিলেন ঠিকই। তবে যে বোধের সঞ্চার তিনি ঘটিয়ে গেছেন তা নিয়ে চলার মতো মানুষ এই পৃথিবীতে আজও আরও অনেকেই আছেন। সবাই যে আমাদের দলের মানুষ তাও নয় কিন্তু সমাজে তারা আছেন। আছেন বলেই আমরা এখনও জীবন চালিয়ে যাচ্ছি, স্বপ্ন দেখছি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে যে বিষয়ে আমাদের সতর্ক করে গেছিলেন, তা সে সাম্প্রদায়িকতা হোক বা আত্মকেন্দ্রিকতার চক্রব্যূহ, সেগুলো নিয়ে সচেতন হওয়াই এই মুহূর্তে, তাঁর অবর্তমানে আমাদের প্রজন্মের মূল কাজ।